চকলেট তৈরিতে বিশ্বখ্যাত যেসব দেশ
প্রকাশিত:
৯ জুলাই ২০২৩ ১৯:১৯
আপডেট:
২০ এপ্রিল ২০২৫ ১০:০০

চকলেটের কথা শুনলেই জিভে জল চলে আসে। এ জিনিস খেতে ভালোবাসে না এমন মানুষের সংখ্যা খুবই কম। কিন্তু চকলেটপ্রেমীরা কী এর ইতিহাসটা জানেন? চকোলেট তৈরির ব্যাপারে এক দেশ আরেক দেশকে ছাড়িয়ে যেতে পারে।
চকলেট কথাটা এসেছে মায়া ভাষায় ‘শোকোলাতিল’ শব্দটা থেকে, এটি মায়া সভ্যতার অন্যতম জনপ্রিয় পানীয়। এটি এতটাই জনপ্রিয় ছিল, বড়লোক-গরিব নির্বিশেষে সব অনুষ্ঠানে থাকতোই। কোকোর প্রতি এই প্রেম আজকের নয়।
জানলে অবাক হবেন, কোকোর সঙ্গে লাতিন আমেরিকার সম্পর্ক তিন হাজার বছরের। যিশুখ্রিষ্ট জন্মানোর হাজার বছর আগে দক্ষিণ মেক্সিকোয় থাকত ওল্মেক’রা। তারা কোকোর ভক্ত ছিল। কোকো নামটাও এসেছে ওল্মেক শব্দ ‘কাকাওয়া’ থেকে। আর মায়া সভ্যতার মানুষ যখন লাতিন আমেরিকার উত্তর দিকটায় থাকতে শুরু করে, তারা সঙ্গে কোকো গাছ নিয়ে এসে চাষ শুরু করে।
সেই সময়ে চিনির ব্যবহার মায়াদের অজানা ছিল, তাই চকোলেট বানানোর প্রক্রিয়া ছিল একদমই আলাদা। কোকো শুকিয়ে গুঁড়ো করে মরিচের গুঁড়ার সঙ্গে মিশিয়ে একটা পেস্ট বানানো হতো, তা মেশানো হতো গরম পানিতে। দক্ষিণ ভারতীয় কফির মতো করে ঢালা-উপুড় করা হতো বারবার, যতক্ষণ না এক রাশ ফেনা জমে ওঠে। এই ফেনাসহ গরম চকলেট মাটির পাত্রে পরিবেশন করে সম্মান দেখানো হতো। এরপর বিভিন্ন সভ্যতায় কোকোর চাহিদা বাড়ে। চকলেট তৈরির পদ্ধতিতেও নানা বদল আসে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশ চকোলেট তৈরি করে। এক্ষেত্রে কয়েকটি দেশের নাম আগে আসবে, চকলেট তৈরিতে এবং তার স্বাদের বাহারে যারা ইতিহাস তৈরি করেছে।
বেলজিয়ান চকলেট
১৬৯৭ সালের কথা। বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসের রাজকীয় প্রাসাদ ভ্রমণ করতে এসেছেন সুইজারল্যান্ডের রাজধানী জুরিখের মেয়র তথা প্রধান প্রশাসনিক ব্যক্তি হেনরি এসচার। তিনি ঘুরে দেখলেন পুরো প্রাসাদ। তাকে সঙ্গ দিল বেলজিয়ান রাজপরিবারের সদস্যরা। এরপর শুরু হলো ভোজনপর্ব। বিভিন্ন পদের খাবারের পর একটি পেয়ালায় দেওয়া হলো গরম চকলেট, যা ছিল তৎকালীন বেলজিয়ামের সবচেয়ে দামি খাবারগুলোর একটি। পেয়ালায় চুমুক দেওয়ার পর বেলজিয়ান চকলেটের স্বাদে অভিভূত হয়ে গেলেন মেয়র।
বলা হয়ে থাকে, ইউরোপকে চকলেট খেতে শিখিয়েছে বেলজিয়ানরা। কঙ্গো থেকে যখন জাহাজে করে বিশাল পরিমাণ কোকোয়া বীজ আনা হচ্ছিল বেলজিয়ামে তখনো সুইজারল্যান্ড ছাড়া ইউরোপের অন্য কোনো দেশ চকোলেটের স্বাদ পায়নি। ইউরোপের চকোলেট উৎপাদনকারী দেশগুলোর মধ্যে বেলজিয়াম সর্বপ্রথম এমন যন্ত্র তৈরি করেছিল, যেখানে কোকো বীজ খুব মিহি করে গুঁড়ো করা যেত। চকোলেট তৈরির এই পদ্ধতি বেলজিয়ামই প্রথম শিখিয়েছিল। ১৯১২ সালে বেলজিয়াম তার চকোলেট তৈরির পদ্ধতিতেও বদল আনে। রাজধানী ব্রাসেলসে জিন নিউহাউস নামের একজন চকলেট ব্যবসায়ী এমন এক কৌশল আবিষ্কার করেন, যার মাধ্যমে একটি চকলেটের ভেতরে ফাঁকা জায়গা রেখে সেই জায়গায় বিভিন্ন উপাদান যুক্ত করা যেত। এ ধরনের চকলেটকে বলা হতো ‘প্র্যালাইন্স’। এভাবে নানা ফ্লেভারের চকলেট তৈরির পদ্ধতি আবিষ্কার করে বেলজিয়াম। এই দেশে ঘুরতে গেলে পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ থাকে চকলেট ফ্যাক্টরিগুলো ঘুরে দেখা এবং বিভিন্ন ব্র্যান্ডের চকলেট কিনে খাওয়া। নির্ভানা, গোদিভা, নেউহাস, ফ্লোরেন সবচেয়ে জনপ্রিয় বেলজিয়ান চকলেট ব্র্যান্ড।
সুইস চকলেট
বেলজিয়ামের মতো সুইস চকলেটের ব্র্যান্ডগুলোও বেশ জনপ্রিয়। জুরিখকে দেশের চকলেট রাজধানী বলা হয়। কনফিসারি হোনল্ড, ল্যাডেরাক, টিউশার ইত্যাদি চকলেট ফ্যাক্টরিগুলো দেখার মতোই বটে। সুইজারল্যান্ডের কিলচবার্গে আছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় চকলেট মিউজিয়াম। এখানে জানা যাবে চকলেটের ইতিহাস, কীভাবে চকলেট তৈরি করা হয় ইত্যাদি নানা বিষয়ে। মিউজিয়ামে চকলেট শপ আছে, যেখানে নিজের পছন্দমতো চকলেট বানিয়ে নেওয়া যাবে।
মিউজিয়াম মানেই জানা-অজানা নানা তথ্যের সংগ্রহশালা। এরই সঙ্গে থাকে এসব তথ্য প্রকাশের জন্য দৃষ্টিনন্দন নানা বিষয়। ‘লিন্ডট হোম অব চকলেট’ও এর ব্যতিক্রম নয়। দর্শকদের আকর্ষণ করার জন্য ৬৫ হাজার বর্গফুটের এই চকোলেটের মিউজিয়ামের একদম মাঝে আছে ৩০ ফুট লম্বা একটি চকলেটের ঝরনা। এই ঝরনার উপরে সোনালি রঙের হুইস্কটি এমনভাবে ধরা আছে, যেন মনে হবে সেখান থেকে চকোলেট গড়িয়ে পড়ছে। এই ঝরনায় প্রায় ১৫০০ লিটার লিকুইড চকোলেট আছে। প্রতি সেকেন্ডে চকলেটের ঝরনার ভেতর ৩০৮ ফুটের পাইপের মধ্য দিয়ে ২.২ পাউন্ড লিকুইড চকোলেট প্রবাহিত হয়। ঝরনার ওজন প্রায় তিন টন।
প্যারিসের চকলেট যেন স্বপ্ন
বলা হয় যে, ফরাসিরা বছরে ৬-৮ কেজি চকোলেট খায়। তাই রাজধানীতে যেদিকে চাইবেন নামিদামি চকলেটের দোকান নজরে আসবে। প্যারিস তার বেকারির পাশাপাশি চকলেটের জন্য বিখ্যাত। প্যারিসে গেলেও সেখানকার চকলেট মিউজিয়াম মুগ্ধ করবে। লা মেসন ডু চকোলেট, পিয়ের হার্মে এবং জ্যাক জেনিন বিখ্যাত চকলেট নির্মাতা প্রতিষ্ঠান। অক্টোবরের শেষের দিকে প্যারিস সেলুন ডু চকলেট (প্যারিস চকোলেট শো)-এর আয়োজন করে, যা পর্যটকদের অন্যতম সেরা আকর্ষণের জায়গা।
পেরুর চকলেট
মনে করা হয় চকলেট আবিষ্কারের ইতিহাসের সঙ্গে দক্ষিণ আমেরিকা অনেকটাই জড়িত। লিমার চকো মিউজিয়ামে সেই ইতিহাসের অনেকটাই জানা যায়। তাছাড়া সেখানে চকলেট-বিশেষজ্ঞরা শেখান কীভাবে বাড়িতেই চকলেট তৈরি করা যায়। পেরুতে গেলে সেখানকার চকলেট তৈরির ফ্যাক্টরিগুলো দেখতেই হবে।
রোসেলেন চকোলেটিয়ার, ক্যাকাওসুয়ো, হেলেনা চকোলেটিয়ার ইত্যাদি নামি ব্র্যান্ডগুলো সাদরে আপ্যায়ন করবে আপনাকে। বিনামূল্যে সব ঘুরিয়ে দেখাবে এবং উপহার হিসেবে আপনাকে চকলেটও দেবে।
চকলেটে ইতালীয় স্বাদ অনবদ্য
নিউটেলা প্রথম ১৯৪৬ সালে পিয়েত্রো ফেরেরো নামে একজন ইতালীয় শেফ তৈরি করেছিলেন তুরিনে। সেই সময় তুরিন ছিল চকলেটের স্বপ্নরাজ্য। নানা রকম স্বাদ ও গন্ধের চকলেট তৈরি হয়েছে তুরিনে। ইতালির চকলেটের স্বাদ চাখতে হলে ক্যাফারেল, গুইডো কাস্টাগনা, পেইরানো, বারাত্তি এসব নামি ব্র্যান্ডের চকলেট খেতেই হবে। প্রতি বছর ইতালির পেরুগিয়ায় ইউরো-চকলেট উৎসব হয়। এটি ইউরোপের বৃহত্তম চকলেট উৎসবগুলোর মধ্যে একটি। ৯ দিন ধরে চলা উৎসবে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে চকলেট-প্রেমীদের আগমন হয়। চকলেটের যত ধরন আছে, তার সবই পাওয়া যাবে এই উৎসবে।
সম্পর্কিত বিষয়:
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: