34567

03/19/2025 সম্রাট আওরঙ্গজেবের সমাধি সরানো নিয়ে ভারতে ব্যাপক সহিংসতা, কারফিউ

সম্রাট আওরঙ্গজেবের সমাধি সরানো নিয়ে ভারতে ব্যাপক সহিংসতা, কারফিউ

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

১৮ মার্চ ২০২৫ ১১:২৭

ভারতের মহারাষ্ট্রে মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের সমাধি সরানোর দাবিকে ঘিরে ব্যাপক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। সহিংসতার এই ঘটনার জেরে দেশটির পশ্চিমাঞ্চলীয় এই রাজ্যটির নাগপুরের বেশ কয়েকটি এলাকায় কারফিউ জারি করা হয়েছে।

আওরঙ্গজেব ছিলেন ছয়জন মহান মুঘল সম্রাটের মধ্যে সর্বশেষ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ সম্রাট। তার সমাধি মহারাষ্ট্রের সম্ভাজিনগর (আগে ছিল আওরঙ্গাবাদ) জেলার খুলদাবাদে অবস্থিত। বিজেপি নেতাদের পাশাপাশি কট্টর উগ্র হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীগুলো বেশ কিছুদিন ধরেই তার সমাধিসৌধ সরানোর দাবি করে আসছিল।

মঙ্গলবার (১৮ মার্চ) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি।

সংবাদমাধ্যমটি বলছে, মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের সমাধি মহারাষ্ট্র থেকে সরিয়ে নেওয়ার দাবিকে কেন্দ্র করে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ার পর নাগপুরের বেশ কয়েকটি এলাকায় কারফিউ জারি করা হয়েছে। ১৭ শতকের মহান এই সম্রাটের সমাধি আরঙ্গাবাদে অবস্থিত, যা বর্তমানে ছত্রপতি সম্ভাজিনগর জেলা নামে পরিচিত।

এদিকে নাগপুরের পুলিশ কমিশনার রবীন্দ্র কুমার সিঙ্গাল ভারতীয় নাগরিক সুরক্ষা সংহিতার ১৬৩ ধারার অধীনে একটি নোটিশ জারি করেছেন। এতে বলা হয়েছে, কোতোয়ালি, গণেশপেঠ, তহসিল, লাকাদগঞ্জ, পাচপাওলি, শান্তিনগর, সক্করদারা, নন্দনবন, ইমামওয়াদা, যশোধরানগর এবং কপিলনগর থানা এলাকায় কারফিউ জারি থাকবে। পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত এসব এলাকায় এই নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকবে।

পুলিশ কমিশনারের নোটিশ অনুসারে, কট্টর উগ্র হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠী বিশ্ব হিন্দু পরিষদ এবং বজরং দলের সমর্থকরা গতকাল নাগপুরের মহল এলাকায় শিবাজি মহারাজের মূর্তির কাছে জড়ো হয়ে মহারাষ্ট্র থেকে আওরঙ্গজেবের সমাধি অপসারণের দাবিতে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। এসময় তারা বিভিন্ন স্লোগান দেয় এবং আওরঙ্গজেবের ছবি এবং “ঘাসে ভরা সবুজ কাপড়ে মোড়া একটি প্রতীকী সমাধিও” আগুনে পুড়িয়ে দেয়।

প্রতিবেদন অনুসারে, সবুজ কাপড় পোড়ানোর ফলে ‘গুজব’ ছড়িয়ে পড়ে। কারণ অনেকে দাবি করে— এতে পবিত্র আয়াত লেখা ছিল, যার ফলে এলাকায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। নোটিশে বলা হয়েছে, গত সন্ধ্যায় একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের প্রায় ৮০ থেকে ১০০ জন হিংসাত্মক হয়ে ওঠে। পুলিশকে লক্ষ্য করে পাথর ছোঁড়া হয় এবং বেশ কয়েকটি গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। পুলিশ লাঠিচার্জ করে এবং টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে। পরিস্থিতি বর্তমানে নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।

ভারতীয় বার্তাসংস্থা পিটিআইয়ের এক প্রতিবেদন অনুসারে, সহিংসতায় চারজন আহত হয়েছেন। এক ডজনেরও বেশি পুলিশ সদস্যও আহত হয়েছেন।

এদিকে ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী এবং নাগপুরের তিনবারের সংসদ সদস্য নীতিন গড়করি সবাইকে শান্ত থাকার আবেদন জানিয়েছেন এবং ‘গুজবে’ বিশ্বাস না করার জন্য জনগণকে অনুরোধ করেছেন। তিনি বলেছেন, “আমি আপনাদের সকলকে আশ্বস্ত করছি, যারা ভুল করেছেন বা অবৈধ কার্যকলাপে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে সরকার ব্যবস্থা নেবে। মুখ্যমন্ত্রীকে ইতোমধ্যেই এই পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করা হয়েছে, তাই আমি সকলকে ‘গুজবে’ কান না দেওয়ার জন্য অনুরোধ করছি।”

সহিংসতার ঘটনায় মোট ৫০ জনকে আটক করা হয়েছে। এলাকায় নিরাপত্তা বাহিনী বিপুল সংখ্যক সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে।

মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী ও বিজেপি নেতা দেবেন্দ্র ফড়নবিশ আইনশৃঙ্খলা নিশ্চিত করতে পুলিশকে সহযোগিতা করার জন্য জনগণকে আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি নাগরিকদের ‘গুজবে’ বিশ্বাস না করার এবং আইন নিজের হাতে না নেওয়ার জন্যও আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, “নাগপুর শান্তিপ্রিয় শহর এবং একে অপরের সুখ-দুঃখে অংশগ্রহণ করে। এমন পরিস্থিতিতে, কোনও ‘গুজবে’ বিশ্বাস করবেন না এবং প্রশাসনকে সহযোগিতা করুন।”

এদিকে সম্রাট আওরঙ্গজেবের সমাধি সরানোর যে দাবি সম্প্রতি কট্টরপন্থিদের কাছ থেকে এসেছিল তার প্রতি কয়েকদিন আগে সমর্থনও জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফড়নবিশ। তবে এখন তিনি বলছেন, “নাগপুরের মহল এলাকায় যা ঘটেছে তা খুবই অনুচিত। জনতার জড়ো হয়ে এভাবে পাথর ছোঁড়া খুবই অন্যায়। আমি নাগপুরের সকল মানুষকে আইনশৃঙ্খলা মেনে চলার জন্য অনুরোধ করছি। নাগপুর এমন একটি শহর যেখানে মানুষ সম্প্রীতির সাথে বাস করে। অতএব, কারও শান্তি বিঘ্নিত করা উচিত নয়। আমি পরিস্থিতির ওপর কড়া নজর রাখছি।”

তিনি বলেন, যারা সহিংসতার আশ্রয় নেয় তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। যদি কেউ পুলিশের ওপর আক্রমণ করে, তবে তা অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে নেওয়া হবে।

অন্যদিকে মহারাষ্ট্রের বিরোধী দল সহিংসতার জন্য রাজ্য সরকারের তীব্র সমালোচনা করেছে। শিবসেনা ইউবিটি বিধায়ক আদিত্য ঠাকরেসোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম এক্সে দেওয়া এক পোস্টে বলেছেন, “রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা আগের চেয়ে অনেক ভেঙে পড়েছে। মুখ্যমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নিজ শহর নাগপুর এই ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছে।”

এনসিপির (শারদ পাওয়ার) লোকসভার সংসদ সদস্য সুপ্রিয়া সুলে বলেন, নাগপুরে সহিংসতা দুর্ভাগ্যজনক। এক্সে দেওয়া এক পোস্টে তিনি বলেন, “আমরা নাগরিকদের কাছে আবেদন করছি— দয়া করে কোনও ‘গুজবে’ বিশ্বাস করবেন না। আসুন আমরা সকলে পারস্পরিক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যের পরিবেশ বজায় রাখার জন্য একসাথে কাজ করি। এটি প্রগতিশীল ধারণার মহারাষ্ট্র। আসুন আমরা সকলে আমাদের রাজ্যের এই পরিচয় বজায় রাখার জন্য একসাথে কাজ করি।”

এছাড়া কংগ্রেস নেতা পবন খেরা বলেছেন, নাগপুর তার অস্তিত্বের ৩০০ বছরে দাঙ্গার সম্মুখীন হয়নি। তিনি বলেছেন, “গত বেশ কয়েকদিন ধরে ৩০০ বছরের পুরনো ইতিহাসকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে বিভাজন, বিভ্রান্তি এবং অস্থিরতা তৈরি করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এই সংঘর্ষগুলো কেন্দ্র এবং রাজ্য উভয় ক্ষেত্রেই শাসকগোষ্ঠীর আদর্শের আসল চেহারা উন্মোচিত করে।”

সম্প্রতি, মারাঠা রাজা ছত্রপতি শিবাজি মহারাজের বংশধর ও বিজেপির সাতারা সংসদ সদস্য উদয়নরাজে ভোঁসলে সম্রাট আওরঙ্গজেবের সমাধিটি ভেঙে ফেলার দাবি করেন। তিনি বলেন, “কী প্রয়োজন... জেসিবি মেশিন পাঠিয়ে তার সমাধি ভেঙে ফেলা উচিত... তিনি ছিলেন একজন চোর এবং লুটেরা (ডাকাত)।”

তিনি আরও বলেন, “যারা আওরঙ্গজেবের সমাধিতে যায় এবং শ্রদ্ধা জানায় তারা তার ভবিষ্যৎ (আশ্রয়) হতে পারে। তাদের উচিত সেই সমাধিটি তাদের নিজের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া। কিন্তু তারপরও আওরঙ্গজেবের গৌরব ও প্রশংসা আর সহ্য করা হবে না।”

এর আগে গত ৪ মার্চ বিজেপি নেতা নবনীত রানাও সম্রাট আওরঙ্গজেবের সমাধি ভেঙে ফেলার দাবি করেছিলেন। সাবেক এই বিজেপি সংসদ সদস্য বলেন, “আমি মহারাষ্ট্র সরকারকে অনুরোধ করতে চাই, ঠিক যেভাবে আওরঙ্গাবাদের নাম পরিবর্তন করে আমাদের ভগবান সম্ভাজি মহারাজের নামে রাখা হয়েছিল, তেমনই আওরঙ্গজেবের সমাধিও ভেঙে ফেলা উচিত।”

এরপর চলতি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে আওরঙ্গজেবের সমাধি সরানোর এই দাবির প্রতি সমর্থন জানান রাজ্যটির মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফড়নবিশ। তবে সেসময় তিনি বলেন, এটি আইনের মাধ্যমেই করতে হবে। কারণ পূর্ববর্তী কংগ্রেস সরকার এই সমাধিসৌধটি আর্কেওলজিক্যাল সোসাইটি অব ইন্ডিয়ার (এএসআই) কাছে হস্তান্তর করেছিল এবং স্থানটি ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক সংস্থা কতৃক সুরক্ষিত।

মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “আমরা সকলেই ‘একই জিনিস’ চাই, তবে আপনাকে এটি আইনের কাঠামোর মধ্যে করতে হবে, কারণ এটি একটি সুরক্ষিত স্থান। কয়েক বছর আগে কংগ্রেস শাসনামলে এই স্থানটি এএসআইয়ের সুরক্ষায় দেওয়া হয়েছিল।”

প্রসঙ্গত, সম্রাট আওরঙ্গজেব ছিলেন ছয়জন মহান মুঘল সম্রাটের মধ্যে সর্বশেষ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ সম্রাট। তিনি মারা গেছেন ৩০০ বছরেরও বেশি সময় আগে। ভারতকে ১৬৫৮ সাল থেকে ১৭০৭ সাল পর্যন্ত অর্ধ-শতাব্দী কাল ধরে শাসন করেছিলেন তিনি।

মুঘল সাম্রাজ্যের ষষ্ঠ সম্রাট আওরঙ্গজেব ছিলেন একজন ধর্মপ্রাণ মুসলিম। তিনি শরিয়া আইন চালু করেছিলেন এবং তাকে বলা হয় “সর্বশেষ কার্যকর মুঘল সম্রাট”।

সম্পাদক: মো. জেহাদ হোসেন চৌধুরী
যোগাযোগ: রিসোর্সফুল পল্টন সিটি (১১ তলা) ৫১-৫১/এ, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০।
মোবাইল: ০১৭১১-৯৫০৫৬২, ০১৯১২-১৬৩৮২২
ইমেইল: [email protected], [email protected]