নদী ভাঙনে পিরোজপুরের মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাচ্ছে ৭ গ্রাম
প্রকাশিত:
৫ মার্চ ২০২৩ ২১:৪১
আপডেট:
২৩ এপ্রিল ২০২৫ ০২:৪৩

দক্ষিণে কঁচা নদী আর উত্তরে বেলুয়া নদী, মাঝখানে কালিগঙ্গা। এই কালিগঙ্গা বিভক্ত করেছে পশ্চিমে নাজিরপুর এবং পূর্বে স্বরূপকাঠি উপজেলাকে। কালিগঙ্গার পূর্বপাড়ে চর পড়লেও পশ্চিম পাড়ে শ্রীরামকাঠি বন্দর দক্ষিণ বাজার, চলিশা-জিবগ্রাম থেকে সাবোডাঙা পর্যন্ত কয়েক কিলোমিটার জায়গা জুড়ে হয় তীব্র নদী ভাঙন।
পিরোজপুরের সদর উপজেলা ও নাজিরপুর উপজেলার দূর্গাপূর-কলাখালী-শ্রীরামকাঠি ইউনিয়নের পার্শ্ববর্তী কালিগঙ্গা নদী তীরবর্তী এই ভাঙনে ভোগান্তিতে ৫ হাজারের বেশি মানুষ। স্থানীয় সাধারণ মানুষ বলছে, দ্রুত এই ভাঙন রোধে ব্যবস্থা না নিলে পিরোজপুরের মানচিত্র থেকে হারিয়ে যেতে পারে সাতটি গ্রাম।
সংশ্লিষ্ট পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, নদী ভাঙন রোধে প্রকল্প জমা দেওয়া হয়েছে। পাস হলেই কাজ শুরু হবে।
সরেজমিনে দেখা যায়, কয়েক বছর যাবত ভাঙছে কঁচা ও বেলুয়া নদীর মধ্যবর্তী কালিগঙ্গা নদীর পশ্চিম পাড়। গত দুই বছরের তুলনায় এ বছর ভাঙনের তীব্রতা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। এই নদী ভাঙনে হুমকির মুখে পড়েছে শ্রীরামকাঠীসহ ৩ ইউনিয়নের শ্রীরামকাঠি দক্ষিণ বাজার থেকে চল্লিশা জীবগ্রাম হয়ে সাপডাঙ্গা পর্যন্ত সাত গ্রামের প্রায় পাঁচ হাজার মানুষ। এই উত্তাল কালিগঙ্গা কেড়ে নিয়েছে মানুষের শত শত বিঘা ফসলি জমি। একমাত্র চলাচলের পথটিও বর্তমানে ভেঙে নেমে যাওয়ার পথে। স্থানীয় বহু মানুষ নিজেদের বসতভিটা সরিয়ে নিতে নিতে সরে দাঁড়ানোর এখন আর কোনো জায়গা নেই। অনেকে এলাকা ছেড়ে চলে গেছেন। ভাঙন আতঙ্কে রয়েছে ৮৭নং চলিশা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, মসজিদ ও মন্দির।
এছাড়া সামনেই রয়েছে বর্ষা মৌসুম। রাস্তায় কাদা, নদী ভাঙনের সঙ্গে যুক্ত হবে রাস্তায় ভাঙন। এমন দুর্ভোগ তাদের আগামী দিনের সঙ্গী। এলাকাবাসীর দাবি, বাপ-দাদার সহায়-সম্পত্তি সব ভাঙনে নেমে গেছে। বাকি আছে সরিয়ে রাখা বসতবাড়িটুকু। সেটুকু ভাঙনে নেমে গেলে ভূমিহীনদের তালিকায় নিজেদের নাম লেখাতে হবে।
স্থানীয় মিজানুর রহমান বলেন, প্রতিবছর প্রায় একশ পরিবার এভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। আমরা আজ ভূমিহীনের তালিকায়। যথাযথ কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। আমরা যারা নদী পাড়ে বসবাস করছি তাদের জন্য বেড়িবাঁধ দিয়ে যেটুকু আছে সেটুকু যেন রক্ষা করা হয়।
রুহুল আমিন ফকির বলেন, বাবলা খালের মাথা থেকে শ্রীরামকাঠি পর্যন্ত কয়েক কিলোমিটার জায়গা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এখানে হাওলাদার, ফকির, মোল্লা, খাঁ ও শেখদের কয়েকশত বিঘা সম্পত্তি সব নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। ভাঙতে ভাঙতে জমি নদীর ওপারে উঠে গেছে।
স্থানীয় দেলোয়ার হোসেন খান বলেন, পিরোজপুর সদর উপজেলার চলিশা গ্রামটি অনেক অবহেলিত। এখান থেকে দূর-দূরান্তে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা করতে যায়। একটা প্রাইমারি বিদ্যালয় বিলীনের পথে। ২ শতাধিক পরিবার ভাঙনের কারণে এলাকা ছেড়ে চলে গেছে। নদী ভাঙতে ভাঙতে আমরা শেষ পর্যায়ে চলে এসেছি। মাদরাসা-মসজিদসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নদীগর্ভে হারিয়ে গেছে, যা আছে সেগুলোও যাচ্ছে। আমার জীবনে আমি চার পাঁচবার বাড়ি-ঘর সরিয়েছি।
অভিভাবক হাফসা বেগম বলেন, এলাকায় ব্রিজ কালভার্ট কিছুই নাই। রাস্তা তো যতটুকু ছিল নদী ভাঙনে নেমে যাচ্ছে। কোনো কাজ হচ্ছে না। যতটুকু হয় তাও নদী ভাঙনে নেমে যায়। বাচ্চারা বিদ্যালয়ে যায় অনেক কষ্ট করে। আমার বাচ্চাও সেদিন ফাটলে পড়ে ব্যথা পেয়েছে।
ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধা হেনোয়ারা বেগম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমার বিয়ের পর তিনবার ঘরবাড়ি সরিয়েছি। বর্তমানে যে ঘরটুকু আছে সেটিও ভাঙনের মুখে। আমি ক্যান্সারের রোগী, খুব অসুস্থ। আমার একটাই ছেলে। ঘরের পেছনে আর কোনো জায়গা নেই যেখানে আবার ঘর তুলব। সরকারের প্রতি অনুরোধ আমাদের যেন একটু থাকার ভালো ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়।
শিক্ষার্থী জায়েদা খানম বলেন, অনেকবার সমস্যায় পড়েছি। আমাদের নদী যেমন ভাঙছে, সঙ্গে রাস্তাঘাটও নিয়ে যাচ্ছে। রাস্তাঘাট দিয়ে চলাচলের মতো পরিস্থিতি নাই। আমাদের এখানকার শিক্ষার্থীদের অনেক কষ্ট করে স্কুল কলেজে যেতে হয়। সামনে ফসলি আবাদ আছে। সেখানে ঠিকঠাক কৃষিকাজ না হলে আমাদের না খেয়ে মরতে হবে।
জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মাহবুবে মাওলানা মেহেদী হাসান বলেন, পিরোজপুর জেলার সন্ধ্যা ও কালিগঙ্গা নদীর তীরে যে ভাঙন রয়েছে, তা রোধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। যেগুলো হচ্ছে ইন্দেরহাট-মিয়ারহাট বন্দর, শ্রীরামকাঠি বন্দর, বেকুটিয়া ফেরিঘাট, ইন্দুরকানি শহরসহ টোনা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিরক্ষা কাজ। কিছু কালিগঙ্গা ও কিছু সন্ধ্যা নদীর তীরে অবস্থিত। এগুলো রক্ষায় আমরা ডিপিপি প্রণয়ন করে পানি উন্নয়ন বোর্ডে জমা দিয়েছি। ডিপিপি অনুমোদন প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এটি অনুমোদন হয়ে গেলে আমরা ভাঙন কবলিত এলাকাগুলোতে কাজ শুরু করতে পারব।
সম্পর্কিত বিষয়:
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: