মঙ্গলবার, ২২শে এপ্রিল ২০২৫, ৯ই বৈশাখ ১৪৩২

Shomoy News

Sopno


৩৭ কোটি টাকা খরচ করেও কাটেনি অন্ধকার


প্রকাশিত:
৩০ আগস্ট ২০২৩ ১৯:১৪

আপডেট:
২২ এপ্রিল ২০২৫ ১৬:২২

 ফাইল ছবি

রাজবাড়ীর পাঁচ উপজেলায় ৩৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা ব্যয়ে লাগানো সোলার প্যানেল অর্থাৎ সৌরবাতি এখন পর্যন্ত অব্যবহৃত পড়ে আছে। নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার করায় ও সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে সেগুলো এখন অকেজো হয়ে পড়ে রয়েছে। অধিকাংশ সৌরবাতি নষ্ট হয়ে আছে।

আলো জ্বালানোর জন্য যে প্রকল্পে ব্যয় করা হয়েছে সাড়ে ৩৭ কোটি টাকা, সেই প্রকল্প এখন পড়ে আছে অন্ধকারে। মেরামতের জন্য কোনো ব্যবস্থাও গ্রহণ করছে না সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।

জানা গেছে, জেলার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ গ্রামীণ সড়ক, মোড়, মসজিদ, মন্দির, হাটবাজার, কবরস্থান, বিদ্যালয় প্রাঙ্গণ রাতের বেলায় আলোকিত রাখার জন্য গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্কার (কাবিখা-কাবিটা) ও গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ (টিআর) কর্মসূচির আওতায় ২০১৬-১৭, ২০১৭-১৮, ২০১৮-১৯, ২০১৯-২০ অর্থবছরে জেলার পাঁচ উপজেলায় ৩৭ কোটি ৫০ লাখ ৩৭ হাজার ১২ টাকা ব্যয়ে ৬ হাজার ৮০০টি সৌরবাতি স্থাপন করে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়। প্রতিটি সৌরবাতির জন্য ব্যয় হয় ৫৫ থেকে ৬০ হাজার টাকা।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, চার অর্থবছরে রাজবাড়ী সদর উপজেলায় ১১ কোটি ৮৫ লাখ ৭১ হাজার ৭৩০ টাকা ব্যয়ে ২ হাজার ১৫৫টি সৌরবাতি স্থাপন করা হয়। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৩ কোটি ৭ লাখ ২৩ হাজার ২৩২, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৩ কোটি ২৯ লাখ ২৬ হাজার ৮৮, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ২ কোটি ৮৩ লাখ ৯৯ হাজার ৬৮৩ ও ২০১৯-২০ অর্থবছরে ২ কোটি ৬৫ লাখ ২২ হাজার ৭২৭ টাকা ব্যয় করা হয়।

পাংশা উপজেলায় ৭ কোটি ৭১ লাখ ৪৯ হাজার ২১৭ টাকা ব্যয়ে ১ হাজার ৪০০টি, গোয়ালন্দ উপজেলায় ৭ কোটি ১১ লাখ ৩০ হাজার ৮৯৩ টাকা ব্যয়ে মোট ১ হাজার ২৯৩টি, কালুখালী উপজেলায় ৫ কোটি ২৩ লাখ ৫০ হাজার ৩০৮ টাকা ব্যয়ে ৯৯১টি এবং বালিয়াকান্দি উপজেলায় ৫ কোটি ৫৮ লাখ ৩৪ হাজার ৮৬৪ টাকা ব্যয়ে ১ হাজার ১৫টি সৌরবাতি স্থাপন করা হয়।

সরেজমিনে রাজবাড়ী জেলা শহর ও জেলার বিভিন্ন উপজেলা ঘুরে দেখা গেছে, লোহার খুঁটির ওপর সোলার প্যানেল স্থাপন করা রয়েছে। সোলারের নিচে খুঁটির সঙ্গে লাইট লাগানো। তার নিচে ব্যাটারি। বেশিরভাগ সোলার লাইটগুলো রাতে জ্বলতে দেখা যায়নি। আবার কয়েকটি জ্বললেও অল্প কিছুক্ষণ পর নিভে যেতে দেখা গেছে।

স্থানীয়রা অভিযোগ করে বলেন, কোনো বাতিই তিন বছর জ্বলেনি। অনেক বাতি ছয় মাসের মধ্যে নষ্ট হয়ে গেছে। নষ্ট হওয়া বাতি মেরামত করতে কেউ আসেনি। সরকার গ্রামের উন্নয়নে জন্য খরচ করল ঠিকই কিন্তু তা স্থায়ী হলো না। বাতিগুলো স্থাপনের পর যদি নিয়মিত মেরামত করা হতো এবং কোনো অংশ নষ্ট হলে সেটির পরিবর্তনের ব্যবস্থা থাকত, তাহলে উন্নয়নটা স্থায়ী হতো। আমরাও সুফল পেতাম।

উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয়ের এক প্রকৌশলী নাম প্রকাশ না করে বলেন, ‘যখন সৌরবাতিগুলো লাগানো হয়, তখন বাজার থেকে দ্বিগুণ দামে সেগুলো কেনা হয়। তারপরও বাতিগুলোর লাইট, সোলার ও ব্যাটারি নিম্নমানের ছিল। সরকার-নির্ধারিত ঠিকাদার সেগুলো কিনে স্থাপন করে। জনপ্রতিনিধিরা বাতি স্থাপনের স্থান উল্লেখ করে চাহিদাপত্র দিয়েছে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছে।

তিনি আরও বলেন, প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিস বাতি স্থাপিত হয়েছে কিনা, তা দেখে বিল দিয়েছে। সৌরবাতিগুলো স্থাপনের পর তিন বছর পর্যন্ত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের দেখ ভালো করার কথা ছিল। কিন্তু তারা সেটা করেনি। বাতিগুলো লাগানোর দুই-তিন মাস পর থেকেই অভিযোগ আসতে থাকে। কিন্তু আমাদের কিছু করার ছিল না। নষ্ট হলেও বাতিগুলো আমরা ঠিক করে দিতে পারব না।

রাজবাড়ী জেলা শহরের পাবলিক হেলথ মোড় থেকে হাসপাতাল রোড হয়ে ২ নং রেলগেট পর্যন্ত ৩৬টি সোলার লাইট বসানো হয়েছে।কিন্তু এই ৩৬টির মধ্যে বেশিরভাগই নষ্ট। আবার কয়েকটি জ্বললেও আধা ঘণ্টার বেশি জ্বলে না। তবে লোডশেডিং হলে রাস্তায় ভূতুড়ে পরিবেশ তৈরি হয়।

ভোকেশনাল মোড়ের হোটেল ব্যবসায়ী ইশারত, ফটোকপি ব্যবসায়ী সুজন, হাসপাতাল গেটের ওষুধ ব্যবসায়ী হারুন বলেন, সোলার লাইটগুলো যখন লাগানো হয়েছিলো তখন কয়েকমাস ভালো চলেছে। কিন্তু এখন বাতি জ্বলে না। সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে অকেজো হয়ে গেছে।

বালিয়াকান্দি সদর ইউনিয়নের স্থানীয় বাসিন্দা শহিদুল ইসলাম বলেন, সোলার বাতিগুলো লাগানোর পর আমরা এর সুবিধা পেয়েছিলাম। কিন্তু তা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ছয়মাস পরেই সব সোলার লাইটগুলো নষ্ট হয়ে যায়।

গোয়ালন্দ ছোট ভাকলা ইউনিয়নের ব্যবসায়ী রাজ্জাক ব্যাপারী বলেন, আমাদের এলাকাতেও সৌর বিদ্যুৎ এর বাতি লাগানো হয়েছিল।কিন্তু সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে সেগুলো অকেজো হয়ে গেছে।

পাংশা উপজেলার সরিষা ইউনিয়নের সরিষা বাজারে ২০টির মতো সৌরবাতি রয়েছে। ১৪টি একদম নষ্ট। বাকি ছয়টি আধা ঘণ্টা থেকে এক ঘণ্টা আলো দেওয়ার পর বন্ধ হয়ে যায়। বিদ্যুৎ চলে গেলে বাজারটিতে ভূতুড়ে পরিবেশ তৈরি হয়। ব্যবসায়ীরাও নিরাপত্তাহীনতায় থাকে। লাইটগুলোর সংস্কারের জন্য সরিষা বাজারের ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয়ে যোগাযোগ করা হলেও কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

সরিষা বাজারের ব্যবসায়ী জোসেফ মন্ডল,শাহাবুদ্দিন,একরামুল সহ একাধিক ব্যবসায়ী বলেন, মাস ছয়েক বাতিগুলো ভালো ছিল। ছয় মাস যাওয়ার পর থেকেই নষ্ট হয়ে গেছে। বাতি নষ্ট হওয়ায় বাজার অন্ধকার থাকে ফলে চুরি-ডাকাতি বেড়েছে। বাতি ভালো থাকাকালে বাজার আলোতে পরিপূর্ণ ছিল। এখন লোডশেডিংয়ের সময় ভূতুড়ে পরিবেশ তৈরি হয়েছে। আমরা উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তাকে বিষয়টি জানালেও তারা ব্যবস্থা নেয়নি।

বালিয়াকান্দি উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) নাসরিন সুলতানা ঢাকা পোস্টকে বলেন, সোলার বাতিগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ বা মেরামতের জন্য আমাদের আলাদা কোনো বাজেট নেই। তাই এগুলো আমাদের পক্ষে ঠিক করা সম্ভব না। তবে তিন বছরের মধ্যে নষ্ট হলে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের ঠিক করে দেওয়ার কথা ছিল।

গোয়ালন্দ উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) মো. আবু সাইদ মণ্ডল জানান, স্থাপিত সৌরবাতিগুলোর ওয়ারেন্টির মেয়াদকাল ছিল তিন বছর। বেশ আগেই সৌরবাতি স্থাপনের সময়কাল তিন বছর পেরিয়ে গেছে। এছাড়া চুক্তির মেয়াদের পর সৌরবাতিগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতে জন্য কোনও বরাদ্দ না থাকায় এখন আপাতত কিছুই করা যাচ্ছে না।

বালিয়াকান্দি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘বাতিগুলো উপজেলা শহর ছাড়াও বিভিন্ন ইউনিয়নের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে স্থাপন করা হয়েছিল। কিন্তু অধিকাংশই এখন নষ্ট। তিন বছর পার হয়ে যাওয়ায় উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিস বাতিগুলো আর মেরামত বা সংস্কার করবে না। এজন্য আমরা উপজেলা পরিষদের পক্ষে একটা প্রকল্প নিয়েছি। গুরুত্বপূর্ণ স্থানের বাতিগুলো মেরামত করব। বাতিগুলো ঠিক করা খুব দরকার।

কালুখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শাহ মো. সজীব বলেন, আমার সরকারি বাসভবনের সামনে স্থাপন করা লাইটটিও নষ্ট হয়ে আছে। অধিকাংশ লাইট নষ্ট হয়েছে এটা সত্য। মেরামতের সময়ও পার হয়েছে। উপজেলা চেয়ারম্যানের সঙ্গে সমন্বয় করে দেখি কিছু লাইট মেরামত করা যায় কি না।


সম্পর্কিত বিষয়:


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:




রিসোর্সফুল পল্টন সিটি (১১ তলা) ৫১-৫১/এ, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০।
মোবাইল: ০১৭১১-৯৫০৫৬২, ০১৯১২-১৬৩৮২২
ইমেইল : [email protected]; [email protected]
সম্পাদক : লিটন চৌধুরী

রংধনু মিডিয়া লিমিটেড এর একটি প্রতিষ্ঠান।

Developed with by
Top