বুধবার, ২রা এপ্রিল ২০২৫, ১৮ই চৈত্র ১৪৩১

Shomoy News

Sopno


মণিপুরে সহিংসতা, ভারতের দুশ্চিন্তা কি বাড়ছে?


প্রকাশিত:
১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৩:৫৩

আপডেট:
২ এপ্রিল ২০২৫ ০০:১৫

ছবি সংগৃহিত

ভারতের মণিপুর রাজ্যের পরিস্থিতি অন্তত একবছর ধরেই অশান্ত। মাঝে কিছুটা সময় বিরতির পর সম্প্রতি আবারও উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে। পরিস্থিতি এখন এমন পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে যে, রাজ্যটির সাধারণ মানুষের পক্ষ থেকে মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করা হচ্ছে।

বেসামরিক মানুষের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে সাধারণ মানুষের ক্ষোভ প্রশমনে কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে আর্থিক সহায়তা করার পরও পরিস্থিতির তেমন উন্নতি হয়নি। নিরাপত্তা সংকট ভাবিয়ে তুলেছে সবাইকে। রাজ্যের দুটি ব্যাটালিয়নের অস্ত্রাগার থেকে লুণ্ঠিত অস্ত্র উদ্ধারে পুলিশ এবং যৌথবাহিনী কাজ শুরু করলেও অগ্রগতি সামান্যই।

এখন প্রশ্ন, কী কারণে রাজ্যটির পরিস্থিতি আজ এই অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে? অনেকেই এর জন্য প্রতিবেশী, বিশেষ করে চীন এবং মিয়ানমারের পক্ষ থেকে এর পেছনে উসকানি থাকতে পারে বলে মনে করলেও প্রথমেই অভ্যন্তরীণ পর্যায়ে এমন কোনো অবস্থা বিরাজমান রয়েছে কি না, যা এধরনের ঘটনার পেছনে ভূমিকা রাখতে পারে সেটা মূল্যায়ন করা জরুরি।

আমরা যদি একটু গভীরে গিয়ে দেখি, তাহলে দেখবো সাম্প্রতিক সহিংসতায় মেইতেই জাতিগোষ্ঠীর সাথে কুকিদের সংঘাত এখানে মুখ্য, তবে ক্ষেত্রবিশেষে কুকিদের সাথে রয়েছে নাগা জাতিগোষ্ঠীর একটা উল্লেখযোগ্য অংশ। সাম্প্রতিক হামলায় যে জায়গাটিতে দুজন নারীর মৃত্যু হয়, তার পাশেই রয়েছে কুকি জনবহুল পার্বত্য জেলা কাংপোকপি। এর কয়েকদিন আগে এক প্রবীণ ব্যক্তিসহ কয়েকজন সশস্ত্র হামলায় নিহত হন, যারা মেইতেই সম্প্রদায়ভুক্ত বলে জানা যায়।

আর এর মধ্য দিয়েই একটা ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, এসবের পেছনে রয়েছে কুকিরা। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে হামলায় দু'পক্ষই ড্রোন, আরপিজি (রকেটচালিত বন্দুক, যা যুদ্ধের সময় ব্যবহার করা হয়) ক্ষেপণাস্ত্রসহ যেসব ভারি অস্ত্র ব্যবহার করেছে সেসবের উৎস কোথায়?

এর উত্তরে স্রেফ এটাই বলা যায় যে বিশ্বে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে যখন সশস্ত্র সংঘাতের পরিস্থিতির উদ্রেক ঘটে তখন অস্ত্রের জোগান অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক উভয়ভাবেই ঘটতে পারে। তবে সংঘাতের পরিস্থিতি অভ্যন্তরীণভাবে নিয়ন্ত্রণ করে শান্তি প্রতিষ্ঠা যতক্ষণ সম্ভব না হয়, ততক্ষণ জাতিগত সংঘাত নির্মূলে রাষ্ট্রের ভূমিকা গৌণই থেকে যায়।

অভ্যন্তরীণভাবেই ভারতের উত্তর-পূর্বের সেভেন সিস্টার নামে খ্যাত সাতটি রাজ্যের সার্বিক নিরাপত্তা ভারতের জন্য সবসময় দুশ্চিন্তার কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়ে এসেছে। কেন্দ্রের সাথে যোগাযোগের ক্ষেত্রে এক্ষেত্রে বাংলাদেশ তাদের জন্য বাফার স্টেট হিসেবে কাজ করায় বৈদেশিক হস্তক্ষেপের সুযোগ থেকেই যায়। সে বিষয়টি নিয়ে আলোচনার পূর্বে অভ্যন্তরীণ আর কোনো উপাদান এই সংঘর্ষের পেছনে কাজ করেছে কি না এবং করে থাকলে সেসবের ধরন কী এটাও আলোচনার দাবি রাখে।

যতদূর জানা যায়, মণিপুরের সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতিগোষ্ঠী হিন্দু মেইতেই, যারা বৈষ্ণব এবং মোট জনগোষ্ঠীর ৬৫ শতাংশ। অন্যদিকে রাজ্যটির ৯০ ভাগ পাহাড়ি অঞ্চলে বসবাস করে নাগা এবং কুকিসহ ৩৩টি উপজাতি, যারা ঐতিহাসিকভাবে সমান সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হওয়ার কারণে তপসিলিভুক্ত হিসেবে বিশেষ সুবিধা পেয়ে আসছিল।

মেইতেইরা সরকারি চাকরিতে এর মধ্য দিয়ে পিছিয়ে যায় এবং নিজেদের তপসিলিভুক্ত করার দাবি জানিয়ে আসছিল কয়েকবছর ধরে। তারা যেহেতু তপসিলিভুক্ত নয়, উপজাতি অধ্যুষিত পাহাড়ি অঞ্চলগুলোয় স্বাধীনভাবে বসবাস এবং জায়গা সম্পত্তির মালিকানা থেকেও তারা বঞ্চিত হয়ে আসছিল। তাদের এই দাবিকে তীব্রভাবে বিরোধিতা করে আসছিল কুকিরা, কারণ এর মধ্য দিয়ে তারা তাদের দখল হারানোর শঙ্কা করতে থাকে।

কুকিরা সংখ্যায় কম থাকলেও বিশেষ সুবিধাভোগী ছিল এবং খ্রিস্টান ধর্মের অনুসারী হওয়ার কারণে তাদের পেছনে মিশনারিগুলোর পক্ষ থেকে বিশেষ সুবিধা প্রদান করা হচ্ছিল বলেও মনে করেন অনেকেই। ফলে সংখ্যায় কম হলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোয় চাকরি এবং আর্থিকভাবে তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ মেইতেইদের তুলনায় এগিয়ে যাচ্ছিল।

সুতরাং মেইতেইদের পক্ষ থেকে ক্রমউচ্চারিত দাবিসমূহ, কুকিদের সুবিধাসমূহ এবং এসব নিয়ে উভয়পক্ষের পাল্টাপাল্টি ক্ষমতা এবং প্রভাবের জায়গাটিতে পোক্ত করার প্রচেষ্টা সাম্প্রতিক সময়ের উত্তেজনার পেছনে বড় কারণ মনে করা যেতে পারে।

এবার আসা যাক, এর পেছনে অন্য কিছু, অর্থাৎ বাইরের কোন ধরনের বিষয় কাজ করেছে। এক্ষেত্রেও ইতিহাসের আশ্রয় থেকে যা জানা যায়, এর বিশ্লেষণে বলা যেতে পারে যে, মিয়ানমারের উত্তর-পশ্চিম পর্বতভূমিতে দেশটির চিন রাজ্য অবস্থিত, যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ চিন জনগোষ্ঠীর নামানুসারে রাজ্যটির নামকরণ ঘটেছে, সাথে রয়েছে উল্লেখযোগ্য কুকি জনগোষ্ঠী।

রাজ্যটির সঙ্গে ভারতের মিজোরামের সীমান্ত রয়েছে এবং মিজোরামের মিজো এবং কুকি জনগোষ্ঠীর সাথে কুকি এবং চিন জনগোষ্ঠীর গভীর যোগাযোগ রয়েছে। এভাবেই তারা ছড়িয়ে পড়েছে মিজোরাম, মণিপুর নাগাল্যান্ড এবং বাংলাদেশের রাঙামাটি এবং বান্দরবান অংশে। আর এভাবেই মিজোরাম, মণিপুর এবং মিয়ানমারের নিজেদের সমস্যার সাথে কুকি-চিন এক নতুন সমস্যা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।

মিয়ানমারের সাম্প্রতিক সময়ে সামরিক বাহিনীর সাথে যুদ্ধের ক্ষেত্রে আরাকান আর্মি, মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়েন্স আর্মি এবং তাং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি—এই তিনের সমন্বয়ে গঠিত থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সের সাথে অপরাপর যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোষ্ঠীগুলো সম্পৃক্ত রয়েছে এর মধ্যে কুকি-চিন উল্লেখযোগ্য।

দীর্ঘদিন ধরে চাঁদাবাজি, লুটপাট, অপহরণের বিনিময়ে মুক্তিপণসহ নানাবিধ অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে সংগঠনটির সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়ে আসছিল, যার সাম্প্রতিক উদাহরণ কয়েকমাস আগে আমরাও আমাদের পার্বত্য অঞ্চলে দেখেছি। এর মধ্য দিয়ে আজকের অশান্ত মণিপুরের যোগসূত্র থাকাটা স্বাভাবিক।

একইসাথে ভারতের রাজনীতিতে যেহেতু বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকার এখনো বহাল রয়েছে, হিন্দুত্ববাদ বিভিন্নভাবেই সেখানে একটা গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। কুকিদের আধিপত্যের লাগাম টেনে ধরতে মেইতেইদের পক্ষ থেকে চালিয়ে আসা দাবি আদায়ে ব্যর্থতা তাদের হতাশ করেছে, উপরন্তু ক্রমাগতভাবে আক্রান্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে এবার তারা রাজ্য সরকারের ওপর বেশ ক্ষুব্ধ। সেই সাথে কেন্দ্রের ওপরও।

উল্লেখ্য যে, সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হয়ে যাওয়া লোকসভা নির্বাচনে সাতটি রাজ্যের মধ্যে মণিপুর, মেঘালয়, মিজোরাম এবং নাগাল্যান্ড—এই চারটি রাজ্যের জন্য বরাদ্দ লোকসভার ৬টি আসনের সবগুলো হারিয়েছে বিজেপি, আগেরবার, অর্থাৎ ২০১৯ সালে তারা পেয়েছিল ৫টি। এদিক বিবেচনায় আমরা এটাও ধরে নিতে পারি যে দেশটির অভ্যন্তরীণ রাজনীতির একটা প্রভাব এসে পড়ে থাকতে পারে সাম্প্রতিক সংঘাতে।

তবে পরিস্থিতি যাই হোক না কেন মণিপুরের এই মুহূর্তের সংকট মোকাবিলা করতে হলে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যে আসা খুব গুরুত্বপূর্ণ, যা ভারতের মতো গণতান্ত্রিক দেশ সবসময়ই ধরে রেখেছে। সে বিবেচনায় ধরেই নেওয়া যায় যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ভারত সঠিক করণীয় কাজটি করতেই সক্ষম হবে।

লেখক: অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:




রিসোর্সফুল পল্টন সিটি (১১ তলা) ৫১-৫১/এ, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০।
মোবাইল: ০১৭১১-৯৫০৫৬২, ০১৯১২-১৬৩৮২২
ইমেইল : [email protected]; [email protected]
সম্পাদক : লিটন চৌধুরী

রংধনু মিডিয়া লিমিটেড এর একটি প্রতিষ্ঠান।

Developed with by
Top