চারদিকে অথই জলরাশি। মাঝে সবুজ ঘেরা একটি দ্বীপ। যেন সাগরের বুকে জেগে ওঠা এক টুকরো স্বর্গ। বলছিলাম সৌন্দর্যের লীলাভূমি সোনার চরের কথা।
পটুয়াখালী জেলা শহর থেকে ১০০ কিলোমিটার দক্ষিনে রাঙ্গাবালী উপজেলায় অবস্থিত সোনার চর। উপজেলার দক্ষিণ সীমান্তে ১০ হাজার একর আয়তনের চরটি দুর্গম হলেও হৃদয় জুড়ানো সৌন্দর্য এর। বিস্তীর্ণ বনভূমির পাশাপাশি চারপাশে ১০ কিলোমিটার দীর্ঘ সমুদ্র সৈকত নিয়ে সোনার চর। ‘সাগরকন্যা’ কুয়াকাটা থেকে পূর্ব-দক্ষিণে এর দূরত্ব মাত্র ৩০ কিলোমিটার। রাঙ্গাবালী উপজেলা সদর থেকে ট্রলারযোগে মাত্র তিনঘণ্টায় যাওয়া যায় সোনার চরে।
বৈচিত্র্যময় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগের জন্য ভ্রমণপিপাসুরা ছুটে আসেন দূর দূরান্ত থেকে। এখানে রয়েছে গাছপালা, বন্য পশু-পাখি ও অপরূপ সৈকত। এছাড়া বনের মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে ছোট-বড় অসংখ্য খাল। কেওড়া, গোলপাতা, বাইন, গেওয়া, সুন্দরী, পশুর, ঝাউসহ বিভিন্ন প্রজাতির বৃক্ষের সমাহার এখানে। কান পাতলে ঝাউবাগানের বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ ভেসে আসে কানে। সাগরের জল আছড়ে পরে দীপের চারপাশের সৈকতে। শেষ বিকালে সমুদ্র সৈকতে শুরু হয় লাল কাঁকড়ার অবিরাম ছোটাছুটি।
চরটি সোনা দিয়ে তৈরি না হলেও সূর্যের প্রখর রোদে এর বালুরাশি সোনার মতোই চিকচিক করে ওঠে। আর এ কারণেই এর নামকরণ হয় সোনার চর। ২০০৪ সালে বঙ্গোপসাগরের বুক চিরে জেগে ওঠে চরটি। ধীরে ধীরে এর সৌন্দর্যের কথা ছড়িয়ে পরে চাকদিকে। শুরু হয় পর্যটকদের আগমন। ‘সোনার চর’ নামটিও ততদিনে প্রশাসনিক নামে স্থায়ীত্ব পায়।
আয়তনের দিক থেকে সুন্দরবনের পরেই এটি বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বনাঞ্চল। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিশাল সমদ্র সৈকত। ২০১১ সালের ১৬ ডিসেম্বর সরকার ২০ হাজার ২৬ হেক্টর আয়তনের এই বনভূমিকে বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষণা করে। একই বছরের ২৪ ডিসেম্বর প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। এরপর থেকেই বনায়ন শুরু করে বন কর্তৃপক্ষ।
দ্বীপটিতে বহু প্রজাতির বন্যপ্রাণীর বসবাস রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য বানর, খেঁকশিয়াল, উদবিড়াল, বেজী, বাঘডাসা, সাপ, কচ্ছপ এ দ্বীপের স্থায়ী বাসিন্দা। কখনও কখনও দু চারটা হরিণের সাথেও দেখা হয়ে যায় ভ্রমণ পিপাসুদের।
সারাদিনই পাখির কলরবে মুখর থাকে পুরো চর। বিশেষ করে শীত মৌসুমে ১০ লক্ষাধিক অতিথি পাখির সমাগম ঘটে এখানে। গাঙচিল, গাঙকবুতর, বালিহাঁস, পাতিহাঁস, সাইবেরিয়ান লাল হাঁস, পানকৌড়ি, বক, মদনটাক উড়ে বেড়ায় এখানে-সেখানে। অতিথি পাখির কলরব আর সাগরের ঢেউয়ের গর্জনে মুখর হয়ে ওঠে সোনার চরের প্রাকৃতিক পরিবেশ। বনের আশেপাশে মাছ শিকার করেন শতাধিক জেলে। এখানে চিংড়ি, ছুড়ি, লইট্টা, ফাইস্যা, মেদ, টেংরা, গুলিশা, বৈরাগী, রামচোচ, কোরাল, পোয়া, শাপলাপাতা প্রভৃতি সামুদ্রিক মাছ পাওয়া যায়।
তবে রাতে পর্যটকদের থাকার মতো কোন ব্যবস্থা নেই এখানে। তাই ইচ্ছে থাকলেও রাতের বেলা এখানে থাকতে পারেন না পর্যটকরা। এ কারণে সোনা চরে রাতের সৌন্দর্য অধরাই রয়ে গেছে। এখানে নেই যাতায়াত ও খাওয়া-দাওয়ার সুব্যবস্থা। বছরখানেক আগে ঢাকা থেকে চর মোন্তাজে একটি লঞ্চ সার্ভিস চালু হলেও সেটি কিছুদিন পরে বন্ধ হয়ে যায়। তবে চরের সৌন্দর্য ও বন রক্ষনাবেক্ষণের জন্য এখানে বন বিভাগের একটি বিট অফিস আছে।
মোন্তাজের ফরেস্ট রেঞ্জার অমিতাভ বসু বলেন, ‘চর সংরক্ষণে পর্যাপ্ত জনবলের সংকট রয়েছে। এছাড়াও যাতায়াতের জন্য লঞ্চ সেবা, পরিবেশ রক্ষায় সৌচাগার সেবা চালু করা প্রয়োজন।’
এ বিষয়ে পটুয়াখালী উপকূলীয় বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. আমিনুল ইসলাম সময়নিউজকে বলেন, ‘সোনার চর অত্র এলাকার জন্য এক সম্ভাবনাময় পর্যটনকেন্দ্র। তাই এর যথাযথ ব্যবস্থাপনা ও রক্ষনাবেক্ষণ জরুরি। সোনার চরে যাতায়াতের জন্য ট্রলার বা স্পিডবোট সেবা চালুকরণ, পর্যটকদের জন্য যাত্রী ছাউনি, রেস্টুরেন্ট ও আবাসিক হোটেল স্থাপনের প্রয়োজনীয়তার কথা জানান এই কর্মকর্তা।’