হজরত ওয়াহশী ইবনে হারব রা.। মক্কায় ইসলামের সূচনা লগ্নে তিনি ছিলেন একজন মুশরিকের কৃতদাস। দাস জীবন থেকে মুক্তির জন্য হত্যা করেছিলেন ইসলামের বিখ্যাত সাহাবি হজরত হামজা রা.-কে। পরবর্তীতে আল্লাহ তায়ালা তাঁর অন্তরে হেদায়েতের নূর ঢেলে দেন। ইসলাম গ্রহণ করে ধন্য।
ইসলাম গ্রহণের কারণে রাসূল সা. তাঁকে ক্ষমা করলেও চাচার হত্যাকারী হিসেবে মেনে নিতে পারেননি। তাই তাঁকে নিজের সামনে আসতে বারণ করেছিলেন। দাস জীবন থেকে মুক্তির জন্য এক সময় রাসূল সা.-এর প্রিয় চাচাকে হত্যা করলেও ইসলাম গ্রহণের পর রাসূল সা. থেকে দূরে সরে থাকার এই যাতনা আজীবন পুড়িয়েছে ওয়াহশী রা.-কে। তিনি এর বিনিময় হিসেবে হত্যা করেছিলেন সাহাবি যুগের কুখ্যাত ব্যক্তি মিথ্যা নবীর দাবিদার মুসায়লামাতুল কাজ্জাবকে।
ওয়াহশী রা. ছিলেন মূলত হাবশার এক কৃষ্ণাঙ্গ। কুরায়শের বিখ্যাত নেতা জুবায়র ইবন মুতইমের দাস ছিলেন তিনি। বদরের যুদ্ধে জুবায়র ইবন মুতইমের চাচা তুআয়মা ইবন আদী নিহত হন। তখন তিনি ওয়াহশী রা.-কে বলেন, তুমি যদি আমার চাচার হত্যার প্রতিশোধ নিতে পার, তবে তোমাকে মুক্ত করব আমি।
তুআয়মা নিহত হয়েছিল নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চাচা হজরত হামজা রা.-এর হাতে। বদর যুদ্ধের পরে উহুদ যুদ্ধের ঘোষণা করা হলো। তখন ওয়াহশী দাস জীবন থেকে মুক্তি লাভের আশায় হামজা রা.-কে হত্যা করার প্রতিজ্ঞা নিয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করলেন।
যুদ্ধের সময় ওয়াহশী একটি বড় পাথরের আড়ালে ওঁৎ পেতে থাকেন। এক পর্যায়ে হজরত হামজা রা.-কে নাগালের মধ্যে পেয়ে যান এবং নির্মমভাবে তাঁকে হত্যা করেন। বিনিময়ে জুবায়র ইবন মুতইম তাঁকে মুক্তি দেন।
মক্কা বিজয়ের পর তিনি তায়েফে পালিয়ে চলে যান। তাঁর ভয় ছিল হামজা রাযি.-কে হত্যা করার অপরাধে তাঁকেও হত্যা করা হবে। মক্কার পর তায়েফ বিজয় হলো।সেখানকার লোকজনও দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করলো।
এ সময় ওয়াহশী রা. শামে পালিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলেন। তখন কোনো এক ব্যক্তি তাঁকে ইসলামগ্রহণের পরামর্শ দিয়ে বললেন, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোনো ইসলাম গ্রহণকারীকে হত্যা করেন না।
তিনি বুকভরা আশা নিয়ে মদীনায় গেলেন। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে গিয়ে তিনি কালেমায়ে শাহাদাত পাঠ করলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে দেখেই বললেন, ওয়াহশী! তিনি বললেন, হাঁ। বললেন, বসো। কীভাবে তুমি হামজাকে হত্যা করেছো আমাকে বলো। তিনি পূর্ণ ঘটনা বিবৃত করলেন।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ছিঃ, তুমি তোমার চেহারা আমার চোখের আড়ালে রেখো। আমি যেন তোমাকে দেখতে না পাই। তিনি আড়ালেই থাকতে লাগলেন। এভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওফাত হয়ে গেল।
আবু বকর সিদ্দীক রা.-এর খেলাফতকালে মিথ্যুক নবী মুসায়লিমা কাযযাবের বিরুদ্ধে ইয়ামামার যুদ্ধে শরীক হলেন ওয়াহশী রা.। সঙ্গে ওই বর্শাটি নিয়ে গেলেন, যেটি দিয়ে তিনি হজরত হামযাজা রাযি.-কে শহীদ করেছিলেন।
এবারও তিনি ওঁৎ পেতে থাকলেন। একটাই সংকল্প- নিজ হাতে এই ভণ্ড নবীকে হত্যা করবেন। এটা ছিল এক ঘোরতর যুদ্ধ। মুসায়লিমার বাহিনীতে হাজার হাজার সৈন্য। তারাই বড়ই যুদ্ধবাজ। তাদের বিরুদ্ধে সাহাবায়ে কেরামের বাহিনী বিপুল বিক্রমে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিলেন। শত শত সাহাবী এ যুদ্ধে শাহাদাত বরণ করেন।
যুদ্ধের সেই লেলিহান শিখার ভেতর ওয়াহশী রা. তাঁর অটুট সংকল্প নিয়ে অপেক্ষায় আছেন। এক পর্যায়ে তাঁর অপেক্ষার অবসান ঘটল। মুসায়লিমাকে বাগে পেয়ে গেলেন। এক মুহূর্ত নষ্ট করলেন না। সিংহের মতো ঝাঁপিয়ে পড়লেন। হযরত হামযা রাযি. এর রক্তে রঞ্জিত সেই বর্শাখানি মুসায়লিমার তলপেট বরাবর ছুঁড়ে মারলেন। ঘোর সে মিথ্যুকের তলপেট এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে গেল।
পরে হজরত ওয়াহশী রা. বলতেন, আমি যখন অমুসলিম ছিলাম তখন শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিকে হত্যা করেছি। ইসলাম গ্রহণের পর হত্যা করেছি সর্বাপেক্ষা নিকৃষ্ট ব্যক্তিকে।
তিনি শাম অঞ্চলের বিভিন্ন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। তার মধ্যে ইয়ামামার যুদ্ধ ও দামেস্ক বিজয় অন্যতম। পরবর্তীকালে তিনি হিমসে চলে যান। মৃত্যু পর্যন্ত সেখানেই বসবাস করেন।