34134

03/12/2025 প্রচারমাধ্যমে শিশুদের বিনোদন কতখানি?

প্রচারমাধ্যমে শিশুদের বিনোদন কতখানি?

নাজনীন হাসান চুমকী

৬ মার্চ ২০২৫ ১১:৪০

আশির দশকের শেষে হুমায়ূন আহমেদের রচনায় ‘বহুব্রীহি’ নাটকের একটি সংলাপ সবার মুখে মুখে ছিল। শিশু থেকে বৃদ্ধ সবাই এই সংলাপ আওড়াতো। এখনও সবাই সেই সংলাপ বলে। গণজাগরণ মঞ্চের সময়ও এই সংলাপ ছিল আলোচনায়। এমন অনেক সংলাপ বা শ্লোগান আছে যা মানুষকে ভাবিয়েছে, নিগূঢ় অর্থ বুঝিয়েছে, এমনকি জনসচেতনতায়ও কাজ করেছে। অর্থাৎ ভিজ্যুয়াল মাধ্যম শুধু বিনোদনের কাজ করে না, শিক্ষারও একটি মাধ্যম।

প্রায়শই দেখা যায়, শিশুরা স্কুলে যাওয়ার আগেই আধো আধো বোলে বা দুরন্তপনার মাঝে বাংলাভাষা নয় সাবলীলভাবে ইংরেজি এমনকি জাপানিজ ভাষায় কথা বলছে। বিষয়টি হতবাক হওয়ার মতো। কিন্তু একটু লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, এর কারণ, শিশু স্মার্টফোন বা টিভিতে উল্লেখিত ভাষায় তার প্রিয় কার্টুনটি দেখে থাকে। যেখানে প্রাপ্তবয়স্করা হাজার হাজার টাকা, ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় ব্যয় করেও সঠিক উচ্চারণে বিদেশি ভাষা ঠিকভাবে শিখে উঠতে পারে না, সেখানে শিশুরা নিজ ভাষা থেকে বিদেশি ভাষায় খুবই সাবলীল!

শিশু অনুকরণ প্রিয়, যা দেখানো হবে বা যা সে দেখবে, যে গল্প শুনবে-সেখান থেকেই শিখবে। শিশু বিশেষজ্ঞ মারিয়া মন্তেসরি (Maria Montessori)-এর মতে, শিশুর সামাজিক, মানসিক, শারীরিক এবং শিক্ষাগত বিকাশের জন্য শিক্ষা পদ্ধতি গ্রহণ করা উচিত। কারণ শিশুর মাঝে রয়েছে সহজাত দক্ষতা, যোগ্যতা ও নানান গুণাবলীর সর্বোচ্চ ক্ষমতা। তাই একজন শিশুর মানসিক-স্বাস্থ্যসেবা, শারীরিক সুস্থতার মতোই বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

বাংলাদেশে একটি শিশুতোষ চ্যানেল ব্যতীত অপরাপর টিভি চ্যানেল ও ওটিটি’র অনুষ্ঠান বা প্রোডাক্ট-এর দিকে লক্ষ্য করলে শিশুতোষ কিছু প্রায় চোখেই পড়ে না। সবই ১৮+ বা বড়দের জন্য। তাহলে শিশুর বিনোদন কোথায়? স্মার্টফোনের ছোট্ট মনিটরে বাংলাসহ (খুব কম) অন্যান্য ভাষার বিভিন্ন অনুষ্ঠান। যেখানে মুখ গুঁজে সারাদিন বসে থাকার কারণে শিশুর চোখের সমস্যা হচ্ছে, শারীরিকভাবে বেড়ে ওঠা ব্যাহত হচ্ছে।

দেশীয় সংস্কৃতি ব্যতীত সে অন্য দেশের সংস্কৃতিকে আপন করে মানসিকভাবে গ্রহণ করছে। অতঃপর কৈশোরে পদার্পণ করেই সে মানসিকভাবে ধাক্কা খাচ্ছে পারিবারের ‘এটা করো না, ওটা করো না’র চাপে। পরিবার তখন তাকে বাংলাদেশের সামাজিক রীতিনীতি বোঝানোর চেষ্টা করছে। যা তার বোধের সাথে সাংঘর্ষিক।

অধিকাংশ শিশু বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে তার রাষ্ট্রীয় অধিকার, সামাজিক আচরণ, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি মুখস্থ করে স্কুলের পরীক্ষায় পাস করার জন্য। মাটি ও মাঠের সংস্পর্শতা যদি বিনোদনের মাধ্যমে উপস্থাপন করা যেত তবে তারা অনুভব করতে পারতো, দুরন্তপনা। আনন্দিত হতো।

উল্লেখ করা যায়, মোরশেদুল ইসলাম পরিচালিত ‘আমার বন্ধু রাশেদ’ চলচ্চিত্রের নাম। যা বাংলাদেশে সব সময় শিশু-কিশোরদের কাছে প্রিয় একটি চলচ্চিত্র। আবার আজিজুর রহমান পরিচালিত ‘ছুটির ঘণ্টা’, সি বি জামান পরিচালিত ‘পুরস্কার’, তারেক মাসুদ পরিচালিত ‘মাটির ময়না’ ইত্যাদি দর্শক সমাদৃত চলচ্চিত্র।

বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত এবং মুস্তাফা মনোয়ার নির্দেশিত অনুষ্ঠান ‘নতুন কুঁড়ি’র কথা স্মরণ করতে পারি। এই অনুষ্ঠানটি দেশব্যাপী সাড়া ফেলেছিল। শিশু থেকে কিশোরদের অংশগ্রহণে উক্ত অনুষ্ঠানে নাচ, গান, আবৃত্তি, চিত্রাঙ্কন, গল্প বলা, একক ও দলীয় নাটক ইত্যাদিতে শিশু-কিশোরদের অংশগ্রহণে পাশাপাশি দর্শক হিসেবে আগ্রহ ছিল। এছাড়া ‘মনের কথা’ নামে একটি পুতুলনাট্য বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত হতো।এই অনুষ্ঠানটি অসংখ্য শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের মনে ইতিবাচক প্রভাব রাখে।

বাংলাদেশ টেলিভিশনে বাংলা ভাষার অনুষ্ঠানের পাশাপাশি ইংরেজি ভাষার থান্ডার ক্যাটস্, স্কুবি-ডু, টিনেজ মিউট্যান্ট নিনজা টার্টলস, দ্য থ্রি স্টুজেসসহ বিভিন্ন কার্টুন ও সিরিজ প্রচার করতো। সম্প্রচার সময়ও ছিল বিকেলবেলা। সে কী অপেক্ষা! স্কুল থেকে ফিরে একটু ঘুম, খেলা, বাসায় ফিরে এসে হাতমুখ ধুয়ে বিকেলের নাস্তা খেয়ে পছন্দের অনুষ্ঠান শেষ করে পড়তে বসা। এরপর ভাইবোনেরা, পরদিন স্কুলে বন্ধুদের সাথে সেইসব নিয়ে আলোচনা, স্টিকার সংগ্রহ করা—এইসব স্মৃতি এখনো নাড়া দেয় মনে।

সবই তো সুন্দর, সুস্থভাবেই সম্পন্ন হয়েছে! এখন কেন এত অস্থিরতা? নব্বই দশক পর্যন্ত নাটকে শিশু-কিশোরদের কথা ভেবে প্রায় প্রতিটি নাটক রচনা এবং প্রচার করা হয়েছে। পুরো পরিবার একসাথে বসে নাটক, চলচ্চিত্র দেখেছে। এতে পারিবারিক বন্ধন সুদৃঢ় হয়েছে, অনুভূতিগুলো ছিল আবেগী।

সাম্প্রতিক সময়ে আমরা শিশুদের অবহেলা করে পারিবারিক এবং সামাজিক বন্ধনগুলো হালকা করে ফেলছি। আলাদাভাবে শিশুর মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ডাক্তারের শরণাপন্ন হচ্ছি। বারবার বলতে হচ্ছে ‘মেয়েরাও মানুষ’। কিশোর দ্বারা ধর্ষিত হচ্ছে বৃদ্ধা, শিশু। আমরা কেবল চিৎকার করছি, সামাজিক মাধ্যমগুলো চিন্তার বিরক্তি, রাগ প্রকাশ করছি, আন্দোলন করছি, আইনকে প্রশ্নবিদ্ধ করছি, পত্রিকার হেডলাইন করছি, টেলিভিশন সংবাদে প্রচার করছি। অথচ আমাদের কী দায়িত্ব সেটা নিয়ে ভাবছি না।

শিশুরা পড়তে চাই, দেখতে চাই তাদের পছন্দমতো বই এবং নাটক/চলচ্চিত্র/সিরিজ। বাংলাদেশের বিভিন্ন চ্যানেল এবং ওটিটি মাধ্যমের উচিত শিশুতোষ বা কিশোর উপযোগী বিষয়বস্তু সমৃদ্ধ প্রোডাকশন নির্মাণ করা। ভিউ এবং মার্কেটিং-এর দিক থেকেও এই প্রোডাকশনগুলো লস হওয়ার কথা নয়।

শিশুরা শিক্ষণীয় এবং পছন্দের অনুষ্ঠান নিয়ে ব্যস্ত আছে এবং স্মার্টফোন ছেড়ে টেলিভিশনের স্ক্রিনে চোখ রেখেছে, এটা সব অভিভাবকের জন্য শান্তির এবং স্বস্তির। আমির খান প্রযোজিত শিশুতোষ চলচ্চিত্র ‘তারে জামিন পার’-এর সাথে মুক্তি পেয়েছিল অপর চলচ্চিত্র ফিরোজ এ. নাদিয়াওয়ালা প্রযোজিত ‘ওয়েলকাম’। দুটিই ব্যবসা সফল চলচ্চিত্র।

যদি ব্যবসায়িকভাবে হিসাব করি, শিশুতোষ চলচ্চিত্র ‘তারে জামিন পার’-এর দর্শক হলো শিশুরা। তাদের সাথে এক-দুইজন অভিভাবক, পরিবারের দুই-তিনজন শিশু, কখনো পরিবারের অন্যান্য শিশু সদস্য এবং পাশাপাশি শিশু বা কিশোরের বন্ধুবান্ধবেরাও এসেছিল। অর্থাৎ স্বাভাবিকের চেয়ে শিশুতোষ চলচ্চিত্রের দর্শক সংখ্যা বেশি। ফলে, বলা যায় শিশুতোষ চলচ্চিত্রে ক্ষতির সম্ভাবনা কম।

সঠিক মার্কেটিং, সুন্দর চিত্রনাট্য, চমৎকারভাবে সিনেমাটোগ্রাফি ও সংলাপসহ বুদ্ধিদীপ্ত একটি পরিচালনার চলচ্চিত্র বা নাটক শিশু এবং তার পরিবারের নিকট অবশ্যই গ্রহণযোগ্যতা পাবে। বাংলাদেশের শিশুরা যেভাবে বিদেশি চলচ্চিত্র এবং সিরিজে আসক্ত হয়ে পড়ছে তাতে বাংলাদেশের স্বল্প বাজেটের বা আদর্শিক বা শিশুতোষ চলচ্চিত্রগুলো তুলনামানের বিচারে পিছিয়ে পড়ছে। কিন্তু মানুষ এখনো নিজ ভাষার বিষয়বস্তু স্বস্তিতে পড়ে এবং দেখে। সময় শেষ হয়ে যায়নি, মনোযোগী হতে হবে শিশু-কিশোরদের জন্য। মানুষ আমাদের নাটক, সিরিজ এবং চলচ্চিত্র থেকে শুধু বিনোদন নয় শিক্ষাও গ্রহণ করে। অনেক সময় ব্যবসায়িক চিন্তাভাবনা মাথায় নিয়ে মানুষের মানবিক প্রবৃত্তি নিয়েও ভাবতে হয়।

বাংলাদেশ সামাজিকভাবে বসবাসের উপযুক্ত একটি দেশ। এই দেশে সমাজকে উপেক্ষা করে কোনোকিছুই আমরা করতে বা ভাবতে পারি না। বকাঝকা দিয়ে বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জ্ঞানদান করে শিশুদের সামাজিক করে গড়ে তোলা সম্ভব নয়। সবচেয়ে সুন্দর মাধ্যম ভিজ্যুয়াল মিডিয়া এবং থিয়েটার।

স্কুল কর্তৃপক্ষ নিয়মমাফিক থিয়েটার প্রযোজনা করলে এবং ভিজ্যুয়াল মিডিয়া শিশুতোষ প্রোডাকশনে নিয়মিত হলে শিশু-কিশোরদের ভিডিও গেমস আসক্তি এবং মানসিক স্বাস্থ্য সুন্দর করা অনেকাংশেই সম্ভব। তবে এই সম্ভবকে সার্থক করে তোলার জন্য বড়দের চিন্তাভাবনা, আদর্শ, মতাদর্শকে শিশুর ওপর চাপানোর প্রবণতা থেকে দূরে থাকতে হবে।

শিশুর মতো করে ভাবতে হবে, উপস্থাপন করতে হবে। বেশ কঠিন কাজ, তারপরও সহজ। কীভাবে? সত্যজিৎ রায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়’র ‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাসের সাহায্য নিয়ে স্মরণকালের শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রটি বানিয়েছিলেন। নিজেই লিখেছিলেন ‘সোনার কেল্লা’ এবং পরিচালনা করেছিলেন। সত্যজিৎ রায়’র অনবদ্য সৃষ্টি ‘ফেলুদা’ যা যুগে যুগে শিশু-কিশোরদের প্রিয় চরিত্র।

বাংলাদেশে অসাধারণ শিশুতোষ গল্প, উপন্যাস আছে। সেখান থেকে চমৎকার চিত্রনাট্য সম্ভব। যেমন ফরিদুর রেজা সাগর-এর শিশু-কিশোরদের জন্য লেখা ‘ছোট কাকু’ সিরিজটি আফজাল হোসেন-এর পরিচালনায় অনেক বছর ধরে ঈদের বিশেষ প্রোডাকশন হিসেবে প্রচারিত হয়। শিশু-কিশোরদের স্বার্থে এই সিরিজের মার্কেটিং নিয়ে কর্তৃপক্ষের ভাবা উচিত পাশাপাশি নিয়মিত সিরিজ হলে, কল্যাণকর হতো।

ওপার বাংলাসহ বিশ্বে শিশু-কিশোরদের নিয়ে একের পর এক চলচ্চিত্র, সিরিজ নির্মিত হয়েছে। পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ। তুলনামূলকভাবে অনেক পিছিয়ে আছে। এটা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য ভালো ফলাফল বয়ে আনবে না। শিশুর শৈশবকে অক্ষুণ্ন রাখতে হবে, কিশোরের কৈশোরকে অবমাননা করে প্রাপ্তবয়স্ক হতে দেওয়া, ঠিক না।

শিশু তার অন্তর্নিহিত প্রতিভায় বিকশিত হবে। আজকের শিশু আগামীতে সুস্থ চিন্তার মানুষ হয়ে পরিবার, সমাজ তথা দেশের জন্যে কল্যাণকর নাগরিক হবে। তাই আবারও বলছি, শিশুদের জন্য আলাদাভাবে ভাবতে হবে। পরিবর্তন আনতে হবে, সম্প্রচার মাধ্যমে। যা আপাতদৃষ্টিতে খুব কঠিন বোধ হলেও, চাইলেই সম্ভব এবং এই অসম্ভবকে জয় করার মধ্যে নিহিত আছে শান্তি ও স্বস্তি।

নাজনীন হাসান চুমকী ।। অভিনেত্রী, নাট্যকার ও পরিচালক

সম্পাদক: মো. জেহাদ হোসেন চৌধুরী
যোগাযোগ: রিসোর্সফুল পল্টন সিটি (১১ তলা) ৫১-৫১/এ, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০।
মোবাইল: ০১৭১১-৯৫০৫৬২, ০১৯১২-১৬৩৮২২
ইমেইল: [email protected], [email protected]