মঙ্গলবার, ১৭ই সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১লা আশ্বিন ১৪৩১


উত্তাল পশ্চিমবঙ্গ, তবে কি মমতার সময় ফুরিয়ে এলো?


প্রকাশিত:
৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৩:০১

আপডেট:
৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৩:০৪

ছবি সংগৃহিত

আরজি কর ইস্যুতে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ এখনো উত্তাল। ২০২৪ সালের ৯ আগস্ট মেডিকেল কলেজটির সেমিনার হল থেকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ ও পরবর্তীতে হত্যার শিকার চিকিৎসকের মরদেহ উদ্ধারের পর থেকে শুরু হওয়া আন্দোলন কলেজের গণ্ডি অতিক্রম করে ছড়িয়ে পড়েছে গোটা ভারতে।

আন্দোলনকারীরা প্রবল প্রতিবাদে সরব হয়েছেন, রাজপথ কাঁপিয়েছেন এমনকি আন্দোলনের কিছু জনপ্রিয় শ্লোগানের মধ্যে ছিল ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’, ‘দফা এক দাবি এক, মমতার পদত্যাগ’ ইত্যাদি। এই সবকিছু ছাপিয়ে কলকাতার আন্দোলনের যে রূপটি অবাক করার মতো তা হচ্ছে, এখানে আন্দোলনকারীরা তাদের আন্দোলনের মধ্যে কোনো রাজনৈতিক দলকে অনুপ্রবেশ করতে দেয়নি।

৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪ কলকাতার দৈনিক আনন্দবাজার অনলাইনের একটি প্রতিবেদন ছিল এরকম, ‘সোমবার রাতে ফিয়ার্স লেনে জুনিয়র ডাক্তারদের অবস্থানে গিয়েছিলেন প্রাক্তন বিচারপতি তথা অধুনা বিজেপি সাংসদ অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। রাতজাগা আন্দোলন থেকে আওয়াজ ওঠে অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় গো ব্যাক। এক জুনিয়র তার কাছে গিয়ে বলেন, আপনি চলে যান, এখানে দাঁড়াবেন না।’

একইভাবে তৃণমূল কংগ্রেস নেতা কুনাল ঘোষ যখন জানান দেন যে, ‘পুলিশের সাথে আন্দোলনকারীদের আলোচনার জট নিরসনে তিনি ভূমিকা পালন করেছেন, বিষয়টি ডাক্তারদের পক্ষ থেকে নাকচ করে দিয়ে বলা হয়, এটা সর্বৈব মিথ্যা, তাদের আন্দোলনে রাজনীতির প্রবেশ নিষেধ।’

কলকাতার রাস্তায় এভাবে প্রতিদিন আন্দোলনকারীদের সমর্থনে জড়ো হচ্ছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবর্গ। এরকম সিপিএম এক নেতার ভাষণের একপর্যায়ে একজন নারী বলে ওঠেন, ‘আপনারা রাজনীতি এবং দলাদলির কথা কেন বলছেন? ধর্ষণকাণ্ডের বিচারের কথা কই?’ আন্দোলনকারীদের সমর্থনে জল দিয়ে সহায়তা করতে চাওয়া একজন রাজনীতিককে জানিয়ে দেওয়া হয় যে তাদের তহবিলে প্রচুর জল রয়েছে, তাদের জলের প্রয়োজন নেই।’

এভাবেই একটি আন্দোলনকে সর্বজনীন করে তোলা হচ্ছে কলকাতায়, যার রেশ ছড়িয়ে পড়ছে ভারতের অপরাপর অঞ্চলগুলোয়ও। কলকাতায় চিকিৎসকের মৃত্যু নিয়ে ভারতের মুম্বাই, পুনে, হায়দ্রাবাদ এবং দিল্লির মতো শহরগুলোয়ও জড়ো হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। সবার মধ্যে একটাই কথা তা হচ্ছে, ভয়হীন চিত্তে বেঁচে থাকার স্বাধীনতা চান মানুষ।

কিছুদিন ধরে কলকাতার আন্দোলনের যে ধরন ছিল সেটা থেকে কেন্দ্রের শাসকদের একটা ধারণা হয়ে থাকতে পারে যে এই বুঝি মুখ্যমন্ত্রী মমতার সময় ফুরিয়ে এলো। চিকিৎসকের মৃত্যু নিয়ে জনগণের মধ্যে যে ক্ষোভ, এখন রাজনৈতিকভাবে সজোরে ধাক্কা দিলেই পতন অনিবার্য।

পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে এই ক্ষেত্রে মমতার পতন নিয়ে বিরোধীরা যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, সে আশায় যেন অনেকটা গুড়েবালি পড়ার মতো অবস্থা। সাধারণের এই আন্দোলন বাস্তবিক অর্থে একটা নাগরিক আন্দোলনে রূপলাভ করেছে, যার অর্থে কোনো নির্দিষ্ট শাসক দল নয়, সার্বিকভাবে গোটা ব্যবস্থার একটা আমূল সংস্কার প্রয়োজন, যাকে এককথায় বলা যায় সুশাসন, যে বিষয়টির বড়ই অভাব রয়েছে।

যদিও এই অব্যবস্থাপনার বেড়ে ওঠা একটা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়েই। তবে এক্ষেত্রে তৃণমূল সরকারের পতন এবং এর মধ্য দিয়ে আরেকটি সরকার গঠনের মধ্য দিয়েই রাতারাতি অবস্থার কোনো উন্নতি ঘটবে না।

ব্যবস্থার পরিবর্তন করতে হলে গোটা রাজনৈতিক ব্যবস্থার ভেতর থেকেই বড় ধরনের সংস্কার আসতে হবে। আর একারণেই চিকিৎসকের মৃত্যু ছুঁয়ে গেছে গোটা ভারতে। এক চিকিৎসকের মৃত্যু যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে কত দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা, নিরাপত্তাহীনতা এবং কত অমানবিকতার গল্প লুকিয়ে রয়েছে!

কলকাতায় বিরোধী দলের গত সপ্তাহের বন্ধ কর্মসূচি নিয়ে মমতার পক্ষ থেকে চরম হুশিয়ারি বাক্য উচ্চারণ করে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে যে কেন্দ্রের পক্ষ থেকে বিজেপি প্রদেশের অপরাপর দলগুলো নিয়ে যে আন্দোলন পরিচালনা করছে, এর মধ্য দিয়ে সরকারের পতন ঘটানো সম্ভব নয়।

এ বিষয়ে মমতার পক্ষ থেকে কঠোরভাবে জানিয়ে দেওয়া হয় এভাবে, ‘বাংলায় যদি আগুন লাগান তাহলে আসামও থেমে থাকবে না, উত্তর-পূর্বাঞ্চলও থেমে থাকবে না। উত্তরপ্রদেশ, বিহার, উড়িষ্যা, ঝাড়খণ্ডও থেমে থাকবে না।’ মোদিকে উদ্দেশ্য করে তিনি আরও বলেন, ‘আপনার চেয়ার আমরা টলমল করে দেবো। চেয়ার দখলের লড়াই হচ্ছে? ক্ষমতা থাকলে ভোটে যাও।’

মমতার এই শেষোক্ত কথাগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ, অর্থাৎ ভোটের মধ্য দিয়েই ক্ষমতার পালাবদল সম্ভব। আন্দোলন করে সবক্ষেত্রে সরকারের পতন ঘটানো যায় না এবং তা সমীচীনও নয়। তবে ভোট হতে হবে ইতিবাচক, যেখানে জনগণের ভোটাধিকার থাকবে এবং একটি শান্তিপূর্ণ নির্বাচন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নির্বাচিত দল সরকার গঠন করবে।

পশ্চিমবঙ্গের সাম্প্রতিক আন্দোলনের সাথে রাজনৈতিক দলগুলোর সম্পৃক্ততার মধ্য দিয়ে সরকার পরিবর্তনের প্রচেষ্টা সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের আন্দোলনের সাথে তুলনা করে তিনি আকারে ইঙ্গিতে জানিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন যে এটা বাংলাদেশ নয় এবং বাংলাদেশের সাথে তুলনা করাও ঠিক হবে না। এর মধ্য দিয়ে কার্যত যে বিষয়টি বলার চেষ্টা করা হয়েছে তা হলো বাংলাদেশে মাত্র ৭ মাস আগে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে প্রায় ১৫ বছর ধরে যে সরকারটি ক্ষমতাসীন ছিল, তারা আদতে নির্বাচিত সরকার নয়।

সুতরাং যা বাংলাদেশে সম্ভব সেটা ভারতে চর্চা করতে গেলে গণতন্ত্রের জন্যও বিপজ্জনক হবে। এখন এই অবস্থায় এসে মমতা বিরোধী প্রতিবাদে পশ্চিমবঙ্গের অপরাপর রাজনৈতিক দলগুলোও যে সত্যিকার অর্থে মমতার পদত্যাগ চাইবেন, আমার কাছে এমনটি মনে হয় না।

এর চেয়ে বরং যে বিষয়টি অনুধাবন করতে পারছি, সেটা হচ্ছে আগামী বছর অনুষ্ঠিতব্য রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তৃণমূল বিরোধীরা একজোট হয়ে দলটির শাসনক্ষমতার ইতি টানার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।

তবে সবকিছুর বাইরে রাজনীতি এবং গণতন্ত্রকে অটুট রাখতে তাদের যে প্রচেষ্টা, সেটা দৃশ্যমান। সেই সাথে ক্রমবিকাশমান নাগরিক আন্দোলন, যা এখনো গর্জে উঠছে, এগুলো যেন রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি নতুন নতুন বার্তা দিচ্ছে, যার মধ্য দিয়ে ভারতে আগামী দিনে গণতন্ত্র আরও বিকাশমান হবে দলে ধারণা করতে পারি।

লেখক: অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:




রিসোর্সফুল পল্টন সিটি (১১ তলা) ৫১-৫১/এ, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০।
মোবাইল: ০১৭১১-৯৫০৫৬২, ০১৯১২-১৬৩৮২২
ইমেইল : [email protected]; [email protected]
সম্পাদক : লিটন চৌধুরী

রংধনু মিডিয়া লিমিটেড এর একটি প্রতিষ্ঠান।

Developed with by
Top