এক কালের কলেজ বন্ধু শামীম হঠাত সেদিন বললে-
তুলিকে তোর মনে পড়ে?
সে বললে,হয়তো শুনে অবাক হবি
তুলি এ শহরেই বদলী হয়ে এসেছে।
হঠাত জীবন গ্রন্থের পাতাগুলো
উল্টে গেল পিছনের দিকে।
দীর্ঘ ত্রিশটি বছর উতরে গিয়ে হঠাত থমকে দাড়ালো
বসন্তের গন্ধে ভরা পুষ্প রঙিন একটি পাতায়।
মনশ্চক্ষে ভেসে উঠলো বনানীর শ্যামলীমা মাখা
তারুণ্যে সতেজ এক তন্বীর ছবি।
দৃষ্টিতে তার সাগরের গভীরতা
দূর্প্রতিরোধ্য এক আকর্ষণ।
ঘনকৃষ্ণ কেশপাশে আনিতস্বলম্বিত বেণী।
কুন্দশুভ্র দন্ত বিকশিত সারল্য সুন্দর হাসি।
ওদের বাড়িতে থেকেই পড়তাম,পড়াতে হোত ওকেও।
আলাপে থাকতোনা কোন প্রেমালাপের গন্ধ, আচরণে থাকতোনা কোন অসাধারণ উচ্ছাস,
থাকতো শুধু তলহীন গভীর এক স্নিগ্ধ আন্তরিকতা।
অথচ অনুভব করতাম উভয়ের হ্রদয়াংগনে
উভয়ের নিঃশব্দ সাগ্রহ সংগোপন পদচারনা।
অনুচ্চারিত আগ্রহে উভয়েই চাইতাম
সাহচর্য্যের মধু মূহুর্তের দীর্ঘায়ন।
হ্রদের নির্যাস ঢালা সেবায়
সে আপ্লুত করতো আমাকে।
কোন সন্ধ্যায় ফিরতে দেরী হলে, নৈশ আহার টেবিলে সাজিয়ে নিয়ে, অনলস তন্দ্রাহীন বসে থাকতো আমার প্রতিক্ষায়, অকুন্ঠিতা নিবেদিতার মতো।
তারপর সময়ের স্বাভাবিক আবর্তনে একদিন
ঘনিয়ে এলো বিদায়ের ক্ষণ।
নির্জন নিভৃত এক গৃহের কোনে, বেদনা রাঙা নয়নের তীরে
ঘনালো তপ্ত অশ্রুর রেখা।
তার পুষ্পপেলব দুটি কর মোর মুষ্ঠিতলে ধরি
কম্প্রকন্ঠে উচ্চারিলাম, ভুলিব না, ভুলিব না।
তারপর দুপ্রতিরোধ্য কালস্রোতে
ভেসে গেলাম দুদিকে দুজন।
প্রতিশ্রুতির বাণী সব ডুবে গেল বিস্মৃতির তলে।
একদিন জানলাম মাতৃহীনা তুলি
পংগু পিতার সংসার চালাতে,
বাধ্য হয়েছে চাকরী নিতে।
এক সহকর্মীর সাথে বেঁধেছে ঘর।
আকন্ঠ ডুবে গেছে স্বামীর ভালবাসায়।
সোহাগী স্বামীর অংকলগ্না হয়ে দেখছে সোনালী স্বপন।
সহস্র আবর্তে দোলা সংসারের তীরে গড়ছে শান্তির নীড়।
সময়ের ব্যবধান রেখে রেখে
আবির্ভাব ঘটছে একাধিক মানব শিশুর।
তারপর একদিন জানলাম
তার সে সুখ নিরবচ্ছিন্ন হয়নি।
শান্তির আকাশ থেকে নক্ষত্রের পতনের মতো,
স্বামী তার হারিয়ে গেছে চির অন্ধকারের আড়ালে।
আমিও বাস্তবতার অমোঘ আহবানে,
একটি নারীর হাত ধরে
ধূলি ধূসর পৃথিবীর বুকে
দুঃখ সুখের দোলায় দুলে
পৌছে গেছি রুক্ষ ত্বক শুষ্কপর্ণ পৌঢ়ত্বের দ্বারে।
পরদিন অনেক ভেবে,
শামীমের কাছ থেকে পাওয়া ঠিকানায়,
শ্লথ করে বসিয়ে দিলাম
দূরালাপনীর নিদির্ষট সংখ্যাগুলো।
অপর প্রান্তে নারী কন্ঠে ধ্বনিত হল 'হ্যালো কে?'
নির্ভয়ে উত্তরিলাম, আমি শাওন, তোমার পনেরপূর্তি পদ্মপত্রে প্রথম পড়েছিল যার পদরেণু।
প্রত্যুত্তরে ধ্বনিত হলো,
"বাসায় বেড়াতে এলে খুশি হবো খুব"
নিদির্ষট দিনে নিদির্ষট সময়ে,
নিদির্ষট বাসার রুদ্ধদ্বারে কলিং বেল টিপতেই,
দ্বার খুলে অভ্যর্থনা জানালো,
কুঞ্চিত চর্ম পক্ককেশ এক মহিলা,
সুপরিচিত কন্ঠস্বর ঘুচিয়ে দিল
চেহারার পরিবর্তনের দুর্বোধ্যতাকে।
সেই-ই তুলি।
পরিচিত মিষ্টি হাসির আবরণে বললে-
"আপনিও বুড়িয়ে গেছেন দেখি।"
বললাম, সৃষ্টির অমোঘ নিয়মে
এমনি করেই সবুজ পল্লব পরিনত হয় শুষ্ক পর্ণে।
পরিনতির এই মহাস্রোতকে এড়িয়ে যাওয়ার সাধ্য সৃষ্টির নাই।
অনুভব করলাম বাসায় তুলি একাই।
বুঝলাম না একি স্বাভাবিক নাকি আয়োজিত।
তাকে অনুসরণ করে ঘর পেরিয়ে
চলে গেলাম দক্ষিণমূখী একটি চিলতে বারান্দায়।
দুটি আসনে পাশাপাশি বসলাম দুজনে।
কিছুক্ষণ নীরবতা।
তারপর সূত্রহীন ইতিহাসের রোমন্থন।
এক পর্যায়ে অনুভব করলাম,
পাশাপাশি রাখা চেয়ারের হাতলে
দুজনার দুটি হাত নিশ্ছিদ্র ঘনিষ্ঠ হয়ে আছে।
বললাম, কৈশোর, যৌবন, পৌঢ়ত্বের গতি ধারায়
পেরিয়ে আসা স্তরগুলো
অপসৃত হয়না মানুষের হ্রদয় থেকে কোনদিন।
বাইরের পরিবর্তনের অন্তরালে।
চির সবুজ সে,থেকে যায় চির অপরিবর্তনীয়।
লক্ষ্য করো আজ এই অনির্বচনীয় দুর্লভ মুহুর্তে,
আমাদের কুঞ্চিত ত্বক কেমন মসৃন হয়ে উঠছে,
আমাদের পক্ককেশ কেমন ফুরফুরে উড়ছে।
আমরা এখন কিশোর-কিশোরী তরুণ-তরুণী,
আমাদের সমস্ত সত্তায় এখন মাধূর্য্য,
শুধু মাধূর্য্য, শুধু মাধূর্য্য,
শান'ত পুলকে প্রাণের স্পন্দন।