জলমহাল রক্ষায় আমরা কতখানি আন্তরিক?
প্রকাশিত:
১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১১:০৮
আপডেট:
১২ মার্চ ২০২৫ ১০:৪০

নদীখেকো, বনখেকো, পাহাড়খেকোদের কাছে জলমহাল খেয়ে ফেলা তুলনামূলক অনেক সহজ। জলমহাল আমাদের দেশে দুর্বৃত্তরা খাবে না এটি মনে করার কোনো কারণ নেই। ফলে দিনের পর দিন কমছে আমাদের জলমহালের সংখ্যা অথবা পরিমাণ।
ভূমির গঠন এবং এ অঞ্চলের জলবায়ুজনিত কারণে এদেশে লাখ লাখ জলাশয় প্রাকৃতিকভাবেই সৃষ্টি হয়েছে। এগুলোর সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে আছে অগণিত প্রাণের সম্পর্ক। একইভাবে এসব জলাশয়ের সাথে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত এ অঞ্চলের মাটির গঠন।
জলাশয় সৃষ্টির বিভিন্ন কারণ আছে। যেমন একটি নদী যখন প্রবাহিত হয় তখন প্রস্থের মাপ একরূপ থাকে না। একেক স্থানে একেক রকম হয়। তার গতিপথ তথা পানির স্রোত, মাটির গঠন সবকিছুর ওপর নির্ভর করে নদী তার প্রয়োজন মতো প্রস্থ তৈরি করে নেয়। এভাবেই একটি প্রবহমান নদীর ভেতরে অসংখ্য গভীর এবং অধিক প্রস্থের স্থান তৈরি হয়।
যখন নদী তার গতিপথ পরিবর্তন করে তখন তুলনামূলক কম গভীর এবং কম প্রস্থের অংশগুলো সমতলের সাথে একীভূত হলেও গভীর এবং অধিক প্রস্থের অংশগুলো থেকে যায়। কোনো এলাকায় ওই অংশগুলো ‘কুড়া’ বলে, কোথাও ‘দহ’ বলে।
নদীর ইতিহাসের দিকে তাকালেই আমরা বুঝতে পারি অতীতে কত বিচিত্র ছিল দেশের নদীগুলো। আজ যেখানে তিস্তা দেখছি এ তিস্তা আড়াইশো বছর আগে সেখানে ছিল না। ব্রহ্মপুত্রের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে তা বদলে গেছে। এসব বিবেচনায় নিয়ে হাজার হাজার বছরে এসব নদীর কতবার গতি পরিবর্তন হয়েছে তা বলা কঠিন এবং অসম্ভবও বটে।
আমাদের দেশে মৌসুমি বৃষ্টিপাত হয়। এই বৃষ্টিপাত আমাদের দেশের অধিকাংশ নদী এবং জলমহালের প্রাণ। অনেক নদী আছে যে নদীগুলো আমাদের বর্ষার বৃষ্টিপাত থেকে সৃষ্টি হয়েছে। এরকম একটি নদীর কথা বলি—তাহলে বোঝা যাবে কীভাবে জলাশয় তথা বিলের সৃষ্টি হয়েছে।
বাংলাদেশ-ভারত অভিন্ন স্বীকৃত ৫৭টি নদীর একটি নদী যেটি বাংলাদেশে সৃষ্টি হয়ে ভারতে গেছে। তার নাম কুলিক নদী। এ নদীটি ঠাকুরগাঁও জেলায় উৎপন্ন হয়ে ভারতে প্রবেশ করেছে। এ নদীটির উৎসস্থলে গেলে দেখা যাবে সেখানে একটি বিল আছে। ওই বিলে কয়েকটি এলাকার পানি এসে পড়ে। তারপর একটি ক্ষীণ স্রোত সৃষ্টি হয়েছে।
এই স্রোত ক্রমে ভাটিতে গেলে আরও নতুন নতুন এলাকার পানি গ্রহণ করেছে এবং বড় হয়েছে। এতে করে বোঝা যায় কয়েকটি এলাকার পানিতে সৃষ্ট নিম্নাঞ্চলের থেকে যে একমুখী স্রোত ক্রমে বাড়তে থাকে সেটি হয়ে ওঠে নদী। এ ধরনের নদীগুলোর উৎসমুখ হচ্ছে বিল। সব বিল থেকে নদী সৃষ্টি হবে এরকম কোনো কথা নেই। তবে অনেক প্রাকৃতিক খাল/নদীর উৎসমুখ এরকম।
আমাদের দেশে নদীর খাত পরিবর্তনের হাজার হাজার বছরের যে ইতিহাস তা মুছে গেলেও অনেক গভীর হয়ে থাকা জলমহালগুলো কিছু কিছু টিকে আছে। অনেক স্থানে নতুন স্রোত তৈরি না হলেও জলাবদ্ধতা দূরীকরণে ভূমিকা রাখে।
আমাদের জলমহালগুলোর অনেকটাই এসিল্যান্ড অফিস তথা জেলা প্রশাসন কার্যালয়ের কর্মকর্তাগণ ব্যক্তির নামে লিখে দিয়েছে। উচ্চ আদালতের নির্দেশনা আছে সিএস (ক্যাডাস্ট্রাল সার্ভে—Cadastral Survey) অনুযায়ী বিল তথা জলমহালগুলো উদ্ধার করতে হবে।
জলমহালগুলো ইজারা দেওয়া হয়। দুই রকম মেয়াদে লিজ দেওয়া হয়। তিনবছরের জন্য ইজারা দেয় ইউএনও এবং জেলা প্রশাসক। এর বেশি হলে ইজারা দেয় ভূমি মন্ত্রণালয়। ২০ একরের কম হলে সেগুলো ইজারা দেয় ইউএনও, ২০ একরের বেশি হলে সেগুলো ইজারা দেয় ডিসি। এই ইজারা দেওয়া থেকে সরকার যে রাজস্ব পায় তার পরিমাণ খুব বেশি হলে সোয়াশ কোটি টাকা।
নদী গবেষক শেখ রোকন লাখ লাখ কোটি টাকার বার্ষিক বাজেটের এই দেশে মাত্র সোয়াশ কোটি টাকার রাজস্ব আদায়ের জন্য দেশের জলমহালগুলো ইজারা দেওয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। এভাবে ইজারা দেওয়ার কারণে মুষ্টিমেয় জেলেরা পাচ্ছে জলমহাল। বৃহৎ সংখ্যক জেলে তার কর্ম হারাচ্ছে।
মৎস্যজীবীদের মাছ চাষের সামর্থ্য না থাকার কারণে নামে মৎস্যজীবীরা লিজ গ্রহণ করলেও বাস্তবে এগুলো ভোগ করে স্থানীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ। অনেক সময় মৎস্যজীবী সমিতি নাম দিয়ে সেখান অনেক অমৎস্যজীবীও থাকে। এক কথায় বলা যায়, জলমহাল বন্দোবস্ত দেওয়া কোনোভাবে ভালো সিদ্ধান্ত হয়নি।
সিএস রেকর্ডে নদীর ভেতরে যে অংশটুকু অনেক গভীর এবং প্রস্থে বেশি সেটুকু বিল হিসেবে রেকর্ড করেছে। দেশে যাদের হাতে নদী এবং বিল রক্ষার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তারা সেগুলো বন্দোবস্ত দেন। অর্থাৎ নদী ইজারা দেওয়া বা উন্মুক্ত জলমহাল এভাবে ইজারা দেওয়া আইনবিরুদ্ধ।
জলমহালগুলো দেশি মাছ তথা চেনা-অচেনা অসংখ্য জীববৈচিত্র্যের আধার। খালি চোখে ঠিক দেখা যায় না এমন অনেক প্রাণও আছে। যখন জলমহালগুলো ইজারা দেওয়া হয় তখন ইজারাদাররা একপ্রকার ওষুধ দিয়ে সেই জলমহালের সব প্রাণ মেরে ফেলে। তারপর সেখানে মাছ চাষ শুরু করে। এর ভেতর দিয়ে কেবল দেশি মাছই ধ্বংস হচ্ছে না। ধ্বংস হচ্ছে আমাদের জীববৈচিত্র্য।
সিএস রেকর্ডে প্রাপ্ত বিলের চেয়ে বর্তমানে বিলের সংখ্যা কিংবা আয়তন দুটোই কমে এসেছে। এর কারণ হলো ভূমি রক্ষকেরা ভক্ষকদেরও পৃষ্ঠপোষক। সামান্য কিছু টাকার বিনিময়ে জনসম্পত্তি ব্যক্তির নামে রেকর্ড করে দিয়েছে। ক্ষেত্র বিশেষে অনেক ডিসি কবুলিয়াতও দিয়ে থাকে জলমহাল।
আমাদের দেশের জলমহালগুলোর ক্ষেত্রে বিশেষ সিদ্ধান্ত প্রয়োজন। সামান্য টাকার বিনিময়ে এগুলো ইজারা দেওয়ায় সবাই যে পরিমাণ খুশি হয় সেই পরিমাণ রাজস্ব আসলে আদায় হয় না। জলমহালগুলো যে প্রকৃত মৎস্যচাষী পাচ্ছে তাও নয়।
জলমহালগুলো যাদের রক্ষণাবেক্ষণ করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তারাও জনস্বার্থে এগুলোর সুরক্ষা দিতে পারছে না। ফলে জলমহাল সুরক্ষার ক্ষেত্রে পূর্ববর্তী সব সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে হবে।
প্রথমত ইজারা দেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। দ্বিতীয়ত ইউএনও, ডিসিদের হাত থেকে জলমহাল আলাদা করতে হবে। জলমহালগুলো রক্ষণাবেক্ষণের জন্য আলাদা দায়িত্বপ্রাপ্ত জনবল প্রয়োজন। যারা সারা জীবন ধরে কেবল ভূমি কিংবা জলাশয়গুলোর সুরক্ষার দায়িত্ব পালন করতে পারবেন।
জলহমালগুলো সুরক্ষার দায়িত্ব যেমন সরকারি পর্যায়ের তেমনি স্থানীয় পর্যায়ের ব্যক্তিদেরও দায়িত্ব রয়েছে। জনসম্পত্তি রক্ষার দায়িত্ব আমাদের সবার।
ড. তুহিন ওয়াদুদ ।। অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর
[email protected]
সম্পর্কিত বিষয়:
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: