আজকে রেলের সাথে কক্সবাজার সংযুক্ত হলো। দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০২ কিলোমিটার রেললাইনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে থাকতে পেরে সত্যি আমি খুব আনন্দিত। একটা কথা দিয়েছিলাম, কথাটা রাখলাম। আজকের দিনটি বাংলাদেশের জনগণের জন্য একটা গর্বের দিন। ১৩৩ বছরের স্বপ্ন অবশেষে হাতের মুঠোয় এসেছে কক্সবাজারবাসীর।
আজ (শনিবার) দুপুরে দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ।
তিনি বলেন, কক্সবাজার এমন একটি সমুদ্র সৈকত, যেটা বিশ্বে বিরল, বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘতম বালুকাময় সমুদ্র সৈকত। ৮০ মাইল লম্বা, সম্পূর্ণটাই বালুকাময়।
শেখ হাসিনা আরও বলেন, আমরা যখন স্বাধীনতা অর্জন করি তখন ৮০ থেকে ৯০ ভাগ মানুষই দরিদ্র ছিল। পরনে ছিন্ন কাপড়, পেটে খাবার নেই, চিকিৎসা নেই, শিক্ষার ব্যবস্থা নেই, শোষণ, বঞ্চনা আর নির্যাতিত মানুষ।
তিনি আরও বলেন, ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টের পর এ দেশের অগ্রযাত্রা থেমে যায়। অস্ত্র হাতে নিয়ে বন্দুকের নলের সাহায্যে সেনা আইন লঙ্ঘন করে যারা ক্ষমতা দখল করেছিল, তারা মানুষের ভাগ্য গড়তে আসেনি বরং আমাদের বিজয়ী পতাকা নষ্ট করা, স্বাধীনতার চেতনাকে নষ্ট করা, আমাদের যে আদর্শ সে আদর্শকে ধ্বংস করার জন্যই তাদের যাত্রা ছিল। নিজেরা অর্থশালী হয়েছে, দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিয়েছে, ঋণ খেলাপির কালচার শুরু করেছিল, তার ওপর সেনাবাহিনী-বিমানবাহিনীসহ আমাদের আওয়ামী লীগের অগণিত নেতাকর্মীকে হত্যা, গুম, খুন করেছিল। এখনও সেই পরিবারগুলো তাদের আপনজনকে খুঁজে বেড়ায়। ২১টা বছর লঙ্ঘন মানুষ এভাবে কষ্ট পেয়েছে।
অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন রেলমন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম সুজন ও রেলসচিব ড. মো. হুমায়ুন কবীর।
১৮৯০ সালে ব্রিটিশ আমলে প্রথম পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয় চট্টগ্রাম-কক্সবাজার হয়ে মিয়ানমারের (সাবেক বার্মা) আকিয়াব বন্দর পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ। তারপর ১৯১৭ থেকে ১৯২১ সালে চট্টগ্রাম-দোহাজারী পর্যন্ত ৫০ কিলোমিটার রেলপথ নির্মিত হয়।
কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণে পরিকল্পনা অনুসারে কক্সবাজার পর্যন্ত বাদবাকি অংশে রেলপথ তৈরি হয়নি।
এরপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী সিদ্ধান্তে দোহাজারী-রামু-কক্সবাজার-ঘুমধুম রেলপথ স্থাপনে জন্য ২০১০ সালে প্রথম প্রকল্প নেয়া হয়। শুরুতে এটি ছিল ‘দোহাজারী হতে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু হতে ঘুমধুম পর্যন্ত সিঙ্গেল লাইন ডুয়েল গেজ ট্র্যাক নির্মাণ’ প্রকল্প। এতে মোট ১২৯ দশমিক ৫৮ কিলোমিটার রেল লাইন নির্মাণের কথা ছিল।
পরে রামু থেকে ঘুমধুম অংশের কাজ স্থগিত করা হয়। এখন চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০০ দশমিক ৮৩ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণ সমাপ্ত হল।
মোট ১৮ হাজার ৩৪ কোটি টাকার এ প্রকল্পে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ১৩ হাজার ১১৫ কোটি টাকা ঋণ দিচ্ছে। বাকি ৪ হাজার ১১৯ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে।
প্রকল্পের জন্য কক্সবাজার জেলায় ১ হাজার ৩৬৫ একর জমি অধিগ্রহণ করতে হয়েছে। প্রকল্পের আওতায় নির্মাণ করা হয়েছে নয়টি রেলওয়ে স্টেশন, চারটি বড় ও ৪৭টি ছোট সেতু, ১৪৯টি বক্স কালভার্ট এবং ৫২টি রাউন্ড কালভার্ট।
তারপর চলতি বছরের আগস্ট মাসের শুরুতে চট্টগ্রাম অঞ্চলে রেকর্ড বৃষ্টিপাতের কারণে পাহাড়ি ঢলে রেললাইনটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তারজন্য এ প্রকল্প আরও পিছিয়ে যায় কয়েক মাস।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, প্রকল্পের আওতায় কক্সবাজারে ঝিনুকের আদলে আধুনিক রেলওয়ে স্টেশন নির্মাণের পাশাপাশি দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত মোট ৯টি স্টেশন নির্মাণ করা হয়েছে। এ ছাড়া সংরক্ষিত বন এলাকায় রেললাইন স্থাপন করায় বন্যহাতি ও বন্যপ্রাণী চলাচলের জন্য ওভারপাস নির্মাণ করা হয়েছে, যা দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম ।
সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, জেলা শহর থেকে তিন কিলোমিটার পূর্বে ঝিলংজা ইউনিয়নের হাজিপাড়া এলাকায় ২৯ একর জমির ওপর দৃশ্যমান আইকনিক রেল স্টেশন। ঝিনুকের আদলে তৈরি দৃষ্টিনন্দন এ স্টেশন ভবনটির আয়তন এক লাখ ৮২ হাজার বর্গফুট। ছয়তলা বিশিষ্ট স্টেশনটি নির্মাণে বিশ্বের বিভিন্ন আধুনিক স্টেশনের সুযোগ-সুবিধা বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। চার বছরের শ্রমে আইকনিক রেলস্টেশন ভবনটি আজ সত্যিই চোখ জুড়ানো বাস্তবতা।