1324

04/16/2024 এজিবি কলোনি কাঁচাবাজার মার্কেট নামেই মুক্তিযোদ্ধাদের

এজিবি কলোনি কাঁচাবাজার মার্কেট নামেই মুক্তিযোদ্ধাদের

দেলোয়ার মহিন

২৬ আগস্ট ২০২০ ১৬:২০

কাগজে-কলমে বরাদ্দ ১৩৪ জন অস্বচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবারের নামে, মালিকানায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন। অথচ প্রায় পুরোটাই দখল করে আছেন ওয়ার্ড কাউন্সিলর, স্থানীয় আওয়ামীলীগ ও যুবলীগ নেতারা। রাজধানীর মতিঝিলস্থ এজিবি কলোনী কাঁচা বাজার মার্কেটের বর্তমান চালচিত্র এটি।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি) সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯ সালের ১৩ জানুয়ারি ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন অঞ্চল-২ (খিলগাঁও) এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. হারুনূর রশীদ স্বাক্ষরিত এক পত্রে অস্বচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা পরিবার কল্যাণ বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেডের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হাজী মো. এমদাদুল হককে এজিবি কলোনী কাঁচা বাজারের দক্ষিণ দিকে রাস্তার উভয় পার্শ্বে অস্থায়ী টিনসেড দোকান নির্মাণের অস্থায়ী অনুমতি দেয়া হয়। একইসাথে দোকান নির্মাণে ডিএসসিসির পক্ষ থেকে বেশকিছু শর্ত দেয়া হয়, যার মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য- নির্মিতব্য দোকানের মালিকানা যথারীতি ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের বহাল থাকবে। উক্ত মার্কেট/দোকানগুলো সমিতি/সদস্যদের নিজ খরচে নির্মাণ করতে হবে। ডিএসসিসির তহবিল হতে কোন ব্যয় মেটানো হবে না, ইত্যাদি ইত্যাদি।

সূত্র মতে, এজিবি কলোনী কাঁচাবাজার মার্কেটে দোকান নির্মাণ ও বরাদ্দ নিয়ে ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে ডিএসসিসির চাকরিচ্যুত অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. আসাদুজ্জামান, চাকরিচ্যুত প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা ইউসুফ আলী সরদার, রাজস্ব কর্মকর্তা দেওয়ান আলীম আল রাজী, অঞ্চল-২ (খিলগাঁও) এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. হারুনূর রশীদের সঙ্গে ১০নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও স্থানীয় আওয়ামীলীগ-যুবলীগ নেতাকর্মীদের মাঝে মোটা অঙ্কের লেনদেন হয়েছে। যে কারণে কাগজে-কলমে ১৩৪ জন মুক্তিযোদ্ধার নামে মার্কেটের দোকান বরাদ্দ হলেও বাস্তবে চিত্র ভিন্ন।

প্রসঙ্গত, গত ১৬ মে শনিবার ডিএসসিসির দায়িত্ব বুঝে নেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের নতুন মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস। দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থানের ঘোষণা দিয়ে দায়িত্ব প্রহণের পর অফিসের প্রথম দিনেই দুর্নীতি ও কমিশন বাণিজ্যসহ নানা অভিযোগে ডিএসসিসির অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. আসাদুজ্জামান ও প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা ইউসুফ আলী সরদারকে চাকরিচ্যুত করেন তিনি। এর কিছুদিন পর ডিএসিসসির জনসংযোগ কর্মকর্তা উত্তম কুমার রায়কে ওএসডি করা হয়। অসদাচরণ এবং আত্মসাৎ, তহবিল তছরুফ ও প্রতারণার অভিযোগে সম্পত্তি বিভাগের অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর মো. ইশহাককে সাময়িক বরখাস্ত করার পাশাপাশি তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করার সিদ্ধান্ত হয়। রাজস্ব বিভাগের ‘বাজার সার্কেল-৩’ এর কর্মকর্তা আতাহার আলী খানকেও দায়িত্ব থেকে অপসারণ করা হয়। সরকারের সম্পদ নষ্টের অভিযোগে চাকরিচ্যুত করা হয় করপোরেশনের মশক শ্রমিক রাজন দাসকে। এছাড়াও অঞ্চল-২ এর সুপারভাইজার মনিরুজ্জামানকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়।

দুর্নীতির বিরুদ্ধে মেয়র তাপসের এমন অবস্থান এবং কঠোর পদক্ষেপের প্রসংশা করে অস্বচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এজিবি কলোনী কাঁচাবাজার মার্কেটের দোকান বরাদ্দ তালিকায় কারা আছেন এবং বর্তমানে দোকানগুলোর দখলে কারা? মেয়র মহোদয় একটু সুনজর দিলেই প্রকৃত সত্য বেরিয়ে আসবে।

সরেজমিনে এজিবি কলোনী কাঁচাবাজার মার্কেটের ব্যবসায়িদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মার্কেটে নামকাওয়াস্তে দু-চারজন জন মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবার দোকানের বরাদ্দ পেয়েছেন। সিংহভাগই নামে-বেনামে বাগিয়ে নিয়েছেন এজিবি কলোনী কাঁচাবাজার মার্কেট কমিটির সভাপতি মঞ্জুরুল হক, সাধারণ সম্পাদক জান মোহাম্মদ, এজিবি কলোনী কাঁচাবাজার সমবায় সমিতির সভাপতি জাহিদুল ইসলাম টিপু, সাধারণ সম্পাদক আলমগীর হোসেন, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের বহিস্কৃত সভাপতি ইসমাইল চৌধুরী স¤্রাট, ১০ নং ওয়ার্ড আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক ওমর ফারক, মতিঝিল থানা আওয়ামীলীগের সভাপতি বাসিরুল আলম খান বাবুলসহ স্থানীয় আওয়ামীলীগ ও যুবলীগ নেতাকর্মীরা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে মার্কেটের এক হোটেল ব্যবসায়ি বলেন, ‘তিনি যে দোকানটিতে ব্যবসা করছেন, সেটির মালিক এজিবি কলোনী কাঁচাবাজার মার্কেট কমিটির সাধারণ সম্পাদক জান মোহাম্মদ। দোকানের অগ্রীমবাবদ জান মোহাম্মদকে এককালিন ২ লাখ টাকা দিয়েছেন তিনি, যার কোন চুক্তিপত্র নাই। কোন ডকুমেন্ট ছাড়া কেন দুই লাখ টাকা দিলেন- এমন প্রশ্নে ওই হোটেল ব্যবসায়ি বলেন, কি করুম? আমি না দিলে আরেকজন দিব। মার্কেটে জান মোহাম্মদের আরও ১২টি দোকান আছে বলেও জানান তিনি।

বরাদ্দ প্রসঙ্গে এজিবি কলোনী কাঁচাবাজার মার্কেট কমিটির সভাপতি মঞ্জরুল হক বলেন, এই বিষয়ে কোন মন্তব্য চলবে না। সকল তথ্য-কথা ভিত্তিহীন। পরবর্তিতে মার্কেট কমিটির সাধারণ সম্পাদক জান মোহাম্মদ মুঠোফোনে এ প্রতিবেদককে জানান, ‘বরাদ্দকৃত দোকানগুলো নিয়ে কিছু অনিয়ম ও ঝামেলার কারণে আমি এ কমিটি থেকে দূরে সরে ছিলাম অনেকদিন। তবে চলতি বছর আবার কমিটির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছি। এখানে একটু ঝামেলা আছে, তা আমরাও জানি। এ বিষয়ে সরাসরি কথা বলবো। আমাকে একটু আপনার সাথে দেখা করার সুযোগ দেন।’

মার্কেটের মুরগী ব্যবসায়ি রফিক (ছদ্দনাম) জানান, দোকানগুলোর মালিক কোন অস্বচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা কিংবা তাদের পরিবারের কোন সদস্য নন। এজিবি কলোনী কাঁচাবাজার মার্কেট কমিটির সভাপতি মঞ্জুরুল হকের দোকান রয়েছে ২০টির মতো। এজিবি কলোনী কাঁচাবাজার সমবায় সমিতির সভাপতি জাহিদুল ইসলাম টিপু, সাধারণ সম্পাদক আলমগীর হোসেনের দোকান আছে ২৫টির মতো। যুবলীগের সাবেক সভাপতি ইসমাইল চৌধুরী স¤্রাটের দখলে আছে প্রায় ৩০টি দোকান। স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর মারুফ আহমেদ মনসুর, ১০নং ওয়ার্ড আওয়ামীলীগের সভাপতি (৩বার নির্বাচিত) নওশের আলী, সাধারণ সম্পাদক ওমর ফারকেরও মার্কেটে একাধিক দোকান রয়েছে বলে জানান রফিক। জাহিদুল ইসলাম টিপু ও আলমগীর হোসেন দোকানপ্রতি ২লাখ টাকা অগ্রীম নিয়ে অর্ধেকেরও বেশি ভাড়া দিয়েছেন। তারা এককালিন ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা দরে দোকানের পজিশন বিক্রি করেছেন বলেও জানান মার্কেটের মুরগী ব্যবসায়ি রফিক। তবে ভাড়া কিংবা বিক্রি কোনটারই ডিড কিংবা দলিল করে দিচ্ছেন না কেউই।

এ বিষয়ে জাহিদুল ইসলাম টিপু বলেন, মার্কেটে মোট ১৩৪টি দোকান, যার সবকটিই অস্বচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবারের সদস্যদের নামে বরাদ্দকৃত। ১৩৪ জন মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবারের সদস্যরা দোকানগুলো বুঝেও নিয়েছেন এবং মূলত তারাই দোকানগুলোর মালিক। কোন কোন মুক্তিযোদ্ধা কিংবা তাদের পরিবার দোকানের বরাদ্দ পেয়েছেন- এমন প্রশ্নে জাহিদুল বলেন, এই তালিকা আমাদের কাছে নাই। যার যার তালিকা তার তার কাছে। মার্কেটে তার নামে একটিও দোকান নাই বলে দাবি করেন তিনি।

তবে মার্কেটে নিজের নামে একাধিক দোকান রয়েছে স্বীকার করে আলমগীর হোসেন সময়কে বলেন, মার্কেটের প্রতিটা দোকানের আলাদা আলাদা মালিক এবং আলাদা করে বরাদ্দপ্রাপ্ত। তবে দোকানগুলোর প্রকৃত মালিকানায় কারা- প্রশ্ন করা হলে বিষয়টি এড়িয়ে যান তিনি।

এজিবি কলোনী কাঁচাবাজার মার্কেটে দোকান বরাদ্দে অনিয়মের সঙ্গে নিজের জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের রাজস্ব কর্মকর্তা দেওয়ান আলীম আল রাজী মুঠোফোনে এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘কাঁচাবাজার মার্কেটের দোকান বরাদ্দে কিছু ঝামেলা আছে। তবে এ বিষয়ে বিস্তারিত কিছুই বলতে পারব না কিংবা কোনপ্রকার কাগজপত্রও দিতে পারব না। আপনি চাইলে অফিসে এসে দেখে যেতে পারবেন, কিন্তু কোন ছবি তুলতে পারবেন না। এর বাহিরে আপনার জন্য আমি আর কোনকিছুই করতে পারব না বলেও জানান এই কর্মকর্তা।’

সম্পাদক: মো. জেহাদ হোসেন চৌধুরী
যোগাযোগ: রিসোর্সফুল পল্টন সিটি (১১ তলা) ৫১-৫১/এ, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০।
মোবাইল: ০১৭১১-৯৫০৫৬২, ০১৯১২-১৬৩৮২২
ইমেইল: [email protected], [email protected]