ঢাকা-ইসলামাবাদ সম্পর্ক: জটিল কূটনীতির নতুন সমীকরণ
প্রকাশিত:
১৬ এপ্রিল ২০২৫ ১৩:৪৫
আপডেট:
১৬ এপ্রিল ২০২৫ ১৮:১৪

দীর্ঘ পাঁচ দশকের বেশি সময় পর বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক নতুন মোড় নিচ্ছে। দুই দেশের মধ্যে চলমান শীতল সম্পর্ক কিছুটা উষ্ণতা পাচ্ছে। প্রায় ডিপ ফ্রিজে থাকা এই সম্পর্ক এখন ধীরে ধীরে সচল হচ্ছে। শুধু সচলই নয়—প্রকাশ পাচ্ছে সম্পর্ক জোরদারের ইঙ্গিতও।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে— চলতি এপ্রিল মাসে পাকিস্তানের উপ-প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার ঢাকা সফরে আসছেন। একই মাসে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে দুই দেশের মধ্যে ষষ্ঠ ফরেন অফিস কনসালটেশন (এফওসি)। সর্বশেষ এ ধরনের সংলাপ হয়েছিল ২০১০ সালে ইসলামাবাদে। প্রায় ১৪ বছর পর এই বৈঠক হতে যাচ্ছে ঢাকায়, যা সম্পর্ক উন্নয়নে বড় পদক্ষেপ হিসেবে ধরা হচ্ছে।
এই সংলাপে অংশ নিচ্ছেন পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিব আমেনা বালুচ। তারই ধারাবাহিকতায়, আজ বুধবার (১৬ এপ্রিল) ঢাকায় আসছেন তিনি। আগামীকাল বৃহস্পতিবার (১৭ এপ্রিল) ঢাকায় অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে দু’দেশের পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের পররাষ্ট্র দফতর পরামর্শ বা এফওসি বৈঠক। এতে আলোচনার মূল বিষয় হবে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে সহযোগিতা বাড়ানো। ধারণা করা হচ্ছে— আলোচনায় যৌথ কমিশন পুনরায় চালুর বিষয়টি পাকিস্তানের পক্ষ থেকে প্রস্তাব আকারে আসতে পারে।
অন্যদিকে, সাম্প্রতিক সময়ের কিছু কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক অগ্রগতি এই সম্পর্ক উন্নয়নের আভাস দিচ্ছে। গত বছরের নভেম্বর মাসে করাচি থেকে সরাসরি একটি কন্টেইনারবাহী জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে এসে পৌঁছায়। এর আগে, এমন ঘটনা ঘটেনি। পাশাপাশি, সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত বিদেশি নাগরিকদের জন্য ভিসা প্রক্রিয়া সহজ করেছে। এর বিপরীতে পাকিস্তানও বাংলাদেশিদের জন্য ভিসা ফি বাতিল করেছে।
বিশ্লেষকদের মতে— এই পরিবর্তনের পেছনে রয়েছে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক বাস্তবতা। ২০২৪ সালের আগস্টে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে অভিনন্দন জানান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরীফ। এরপর নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘ অধিবেশনের ফাঁকে তাদের মধ্যে একটি বৈঠকও হয়। যা অনেকের কাছে একটি কূটনৈতিক বার্তা হিসেবে ধরা পড়ে।
পাকিস্তানের পক্ষ থেকে পরপর একাধিক প্রতিনিধি দলও ঢাকা সফর করেছে। এর মধ্যে ছিল উচ্চপর্যায়ের কূটনীতিক ইমরান আহমেদ সিদ্দিকী, যিনি এক সময় ঢাকায় পাকিস্তানের হাইকমিশনার হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। ওই সফরে তিনি পররাষ্ট্র সচিব মো. জসীম উদ্দিনের সঙ্গে বৈঠক করেন এবং পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর একটি চিঠি হস্তান্তর করেন। বৈঠকে যৌথ অর্থনৈতিক কমিশনের সভা পুনরায় আয়োজনের ওপর জোর দেওয়া হয়।
সবশেষ, বাংলাদেশের একজন শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা জেনারেল এসএম কামরুল হাসান সম্প্রতি ইসলামাবাদ সফর করেন এবং পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল অসিম মুনিরের সঙ্গে বৈঠক করেন। এটিও ছিল দুই দেশের সামরিক কূটনীতিতে এক নতুন দৃষ্টান্ত। যদিও, অতীতে বিভিন্ন সময়, বাংলাদেশ-পাকিস্তান উভয়ই দেশই— জাতীয় সংকটে একে অপরের পাশে দাঁড়িয়েছে।
অবশ্য, সম্পর্ক উন্নয়নের এই পথে এখনো রয়ে গেছে কিছু দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত ইস্যু। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো— ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গণহত্যা। এখনো বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে পাকিস্তানের আনুষ্ঠানিক ক্ষমা চাওয়ার দাবি রয়েছে। যদিও পাকিস্তান বহুবার বিষয়টি এড়িয়ে গেছে, তবে ১৯৭৪ সালের লাহোর চুক্তিতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো বাংলাদেশের জনগণের প্রতি অনুশোচনা প্রকাশ করেছিলেন।
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ মনে করেন, দুই দেশের সম্পর্কের উন্নয়নের জন্য অতীতের অনেক বিষয়কে নিয়ে সামনে এগোনো দরকার। তার মতে— ১৯৭১ সালের ক্ষত ভুলে সামনে তাকাতে হলে উভয়পক্ষের সদিচ্ছা থাকা জরুরি।
এদিকে কিছু পর্যবেক্ষক মনে করছেন, বাংলাদেশের নতুন কূটনৈতিক তৎপরতায় ভারতের ভূমিকা নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে আলোচনার ঝড় উঠেছে। ভারতের কিছু গণমাধ্যমে প্রশ্ন উঠেছে, বাংলাদেশ কি পাকিস্তান বা আফগানিস্তানের মতো পথে হাঁটছে? বিষয়টি স্পর্শকাতর হলেও বাংলাদেশের বর্তমান সরকার এখন ভারসাম্যপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতির দিকে এগোচ্ছে বলেই মনে করছেন অনেকে।
বাংলাদেশ সম্প্রতি চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে (বিআরআই) অংশগ্রহণে আগ্রহ দেখিয়েছে, যা পাকিস্তান ও চীনের সঙ্গে একটি ত্রিপাক্ষিক কৌশলগত অংশীদারিত্ব গড়ে তুলতে পারে।
বাণিজ্যিক দিক থেকেও বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্কের সম্ভাবনা উজ্জ্বল। বর্তমানে দুই দেশের বছরে মাত্র ৭০০ মিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য হয়। কিন্তু নিক্কেই এশিয়ার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাণিজ্যিক বাধা কমানো গেলে এই অঙ্ক দ্রুত ৩ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে। এ জন্য সরাসরি বিমান চলাচল, চট্টগ্রাম-করাচি সমুদ্রপথ খুলে দেওয়া, এবং মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরের বিষয়গুলো আলোচনায় আসতে পারে।
কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে— দীর্ঘদিনের জটিলতা ও ইতিহাসের ভার পেছনে রেখে, ঢাকা-ইসলামাবাদ নতুন বাস্তবতায় একে অপরের দিকে এগিয়ে আসছে। তবে এই সম্পর্ক কতদূর গড়াবে, তা নির্ভর করবে উভয় দেশের রাজনৈতিক সদিচ্ছা, পারস্পরিক আস্থা এবং অতীতের সমস্যা সমাধানে তারা কতটা আন্তরিক—তার ওপর।
সম্পর্কিত বিষয়:
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: