8478

04/19/2024 ২১ এর উপাখ্যান

২১ এর উপাখ্যান

সানজিদা আকতার আইরিন

২২ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ০০:৩৬

দুই শত বছরের দাসত্বের শৃঙ্খলা মুক্ত হয়ে ধর্মভিত্তিক অবস্থানের প্রেক্ষিতে বৃটিশ ভারত ভাগ হয়ে ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠন করে। এর মধ্যে যে দুটি ভূখন্ড নিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠন হয়েছিলো তাদের মধ্যকার দূরত্ব যেমন ২০০০ কিলোমিটার তেমনি ভাষাগত পার্থক্য ও বিস্তর। ভিন্ন ভাষার জাতি সত্ত্বাকে এক করতে চাওয়ার দরুণ শুরু হয় ভাষাগত অধিকারের অর্ন্তদন্দ। ভাষাগত অধিকারের আন্দোলন দানা বাঁধতে শুরু করে। ভাষা সৈনিক আব্দুল মতিন ও আহমদ রফিক এর লেখা “ভাষা আন্দোলন, ইতিহাস ও তাৎপর্য” বই-এ লিখেছেন, “ভাষা আন্দোলনের প্রাথমিক ভাবে লড়াইটা ছিলো সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে।” ধীরে ধীরেই তা ছড়িয়ে পড়ে ছাত্র ও সমস্ত বুদ্ধিজীবি সমাজে। কয়েক দশক পূর্ব হতেই বাঙ্গালী সাহিত্যিক ও রাজনীতিবিদদের মধ্যে চারটি ভাষা বাংলা, ইংরেজি, উর্দু ও আরবি ভাষার ব্যাবহার ও গুরুত্বের পক্ষে বিপক্ষে তর্ক বিতর্ক লেগেই থাকতো।

১৯৪৭ সালে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ডক্টর জিয়াউদ্দীন আহমেদ উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব করেন। বুদ্ধিজীবি সমাজে আবারও বাংলা ভাষার অধিকারের ঝড় বইতে শুরু করে। ১৯৪৭ এর দেশ ভাগের কয়েক মাসের মধ্যেই পাকিস্তানের প্রথম মুদ্রা, ডাকটিকিট, ট্রেনের টিকিট ও পোষ্টকার্ড থেকে বাংলা বাদ দিয়ে উর্দু ও ইংরেজি ব্যাবহার করা হয়। এ সিদ্ধান্ত পাকিস্তান পাবলিক কমিশনে ঘোষণার পর ঢাকার ছাত্র ও বুদ্ধিজীবী সমাজে উত্তেজনা ও বিক্ষোভ সমাবেশ হতে থাকে। তখন কমিশনের বাঙালী কর্মকর্তারা সরকারি কাজে বাংলা ভাষা প্রয়োগের দাবীতে বিক্ষোভ করেছিলেন। হঠাৎ করে উর্দুকে মাতৃভাষা ঘোষণার মধ্য দিয়ে পুর্ব পাকিস্তানে আন্দোলন তরান্বিত হয়। ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসেই ঢাকা ইউনিভার্সিটির ছাত্র ও অধ্যাপক মিলে “তমুদ্দুন মজলিস” গঠন করে- যারা রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে নানা সভা সমিতি আয়োজন করে। তখন রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ও গঠন করে।

তৎকালীন মিল্লাত পত্রিকার সম্পাদকীয়তে মাতৃভাষার পরিবর্তে অন্য কোন ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করাকে বড় দাসত্ব বলে উল্লেখ করে প্রতিবাদ জানিয়েছিল। “আজাদি” পত্রিকায় লেখক ও সাংবাদিক আব্দুল হক লিখেছিলেন, “উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যেকটি উর্দু শিক্ষিতই চাকুরী যোগ্যতা লাভ করবেন এবং প্রত্যেকটি বাংলা ভাষীই চাকুরির অনুপযুক্ত হয়ে পড়বেন”। তৎকালীন সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবী মহল উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন যে আমাদের উপর বাংলার পরিবর্তে উর্দু চাপিয়ে দিলে বাংলাভাষীদের পরবর্তী প্রজন্ম অশিক্ষত হয়ে পড়বে। থেমে যাবে সাহিত্য চর্চা। সমৃদ্ধ হতে পারবেনা বাংলার সংস্কৃতি এমন নানা চিন্তা থেকে ভাষা নিয়ে আন্দোলনের ঝংকার উঠতে শুরু করে।

১৯৪৮ সালে ২১ মার্চ মোহম্মদ আলী জিন্নাহ পুর্ব পাকিস্তান পরিদর্শন কালে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে ভাষণে স্পষ্টই ঘোষণা করেন যে “উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা”। সেই সমাবেশেই উপস্থিত অনেকেই রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই বলে প্রতিবাদ জানিয়ে ছিলেন।

জিন্নাহর মৃত্যুর পরেও রাষ্ট্রভাষা নিয়ে নানারকম প্রস্তাব পাল্টা প্রস্তাব চলতে থাকে। দেশ ভাগের পর থেকেই বাঙ্গালীরা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার বিরোধীতা করে আসছে। ১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি পাকিস্তানের এসেম্বেলিতে উর্দুকেই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়। খাজা নাজিমুদ্দিন ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি ঢাকা সফরে এসে পল্টনে এক সমাবেশে জিন্নাহর কথার পূণরাবৃত্তি করেন। একই ভাবে স্লোগান ওঠে রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।

পুর্ব বঙ্গের অধিবাসী হওয়া সত্বেও নাজিমুদ্দিনের এমন বক্তব্য বিরুপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে এবং রাজনৈতিক অঙ্গনে উত্তাপ ছড়াতে থাকে। তখন ভাসানীর নেতৃত্বে গঠিত সম্মেলনে অংশ নেয় রাজনৈতিক ও সামাজিক সাংস্কৃতিক কর্মী এমনকী পেশাজীবীরাও। এ সম্মেলনের পক্ষ হতে ঘোষিত হয় ২১ ফেব্রুয়ারি সাধারণ ধর্মঘট। এই ধর্মঘট প্রতিহত করতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও এর আশপাশ এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। কিন্তু অমিত তেজি ছাত্রদের দমানো সহজ নয়। তারা এই ১৪৪ ধারা লঙ্ঘন করে মিছিল বের করে। সেই মিছিলের গুলি থেকেই জন্ম হয় মহান শহিদ দিবসের।

সেদিন ঢাকা মেডিকেল কলেজের কাছেই শিক্ষার্থীদের উপর গুলি বর্ষণ হয়েছিলো। ঢাকা মেডিকেল কলেজের জরুরী বিভাগে কর্মরত মেডিকেল ছাত্র মাহাফুজ হোসেনের বিবিসি বাংলায় দেয়া স্বাক্ষাৎকার থেকে জানা যায়, ২১ ফেব্রুয়ারি দুপুর নাগাদ ছাত্রদের উপর গুলি চালায় পুলিশ। সাথে সাথে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। এর মধ্যে কপালে গুলিবিদ্ধ রফিককে সাথে সাথে মৃত বলে ঘোষণা করা হয়। পরে উরুতে গুলিবিদ্ধ বরকতও মারা যান।

২১ তারিখের ছাত্র বিদ্রোহের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকে ২২ ও ২৩ তারিখে ছাত্র, শ্রমিক, সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবী, সাধারণ জনতা পুর্ণ আন্দোলনে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে। ২২ ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে শহিদ হন শফিউর রহমান শফিক, রিক্সা চালক আউয়াল এবং অলিউল্লাহ নামের এক কিশোর। ২৩ ফেব্রুয়ারি ফুলবাড়িয়া ছাত্র জনতার মিছিলে অত্যাচার ও নিপিড়ন চালায় পুলিশ। শহিদদের সঠিক সংখ্যা জানা না গেলেও পুলিশের গুলিতে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার এবং শফিউরের নাম ভাষা আন্দোলন নিয়ে লেখা বিভিন্ন বইয়ে উঠে এসেছে।

ভাষা আন্দোলনে শহীদদের স্মৃতিকে অম্লান রাখতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোষ্টেল প্রাঙ্গনে রাতারাতি ছাত্রদের দ্বারা গড়ে ওঠে শহিদ মিনার যা ২৪ ফেব্রুয়ারি শফিউর রহমানের পিতা উদ্বোধন করেন। ২৬ ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন দৈনিক আজাদ পত্রিকার সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দীন।

ক্রমবর্ধমান গণ আন্দোলনের মুখে নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয়ে ১৯৫৪ সালের ৭ মে পাকিস্তান গণ পরিষদে বাংলা অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গৃহীত হয়। ১৯৫৬ সালের পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান প্রণীত হলে ২১৪ নং অনুচ্ছেদে বাংলা ও উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উল্লেখ করা হয়।

এই ঘটনার মধ্য দিয়েই নতুন স্বাধীন রাষ্ট্রের বীজ বপন হয় এবং অবশেষে বহু কষ্টে অর্জিত হয় আমাদের স্বাধীনতা ও নিজস্ব পতাকা। সে কারনেই প্রতিবছর আমরা গর্বের সাথে, শ্রদ্ধার সাথে ভাষা শহীদদের স্মরণ করি। রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় পালন করি শহিদ দিবস। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারসহ সারাদেশে অসংখ্য শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে তাদের সম্মানিত করে থাকি। আমাদের এই শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও অনুভুতিকে আরো সমৃদ্ধ করেছে ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো ঘোষিত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণার মাধ্যমে। নিজ ভাষার অধিকার বুঝে পেয়েছি বলে ভাষা শহীদদের নিয়ে আজও আমরা গর্বিত।

 

সম্পাদক: মো. জেহাদ হোসেন চৌধুরী
যোগাযোগ: রিসোর্সফুল পল্টন সিটি (১১ তলা) ৫১-৫১/এ, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০।
মোবাইল: ০১৭১১-৯৫০৫৬২, ০১৯১২-১৬৩৮২২
ইমেইল: [email protected], [email protected]