মঙ্গলবার, ১৭ই সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১লা আশ্বিন ১৪৩১


"সেকাল-একাল এর শৈশব ভীতি"


প্রকাশিত:
২০ জুলাই ২০২০ ১৭:৪৪

আপডেট:
২০ জুলাই ২০২০ ১৭:৪৬

সেকাল-
মাহফুজ ভাইয়া ছিলেন আমাদের পরিবারের সুপার হিরো টাইপ মানুষ। ভরসার জায়গা। আমার মায়ের দুরসম্পর্কের মামা। তিনি বাসায় আসলেই তার কাছে আমার দুস্টুমির গল্প বললেই তিনি বলতেন.... ছেলে মানুষ করতে হলে জেল স্কুলে দিয়ে দাও।

একদিন মা তাকে বললেন মামা চলেন একদিন গিয়ে দেখে আসি সবাই মিলে নিয়ম ও জেনে আসবো।

সত্যি সত্যিই একদিন বাবা মা মাহফুজ ভাইয়া আর বড় খালা খালু মিলে বাগেরহাট গেলেন সেখানে কোথাও হয়তো একটা জেল স্কুল ছিল। খালা খালু সেই সফরে যুক্ত হলেন এ কারনেই যে, খালাতো ভাই ছিন্টু ভাইয়াও ছিল খুব ডানপিটে। ছিন্টু আর আমি ২ ভাইকে একসাথে দেয়া হবে সেটাই সিদ্ধান্ত।

১২/১৩ বয়স তখন আমার, ভয়ে জান শুকিয়ে গেল। এবার তো আর রক্ষা নেই।

জেল স্কুল পরিদর্শন শেষে বাসায় ফিরে মায়ের সে কি বর্ননা।

জেল স্কুল মানেই ছোটদের জেলখানা। বিরাট দেয়ালে ঘেরা বিশাল জায়গার ওপরে স্কুল। সেখানে সেল রুমে ঘুমাতে হয়। নিয়ম না মানলেই পায়ে শিকল। কথায় কথায় দড়ি দিয়ে হাত বেধে ঝুলিয়ে বিশেষ কাটাযুক্ত লাঠি দিয়ে পেটানো হয়। একবার ওই স্কুলে দিয়ে আসলে জীবনে আর বের হওয়া যাবেনা, বড় হলে সেখানেই তারা শ্রমিক টাইপ কাজ করায়। বছরে একবার পরিবারের সাথে ১ ঘন্টার জন্য দেখা করতে দেয়া হয়। দিনে ২ বেলা খেতে দেয়া হয় তবে সেটা শুধু ডাল ভাত, সপ্তাহে একদিন মাংশ, একদিন মাছ।

আমি প্রশ্ন করলাম ওরা কি বিয়ে শাদী করতে পারেনা? মা বললেন বিয়ে? এর ভিতরে বিয়েরও স্বপ্ন দেখো? বাহ বাহ।

জেল স্কুলের সবচে ভয়াবহ বিষয় হলো সেখানের একটা সেল রুমে খানজাহান আলী মাজারের দিঘী থেকে অনেক গুলো কুমির রাখা আছে, কাওকে শাস্তি দেবার সময় সব কুমিরের মুখ বিশেষ উপায়ে আটকে রেখে তাকে ওই রুমে ছেড়ে দেয়া হয়, মানুষ সামনে পেয়ে খেতে না পেরে কুমির গুলো পাগলের মতো হয়ে আঁচড় কাটতে থাকে, লেজ দিয়ে পেটাতে থাকে। তারপর আধমরা অবস্থায় সেখান থেকে বের করা হয়। সবচে যেটা নির্মম তা হলো সেই জেল স্কুলে শাস্তি ভোগ করে যদি কেউ মারা যায় তার কোন কৈফিয়ত দিতে হয়না তার কারন প্রতি বাবা মা ছেলেকে ভর্তির করার সময় স্কুল কতৃপক্ষকে বন্ড সই দিয়ে আসে।

আমি খুবই ভয় পেয়ে গেলাম। ঘুম নেই, খাওয়া নেই। কি হবে এই জীবনের?

২ দিন পরে চুপি চুপি টুটপাড়ায় গেলাম ছিন্টু ভাইয়ের সাথে পরামর্শ করতে, ছিন্টু ভাই ছিল অলওয়েজ হট টেম্পারেচার এর উঠতি মাস্তান। তাকে তার আড্ডা থেকে ডেকে এনে ভয়ার্ত গলায় বললাম...

: ভাইয়া আমাদের কি হবে এখন? (ভাইয়া পুরা খুলনার ভাষায় কথা বলতো)

: ওলো কি হবে? আমাগে ওহোনি দিলি আগে যাইয়ে প্রিন্সিপাল রে মারবানি। তোর মারতি হবেনা আমি একা মাইরে শোয়ায়ে ফেলাবানি, শু..... বাচ্চা এই স্কুল বানালি কেন?

: না না ভাইয়া, কুমিরের ঘরে ছাইড়ে দেয় নাকি!

: ওলো তুই থো, মাজায় চাকু নিয়ে ঢুকবানি, কুমিরির পেট দিবানি ফাইড়ে। ওরা ভয়তে আর আমার সামনে আসপে না।

: আমারে যদি কেউ মারে? আমি কি করবানি?

: ওলো আমি আছিনে? তুই আমার ভাই না? শু... বাচ্চাগে গলা কাইটে ফেলায়ে দিবানী। আর বোয়িং মোল্লারে কবানি প্রিন্সিপালরে গালাগালি দিতি।

এতসব সহজ সমাধানে আমি যেন আধারে আশার আলো দেখতে লাগলাম। ছিন্টু ভাইয়ার মুখে কোন ভয়ের লেশ ও নেই, তার ভাবটা ছিল জেল স্কুলতো টুটপাড়ার মধ্যেই।

তারপর ভাইয়া বলতে লাগলেন....

: যদি যাওয়াই লাগে তাহালি আমরা ওই জায়গায় থাকপো নাহি? তোরে ঘাড়ে নিয়ে আমি দেয়াল টপকাইয়ে পলায়ে যাবানি। ওহান তে ঢাকা চইলে যাবানি। আর বাড়ী আসপো না। যে বাপ মা ছুয়াল রে জেল স্কুলি দিতি পারে সেই বাপ মা র মুক ই দ্যাকপো না জীবনে। তুই বাড়ী যা, ভয় পাইসনে। আমি আছি না?

আমি খুব সাহস নিয়ে ফিরে এলাম। তারপরে কয়দিন বাইরে যাই না। বই হাতে নিয়ে ঘুরি। বাসায় যে যা বলে সাথে সাথে শুনি। একদিন মায়ের কাছে গিয়ে অনেক কাঁদলাম। বললাম ভালো হয়ে যাব, পড়াশোনা করবো। মা প্রতিজ্ঞা করালেন। কয়মাস আমি খুবই লক্ষী হয়ে রইলাম অজানা এক ভয়ে।

অনেক বছর পরে ছোটবেলার জেল স্কুলের কথা মনে পড়ায় মায়ের কাছে জানতে চেয়েছিলাম জেল স্কুলের কাহিনী আসলে কি ছিল?

মা খুব হেসেছিলেন। তারা সবাই মিলে বাগেরহাটের কোন এক আত্নীয় বাড়ী বেড়াতে গিয়েছিল। ছোট বেলার সেই ভীতির কথা ভেবে অনেক হেসেছিলাম সেদিন, আজও হাসি।

একাল-
ইয়ানী খুব লক্ষী মেয়ে তবে তার ভেতরে তার বাবার কিছু সমস্যা আছে। নিজের ভেতরে ডুবে থাকা, আশপাশ সব ভুলে কোন কিছুতে মগ্ন থাকা তার অভ্যাস হয়ে যাচ্ছে। এমনিতে সে হেল্পফুল, কোনকিছু করতে বললে সে করে ঠিকই তবে মন থাকে অন্য দিকে।
এসব কারনে সে তার বাবা মায়ের কাছে বকা খায়। তার ভয় পাবার সাবজেক্ট ২টা।

১. ডাইনি বুড়ী
২. বোডিং স্কুল (জেল স্কুলের উন্নত সংস্করন)।

ডাইনী বুড়ী মাঝে মাঝেই দরজার পাশে আসে, ইয়ানী স্কুলে থাকলে সে বাসায় এসে তার বাবা ও মায়ের কাছে ইয়ানীর আপডেট জেনে যায়। আমরা নেগেটিভ রিপোর্ট দিলেই ইয়ানীকে তুলে নিয়ে পাহাড়ের ওপরে তার বাড়ীতে নিয়ে আটকে রাখবে।

বোডিং স্কুলের গল্প কিন্ত একদম বাবার জেল স্কুলের মতো। মাঝে মাঝে ই ২/৩ দিনের ভেতরে বোডিং স্কুল থেকে লোক এসে যেন ইয়ানীকে নিয়ে যায় এবিষয়ে বাবা স্কুলের প্রিন্সিপালকে ফোন করে, বাবা ফোনে কথা বলছে দেখলেই ইয়ানী ভয়ে কাঁদতে থাকে, চোখে রাজ্যের মায়া এনে বাবার দিকে তাকিয়ে থাকে, তার বাবা সেই মায়া দেখে বিমোহিত হয়ে যায়। আচ্ছা ঠিক আছে এবার মাপ করলাম, যা বলবো ঠিক মতো শুনবা তো? ইয়ানী প্রমিজ করে, কয়েকদিন ধরে বাবাকে কনভিন্স করতে গিয়ে বেশী বেশী ম্যাসাজ করে। বাবা কফি খাবে কিনা বার বার জানতে চায়, বাবা আজ কি খাবে সেটা জেনে মা কে জানায় সেটা রান্না করতে। বাবা তার নিজের রুমে গেলে সে লন্ডনে তার প্রিয় খালাতো বোন "কথা" কে ফোন দেয়-

: বুবু জানো? বাবা না আমাকে আজ বোডিং স্কুলে দিতে চেয়েছিল। আমি প্রমিজ করছি আর কান্না করছি বলে ক্যান্সেল করছে। তার বাবা এপাশ থেকে শোনে আর হাসতে থাকে।

গতকাল অনেকদিন পরে আবারো বোডিং স্কুলে দেবার কথা এলো, ইয়ানীর স্টাইলে পরিবর্তন এসেছে।

সে ভয় পেয়েছে তবে কান্না করেনি। সে তার মাকে বোঝালো ফ্যামিলির প্রয়োজনে ওয়ানিইয়ার জন্য তো তার আমাদের সাথে থাকা উচিৎ, কেনো যে- সে না থাকলে ওয়ানিইয়া খুবই কান্না করবে মন খারাপ করবে তার জন্য। এটা তো হতে দেয়া উচিৎ না। তাছাড়া সে যে বাবাকে মাঝে মাঝে কফি বানিয়ে দেয়, পানি এনে দেয়, মায়ের রান্নার সময় এটা ওটা এনে দেয় এসব হেল্পগুলো কে করবে? তাছাড়া সে আমাদের মেয়ে হয়না? সে না থাকলে আমরা ও যে স্যাড থাকবো আর এটা ভেবে সেও তো স্যাড থাকবে।

অনেক যুক্তি দেখিয়ে বাবা ও মা কে সে বুঝিয়েছে বোডিং স্কুলে দেবার সিদ্ধান্তটা সঠিক নয়। তবে সে আর ভুলো মনা থাকবেনা, সব কিছুতে এটেনশন দেবে, ইউটিউবও কম দেখবে। তার বাবা মা আপাতত তার কথায় কনভিন্স হয়ে যায়।

বাবার জীবনে ঘটনা ছিল বেশী তাই বাবার গল্প ও বেশী, ইয়ানীর জীবনে ঘটনা কম বলে তার বাবা ঘটনা তৈরী করে গল্প বানিয়ে দেয়।

জীবনে গল্প থাকা খুব জরুরী।

শৈশবের এসব গল্পই একদিন ইয়ানীকে হাসাবে, বাবা মা তাকে কি বোকাটাই না বানিয়েছে এসব ভেবে।

কি জানি বাবা হয়তো তখন থাকবেনা, কে জানে এসব গল্প ভেবেই বাবার জন্য তার চোখে জল আসবে কিনা!

কি জানি ফিস ফিস করে বলবে কিনা.... বাবা ফিরে এসে আমাকে আর একটু ভয় দিয়ে যাও। আমার শৈশব ফিরিয়ে দিয়ে যাও।

শাহ ইমরান
স্পেন।


সম্পর্কিত বিষয়:

জেল স্কুল

আপনার মূল্যবান মতামত দিন:




রিসোর্সফুল পল্টন সিটি (১১ তলা) ৫১-৫১/এ, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০।
মোবাইল: ০১৭১১-৯৫০৫৬২, ০১৯১২-১৬৩৮২২
ইমেইল : [email protected]; [email protected]
সম্পাদক : লিটন চৌধুরী

রংধনু মিডিয়া লিমিটেড এর একটি প্রতিষ্ঠান।

Developed with by
Top