না ফেরার দেশে কিংবদন্তি গীতিকার গাজী মাজহারুল ইসলাম
প্রকাশিত:
৫ সেপ্টেম্বর ২০২২ ০০:০০
আপডেট:
১৩ মার্চ ২০২৫ ০৮:৩৫

আকাশে তখনও মেঘের আধিপত্য। নাগরিক কার্ণিশে বসে কোনও পাখি যেন মনে করিয়ে দিচ্ছে, ‘একবার যেতে দে না আমার ছোট্ট সোনার গাঁয়’।
এমন অসংখ্য কালজয়ী গানের স্রষ্টা, গীতিকার, চলচ্চিত্র পরিচালক ও প্রযোজক গাজী মাজহারুল আনোয়ার। তার তুলনা তিনি নিজেই। রোববার (৪ সেপ্টেম্বর) ভোর ৬টার দিকে কিংবদন্তি এই মানুষটির মৃত্যু হয়। তার মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে শোবিজ অঙ্গনে। সকাল থেকেই ফেসবুকে শোকাবহ বার্তা দিয়ে শোক প্রকাশ করেছেন শোবিজের তারকাশিল্পী থেকে শুরু করে ভক্ত-শুভাকাঙ্ক্ষীরা। পুরো নেটদুনিয়া এখন শোকে কাতর।
দেশের সংস্কৃতি অঙ্গনের জন্য এমন সকাল নিঃসন্দেহে অপ্রত্যাশিত, দুঃস্বপ্নের মতো। শরতের এই সিক্ত সকাল সবার মনেই দমকা হাওয়ার মতো শোকের থাবা বসিয়েছে। তাই বিষণ্ণ মনে কিংবদন্তির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন অনেক তারকা।
নন্দিত কণ্ঠশিল্পী কনকচাঁপা শোক প্রকাশ করে লিখেছেন, ‘আমাদের পরম শ্রদ্ধেয় গীতিকবি, চলচ্চিত্র পরিচালক, সাংস্কৃতিক জগতের মহীরুহ গাজী মাজহারুল আনোয়ার আর নেই। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। তার আত্মার মাগফিরাত কামনা করি।’
কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী কুমার বিশ্বজিৎ লিখেছেন, ‘বাংলা গানের কালপুরুষ গাজী মাজহারুল আনোয়ার আর আমাদের মাঝে নেই। এই কিংবদন্তির প্রয়াণে আমরা স্তব্ধ এবং গভীরভাবে শোকাহত। স্রষ্টা যেন শোক সন্তপ্ত পরিবার ও স্বজনদের এই শোক সইবার শক্তি দেন। তার বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি।’
এ সময়ের জনপ্রিয় সংগীত তারকা ইমরান মাহমুদুল লিখেছেন, ‘দেশবরেণ্য কিংবদন্তি গীতিকবি গাজী মাজহারুল আনোয়ার কিছুক্ষণ আগে মৃত্যুবরণ করেছেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়াইন্না ইলাইহি রাজিউন। স্যারের আত্মার শান্তি কামনা করি। মহান আল্লাহ ওনার পরিবারকে এই শোক সইবার শক্তি দিন।’
১৯৪৩ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি কুমিল্লার দাউদকান্দি থানার তালেশ্বর গ্রামে গাজী মাজহারুল আনোয়ারের জন্ম। তিনি মূলত জমিদার বংশের সন্তান। তার দাদা ছিলেন জমিদার। স্বাধীনতা ও দেশপ্রেম নিয়ে অসংখ্য শ্রোতাপ্রিয় গান লিখেছেন তিনি। মাত্র ২১ বছর বয়সেই গাজী মাজহারুল আনোয়ার গীতিকার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।
১৯৬৪ সালে তৎকালীন রেডিও পাকিস্তানে তার লেখা প্রথম গান প্রচার হয়। সেই থেকে এখন পর্যন্ত তার রচিত গানের সংখ্যা ২০ হাজারেরও বেশি। আর তার গানে উঠে এসেছে মুক্তিযুদ্ধ, দেশপ্রেম, প্রকৃতি, জীবনবোধ, প্রেম, বিরহ, স্নেহ ও অনুভূতির কথা।
১৯৬৭ সালে সুভাষ দত্তের ‘আয়না ও অবশিষ্ট’ সিনেমার ‘আকাশের হাতে আছে একরাশ নীল’ গান দিয়ে তার সিনেমায় গান লেখার পথচলা শুরু হয়। সিনেমার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পর থেকেই চিত্রনাট্য, গান, সংলাপ ও কাহিনি রচনা শুরু করেন তিনি। তার পরিচালিত প্রথম সিনেমা ‘নান্টু ঘটক’, যা মুক্তি পায় ১৯৮২ সালে। দীর্ঘ ক্যারিয়ারে ৪১টির মতো সিনেমা পরিচালনায় করেছেন কিংবদন্তি এই তারকা শিল্পী।
গাজী মাজহারুল আনোয়ার ২০০২ সালে একুশে পদক এবং ২০২১ সালে সংস্কৃতিতে স্বাধীনতা পুরস্কার লাভ করেন। স্বাধীনতা যুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য তিনি স্বাধীন দেশের সর্বপ্রথম পুরস্কার বাংলাদেশ প্রেসিডেন্ট গোল্ড মেডেল অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন। পাঁচবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, একাধিকবার বাচসাস পুরস্কার, বিজেএমই অ্যাওয়ার্ডসহ তার অর্জিত পুরস্কারের সংখ্যা ১১০।
শুধু তাই নয়, অসংখ্য কালজয়ী গানের রচয়িতা তিনি এবং গীতিকবি সংঘের আজীবন সদস্য ছিলেন। দীর্ঘ ৬০ বছরের ক্যারিয়ারে ২০ হাজারের বেশি গান রচনা করেছেন। বিবিসি বাংলার জরিপে সর্বকালের সেরা ২০টি বাংলা গানের তালিকায় তার লেখা তিনটি গান রয়েছে।
তার লেখা কালজয়ী কিছু গান হলো- ‘জয় বাংলা, বাংলার জয়’, ‘আছেন আমার মোক্তার আছেন আমার ব্যারিস্টার’, ‘একতারা তুই দেশের কথা বল রে’, ‘একবার যেতে দে না আমার ছোট্ট সোনার গাঁয়’, ‘গানের খাতায় স্বরলিপি লিখে’, ‘আকাশের হাতে আছে একরাশ নীল’, ‘শুধু গান গেয়ে পরিচয়’, ‘ও পাখি তোর যন্ত্রণা’, ‘ইশারায় শীষ দিয়ে’, ‘চোখের নজর এমনি কইরা’, ‘এই মন তোমাকে দিলাম’, ‘চলে আমার সাইকেল হাওয়ার বেগে’ ইত্যাদি।
আর নিজস্ব প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান দেশ চিত্রকথা থেকে তিনি নির্মাণ করেছেন ‘শাস্তি’, ‘স্বাধীন’, ‘শর্ত’, ‘সমর’, ‘শ্রদ্ধা’, ‘ক্ষুধা’, ‘স্নেহ’, ‘তপস্যা’, ‘উল্কা’, ‘আম্মা’, ‘পরাধীন’, ‘আর্তনাদ’, ‘পাষাণের প্রেম’, ‘এই যে দুনিয়া’ নামের সিনেমাগুলো।
সম্পর্কিত বিষয়:
সংগীত
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: