14032

04/22/2025 তিস্তা সেচ খাল সংস্কারে কাটা হচ্ছে ৪ লাখ গাছ

তিস্তা সেচ খাল সংস্কারে কাটা হচ্ছে ৪ লাখ গাছ

নীলফামারী থেকে

৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ০০:১০

তিস্তা নদীর পানি প্রবাহ কৃষিতে ব্যবহারের জন্য রংপুর, দিনাজপুর ও নীলফামারীর ১২ উপজেলার বিভিন্ন এলাকা দিয়ে খাল খনন করে পানি উন্নয়ন বোর্ড। এসব খালের সঙ্গে সংযোগ রয়েছে প্রায় ৪০টি ক্যানেলের। তবে তত্ত্বাবধায়নের অভাবে বেশিরভাগ উপ-প্রধান খাল ও সংযোগ ক্যানেল নষ্ট হয়ে যায়।

বন মন্ত্রণালয় ও পানি মন্ত্রণালয় সমন্বিতভাবে নানা শর্তে চুক্তির স্মারকে এ সকল খাল ও সংযোগ ক্যানেলগুলোর উভয় ধারে সামাজিক বনায়নে বৃক্ষরোপণ করা হয়। তবে সম্প্রতি তিস্তা সেচ এলাকায় চাষাবাদ বৃদ্ধিতে সেচ খালগুলো সংস্কারের জন্য খালের উভয়ধারে সামাজিক বনায়নের প্রায় ৪ লাখ বৃক্ষ নিধনের প্রক্রিয়া চলছে।

এতে মরুকরণের প্রাকৃতিক বির্পযয়সহ জনস্বাস্থ্য হুমকির মুখে পড়বে বলে আশঙ্কা করছে জনসাধারণ ও পরিবেশবিদরা। স্থানীয়দের অভিযোগ, কৃষিতে পানি সরবরাহ বৃদ্ধির নামে বিশাল এলাকাজুড়ে সামাজিক বনায়নের বৃক্ষরাজি ধ্বংস করছে সংশ্লিষ্টরা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তিস্তা সেচ প্রকল্প এলাকায় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অধিক ফসল উৎপাদনে সেচের পানি নিশ্চিত করতে ২০২১ সালে ‘তিস্তা সেচ প্রকল্পের কমান্ড এলাকার পুনর্বাসন ও সম্প্রসারণ’ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। পরে ২০২২ সালের ২২ এপ্রিল তৃতীয় দফায় ভার্চুয়াল আলোচনার মাধ্যমে চূড়ান্ত হয় এ প্রকল্পের রূপরেখা। ১ হাজার ৪৫২ কোটি ৩৩ লাখ টাকা ব্যয় বরাদ্দে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের ভার পড়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের ওপর।

দায়িত্ব পেয়ে ওই বছরই তড়িঘড়ি করে তাদের সব খাল ও ক্যানেলের সংস্কার কাজ শুরু করে পাউবো। যার মেয়াদ ২০২৪ সাল পর্যন্ত। প্রকল্পের আওতায় আছে ৭৬৬.৩১ কিলোমিটার ‘ডাইক’ পুনবার্সন ও শক্তিশালীকরণ, ৭২ কিলোমিটার সেচ পাইপ স্থাপন, ১০ দশমিক ৮ কিলোমিটার প্রটেকশন বাঁধ নির্মাণ ও ১.০৬ কিলোমিটার বাঁধ সংস্কার। সঙ্গে বাইপাস সেচ খাল নির্মাণ করা হবে ৭ দশমিক ১৩ কিলোমিটার। এ ছাড়া পরিকল্পনা অনুসারে ২৭টি কালভার্ট, ৪টি সেতু নির্মাণ ও ২৭০ হেক্টর জলাধার ও সাড়ে ৯ কিলোমিটারের চ্যানেল পুনঃখনন, ৬ কিলোমিটার পরিদর্শন, ৫২.২৯ কিলোমিটার পরিদর্শন সড়ক নির্মাণ ও মেরামত, ৫৭টি নিকাশ কাঠামো নির্মাণ ও ৩টি মেরামত, ২০টি রেগুলেটর নির্মাণ ও ৬টি রেগুলেটর মেরামত এবং ১৮টি অনাবাসিক ভবন মেরামতের পর রোপণ করতে হবে ৮৭ হাজার গাছ।

তবে প্রকল্প সফল করতে ওই সব খাল ও ক্যানেলে বিদ্যমান সামাজিক বনায়নের প্রায় ৪ লাখ বৃক্ষ অপসারণ করতে হচ্ছে বন বিভাগকে। আর বিশাল সংখ্যক বৃক্ষরাজি ধ্বংস করায় উত্তরের এ জনপদে চলতি মৌসুমে প্রকৃতির ওপর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে বলে তৈরি হয়েছে আশঙ্কা।

পাউবো সূত্রে জানা গেছে, তিস্তা নদীর পানি প্রবাহ কৃষিতে ব্যবহারের জন্য ১৯৯১ সালে দিনাজপুর, নীলফামারী, সৈয়দপুর, ডিমলা, জলঢাকা, কিশোরগঞ্জ, গঙ্গাচড়া, রংপুর, তারাগঞ্জ, বদরগঞ্জসহ ১২ উপজেলার বিভিন্ন এলাকা দিয়ে বিভিন্ন খাল খনন করা হয়। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো দিনাজপুর সেচ খাল, বগুড়া সেচ খাল, রংপুর সেচখাল, এস সেভেনটি খাল, এস ফোরটি খাল, এস সিক্সটি খাল, টি-২ এস সেভেনটি খাল, তিস্তা প্রধান সেচ খাল, এস ওয়াই আর সেচ খাল, এস টু আর সেচ খাল, এস ফাইভ ডি সেচ খাল, এস এইটটি সেচ খাল, এস থ্রি-ডি সেচ খাল, এস সিক্সডি সেচ খাল, বিসিথ্রি সেচ খাল। এসব খালের সংযোগ রয়েছে প্রায় ৪০টি ক্যানেলের। পরে তত্ত্বাবধায়নের অভাবে বেশির ভাগ উপ-প্রধান খাল ও সংযোগ ক্যানেল নষ্ট হয়ে যায়। বন মন্ত্রণালয় ও পানি মন্ত্রণালয় সমন্বিতভাবে নানা শর্তে চুক্তির স্বারকে এ সকল খাল ও সংযোগ ক্যানেলগুলোর উভয়ধারে সামাজিক বনায়নের বৃক্ষরোপণ করেন। মেয়াদ পূর্তিতে কেটে পুনরায় রোপণ করা হয় চারা।

এভাবে স্থানীয় বনবিভাগ ও উপকারভোগীর মাধ্যমে ২০০২ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত আকাশমনি, ইউক্যালিপটাস, জারুল, পারুল, বহেরা, হরতকি, নারকেল, আম, জাম, বট, ডুমুর, গামার, গুটি, মেহগনি, সাদা কড়ই, রেইনট্রি, কটিগুয়া, পাকুড়, জলপাই, রাজকড়াই, বকহিন, কদম, পাউয়া জিগা, জিগনি, কাঠাল, মিল কড়ই, তরুল, পলাশ, বাবলা, শিশু, আমলকি, নুনাতি, ছাইতন, অর্জুন, মানডাল, চাম্পা, সোনালু, কৃষ্ণচুড়াসহ বিভিন্ন প্রজাতির বনজ, ফলজ ও ওষধি গাছ রোপণ করেন।

এ বিষয়ে বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. মতলুবুর রহমান বলেন, কৃষিতে ফলন বাড়ার লক্ষ্যে পানি উন্নয়ন বোর্ডের ওই প্রকল্পের গাছগুলো সরাতে হচ্ছে। কারণ এই শর্তে সেখানে গাছ রোপণ করা হয়েছিল। তবে বিশাল এ বনায়নের গাছ অপসারণের পর আবারও রোপণ হবে। একটু সময় লাগবে। এতে প্রকৃতিতে প্রভাব পড়তে পারে। এক্ষেত্রে করার কিছুই নেই।

ওই বনায়নের উপকারভোগী দলের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম বলেন, গাছগুলো খাল থেকে অনেক দূরে। এমনকি বাঁধের এক কিনারে। পাউবোর খনন ও বাঁধ পুনর্নির্মাণ কাজে কোনো সমস্যা হতো না। তারপরও এ গাছগুলো অপসারণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এভাবে গাছ ধ্বংসের নির্দেশদাতারা দেশপ্রেমিক হতে পারে না। পাউবো কর্তারা শুধু পকেট ভারি করতে পানি উন্নয়নের নামে মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে।

পাউবো ডালিয়া ডিভিশনের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আসফাউদদৌলা বলেন, গাছগুলো বন বিভাগের, তারা গাছ কাটবে। আর ক্যানেলগুলো সংস্কারের পর দুই ধারে আমরা গাছ লাগাব। এতে প্রকৃতিতে বিরূপ প্রভাব পড়লেও করার কিছু নেই।

সৈয়দপুর বিমানবন্দরের আবহাওয়া অফিসের ইনচার্জ লোকমান হাকিম বলেন, প্রতি বছর উত্তরাঞ্চলে গ্রীষ্মকালে উষ্ণতা বাড়ছে। গত বছর গড় তাপমাত্রা ছিল সর্বনিম্ন ৩৫ ও সর্বোচ্চ ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। প্রচণ্ড দাবদাহ পুড়েছিল উত্তরাঞ্চল। এমন পরিস্থিতে বিশাল এলাকার সবুজ বৃক্ষ কর্তন করা হলে আগামীতে এ অঞ্চলে মরুকরণের আশঙ্কা রয়েছে। তাই এখনই সচেতন হওয়া উচিত।

সৈয়দপুর সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ অধ্যাপক সাখাওয়াত হোসেন খোকন বলেন, ভূপৃষ্ঠে ৩০ শতাংশ বনভূমি বা বনাঞ্চল প্রয়োজন। গাছই হচ্ছে ধরণীর ফুসফুস। গাছ থেকে অক্সিজেনের পাশাপাশি এর ছায়া মাটিকে আর্দ্র ও চারপাশের পরিবেশকে সুরক্ষিত রাখে। তাই বৃক্ষ নিধন হলে আর্দ্রতা কমে শুকিয়ে যায় পরিবেশ। বিপর্যয় ঘটে প্রকৃতির। যার কারণে নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা যায়। প্রকৃতি ও মানবকল্যাণে অবিচারে বৃক্ষ নিধন কোনোমতেই উচিত নয়। সরকারকে ধোঁয়াশায় রেখে এই উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।

সম্পাদক: মো. জেহাদ হোসেন চৌধুরী
যোগাযোগ: রিসোর্সফুল পল্টন সিটি (১১ তলা) ৫১-৫১/এ, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০।
মোবাইল: ০১৭১১-৯৫০৫৬২, ০১৯১২-১৬৩৮২২
ইমেইল: [email protected], [email protected]