বুধবার, ১২ই মার্চ ২০২৫, ২৮শে ফাল্গুন ১৪৩১


বাড়ছে ইটভাটা, বাড়ছে দূষণ, প্রতিকার কোথায়?


প্রকাশিত:
৪ মার্চ ২০২৫ ১১:০৬

আপডেট:
১২ মার্চ ২০২৫ ১৭:৫৩

ছবি সংগৃহীত

বাংলাদেশের ইট প্রস্তুত শিল্প দেশের অবকাঠামো নির্মাণ ও নগরায়ণের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দেশের মোট নির্মাণ শিল্পের প্রায় ৮০ শতাংশ, ইটের ওপর নির্ভরশীল। বর্তমানে বাংলাদেশে আনুমানিক ৮,০০০-১০,০০০ ইটভাটা রয়েছে, যা বছরে প্রায় ২৮ বিলিয়ন ইট উৎপাদন করে।

তবে, এই শিল্প প্রচুর পরিমাণে প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহার করে এবং পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। ইটভাটা থেকে নির্গত দূষিত বায়ু, কৃষিজমির ক্ষতি, বন উজাড় এবং জলবায়ু পরিবর্তনের মতো সমস্যার সৃষ্টি হয়। পরিবেশ অধিদপ্তরের সর্বশেষ (ডিসেম্বর ২০২২) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশে মোট ৭,৮৮১টি ইটভাটা রয়েছে। এর মধ্যে ৩,২৪৮টি বৈধ এবং ৪,৬৩৩টি অবৈধভাবে পরিচালিত হচ্ছে, যা মোট ইটভাটার প্রায় ৫৯ শতাংশ।

চার বছরে অবৈধ ইটভাটার সংখ্যা প্রায় ১,৫০০টি বেড়েছে, বিশেষ করে তিন বছরে এই বৃদ্ধির হার বেশি। দশ বছর আগে, ২০১৩ সালে, দেশে ইটভাটার সংখ্যা ছিল ৪,৯৫৯টি; যা বর্তমানে ৬২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ৭,৮৮১টিতে পৌঁছেছে। ইটভাটার প্রযুক্তিগত বিন্যাসে দেখা যায়, দেশে ফিক্সড চিমনির ইটভাটা রয়েছে ১,৩৭৩টি, জিগজ্যাগ ইটভাটা ৬,৩৫২টি, অটো ইটভাটা (হাইব্রিড হফম্যান ও টানেল কিলন) ১৪৯টি এবং অন্যান্য প্রযুক্তির ইটভাটা ৬টি।

বাংলাদেশে ইটভাটা পরিবেশ দূষণের অন্যতম প্রধান কারণ। ইটভাটার দূষণ বায়ু, মাটি, পানি এবং জীববৈচিত্র্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, যা পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করছে এবং জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করছে। দূষিত বাতাসে দীর্ঘসময় শ্বাস নেওয়ার ফলে অ্যাজমা, ব্রঙ্কাইটিস, নিউমোনিয়া ও সিওপিডি (COPD) রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়।

ইটভাটার কাছাকাছি বসবাসকারী মানুষ, বিশেষ করে শিশু ও বৃদ্ধরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সালফারের যৌগসমূহ ও সূক্ষ্ম ধূলিকণার কারণে চোখে জ্বালা, ত্বকের সমস্যা এবং ফুসফুসের সংক্রমণ দেখা দিতে পারে। গর্ভবতী নারীদের ক্ষেত্রে দূষণের ফলে অকাল জন্ম ও শিশুর কম ওজন নিয়ে জন্মানোর সম্ভাবনা বেড়ে যায়।

ইটভাটা থেকে নির্গত বায়ুদূষণ এখনকার সময়ে সবচেয়ে বড় সমস্যা হিসেবে দেখা দিচ্ছে। এসব ভাটা থেকে বিপুল পরিমাণ সূক্ষ্ম বস্তুকণা (PM₁₀ ও PM₂.₅) নির্গত হয়, যা ফুসফুসে প্রবেশ করে এবং শ্বাসযন্ত্রের বিভিন্ন রোগ সৃষ্টি করে। পাশাপাশি, কার্বন মনোক্সাইড (CO), সালফার ডাই-অক্সাইড (SO₂) এবং নাইট্রোজেন অক্সাইড (NOₓ) বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে, যা অ্যাসিড বৃষ্টির সৃষ্টি করতে পারে এবং শ্বাসকষ্টসহ নানা স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ায়।

অনেক ইটভাটায় নিম্নমানের কয়লা ও কাঠ ব্যবহার করা হয়, যা ব্ল্যাক কার্বন উৎপন্ন করে এবং বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ঢাকার আশেপাশের এলাকায় প্রায় ২,৫০০ ইট ভাটা রয়েছে এবং ঢাকার বায়ু দূষণের প্রায় ২৫-৩০ শতাংশ ইটভাটা থেকে আসে। বিশ্বব্যাংকের ২০১৯ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, শুধুমাত্র ঢাকার ইটভাটা থেকে প্রতি বছর বায়ুতে ৬.৮ মিলিয়ন টন দূষণকারী পদার্থ নির্গত হয়।

কৃষি ও মাটির গুণগত মানের ওপর ইটভাটার প্রভাব ব্যাপক। ইট তৈরির প্রধান কাঁচামাল হলো মাটি, যা সাধারণত কৃষিজমি থেকে সংগ্রহ করা হয়। প্রতি বছর আনুমানিক ৬০,০০০ একর জমির উপরিভাগের মাটি ইট তৈরির জন্য ব্যবহৃত হয়। এর ফলে কৃষিজমির উর্বরতা হ্রাস পায়, ভূমি ক্ষয় বৃদ্ধি পায় এবং দীর্ঘমেয়াদে খাদ্য নিরাপত্তার ঝুঁকি তৈরি হয়।

ইটভাটার নির্গমন মাটির জৈব উপাদান নষ্ট করে উর্বরতা কমিয়ে দেয়। এতে ফসলের উৎপাদনশীলতা হ্রাস পায় এবং গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। ইটভাটার দূষণের ফলে ফসলের পাতা হলুদ হয়ে যায় বা পুড়ে যায়, যার কারণে খাদ্যশস্য ও শাকসবজির ফলন কমে যায়। ইটভাটা থেকে নির্গত ধুলা ও রাসায়নিক পদার্থ বৃষ্টির পানির সঙ্গে মিশে জলাধার ও ভূগর্ভস্থ পানি দূষিত করে। অনেক ইটভাটার বর্জ্য নিকটস্থ নদী ও জলাশয়ে ফেলা হয়, যা জলজ প্রাণীর জন্য মারাত্মক হুমকি তৈরি করে এবং স্থানীয় জনগণের জন্য নিরাপদ পানির অভাব সৃষ্টি করে।

জীববৈচিত্র্যের ওপর ইটভাটার নেতিবাচক প্রভাব স্পষ্ট। বাংলাদেশের অনেক ইটভাটায় কাঠ পোড়ানো হয়, যা বন উজাড়ের অন্যতম কারণ। নতুন ইটভাটা স্থাপনের জন্য বন উজাড় করা হয়, যা পাখি, কীটপতঙ্গ এবং অন্যান্য বন্যপ্রাণীর বাসস্থান ধ্বংস করে। ইট প্রস্তুতের জন্য প্রতি বছর প্রায় ২০ লাখ টন কাঠ পোড়ানো হয়, যা বন ধ্বংস এবং জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি করছে। ইটভাটার ধূলিকণা গাছের পাতায় জমে, ফলে সূর্যালোক শোষণ কমে যায় এবং গাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। এর ফলে স্থানীয় বাস্তুতন্ত্র ক্ষতির সম্মুখীন হয়।

দীর্ঘমেয়াদে ইটভাটার দূষণ জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম কারণ। ইট প্রস্তুতে ব্যবহৃত কয়লা ও কাঠ দহন থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড (CO₂) এবং ব্ল্যাক কার্বন নির্গত হয়, যা বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে। প্রতি বছর বাংলাদেশে ইটভাটা থেকে প্রায় ১৫ মিলিয়ন টন কার্বন ডাই-অক্সাইড (CO₂) নির্গত হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, ইটভাটা অধ্যুষিত এলাকায় তাপমাত্রা সাধারণত ২-৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি থাকে, যা স্থানীয় জলবায়ুর ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে।

পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণে সরকার 'ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১৩ (সংশোধিত ২০১৯)' প্রণয়ন করেছে এবং ২০২২ সালে 'বায়ুদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা' গেজেট প্রকাশ করেছে। এই আইনের আওতায় অবৈধ ইটভাটা বন্ধে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। ইটভাটার সংখ্যা বৃদ্ধির ফলে পরিবেশ দূষণ ও কৃষিজমির ক্ষতি বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা নিয়ন্ত্রণে সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করছে।

উন্নত দেশগুলোয় ইট উৎপাদনের সময় পরিবেশের ক্ষতি এড়ানোর জন্য আধুনিক প্রযুক্তি ও টেকসই উপকরণ ব্যবহার করা হয়। তারা প্রচলিত ইটভাটার পরিবর্তে নিম্ন কার্বন নির্গমন প্রযুক্তি গ্রহণ করেছে, যা দূষণ কমায় এবং শক্তির ব্যবহার দক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। এই পদ্ধতিগুলোর ফলে বায়ুদূষণ, বন উজাড় এবং কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পায়।

উন্নত বিশ্বে টানেল কিলন (Tunnel Kiln), হাইব্রিড হফম্যান কিলন (HHK) এবং ভার্টিকাল শ্যাফট ব্রিক কিলন (VSBK) প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। এসব আধুনিক ইটভাটায় তাপ পুনর্ব্যবহার করা হয়, যা কয়লার ব্যবহার কমিয়ে আনে এবং কার্বন নিঃসরণ হ্রাস করে।

বিশেষত, টানেল কিলন প্রযুক্তিতে ইট পোড়ানোর সময় ধীরে ধীরে তাপমাত্রা বাড়ানো হয়, যা জ্বালানির অপচয় রোধ করে এবং ইটের গুণগত মান উন্নত করে। পরিবেশবান্ধব ইট উৎপাদনে বিকল্প নির্মাণ উপকরণ ব্যবহারের প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে। উন্নত দেশগুলোয় AAC ব্লক (Autoclaved Aerated Concrete) এবং কংক্রিট ব্লক ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়, যা সাধারণ পোড়ানো ইটের তুলনায় কম কার্বন নিঃসরণ করে এবং শক্তি সাশ্রয় করে।

এছাড়া, পুনর্ব্যবহৃত উপকরণ দিয়ে রিক্লেমড ব্রিক তৈরি করা হয়, যা নতুন কাঁচামালের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে আনে এবং পরিবেশগত ক্ষতি হ্রাস করে। ইট উৎপাদনের সময় নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার পরিবেশের ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। উন্নত দেশগুলোর অনেক কারখানায় সৌরশক্তি ও বায়ুশক্তি ব্যবহার করে ইট পোড়ানো হয়, যা কয়লা ও কাঠের ব্যবহার কমিয়ে আনে।

এছাড়া, ইলেকট্রিক কিলন (Electric Kiln) ব্যবহারের ফলে ইট পোড়ানোর সময় বায়ুদূষণ প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে আসে। কঠোর পরিবেশ আইন এবং সরকারি নীতিমালার কারণে উন্নত দেশগুলোয় ইটভাটাগুলোর ওপর কড়া নজরদারি রাখা হয়। কারখানাগুলোর ধোঁয়া শোধন করার জন্য এয়ার ফিল্টার প্রযুক্তি ব্যবহৃত হয়, যা ক্ষতিকর গ্যাস শোষণ করে এবং পরিশোধিত বাতাস নির্গত করে।

নগর পরিকল্পনায় পরিবেশবান্ধব উপকরণ ব্যবহারের বাধ্যবাধকতা থাকায় ইটভাটার সংখ্যা কমিয়ে বিকল্প উপকরণের ওপর নির্ভরতা বাড়ানো হয়েছে। সবুজায়ন ও টেকসই উন্নয়নকে সামনে রেখে উন্নত বিশ্বে বৃক্ষরোপণ ও পরিবেশ সুরক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। ইট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের আশপাশে বনাঞ্চল সংরক্ষণ এবং পুনরায় গাছ লাগানোর মাধ্যমে কার্বন নিঃসরণ সমন্বয় করে। ফলে, পরিবেশের ওপর ইট উৎপাদনের নেতিবাচক প্রভাব অনেকটাই কমে আসে।

ইটভাটার দূষণ কমানোর জন্য বাংলাদেশকে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ও টেকসই বিকল্প গ্রহণ করতে হবে। উন্নত দেশগুলোর পরিবেশবান্ধব ইট উৎপাদন প্রক্রিয়া থেকে বাংলাদেশও শিক্ষা নিতে পারে। বাংলাদেশে AAC ব্লক, কংক্রিট ব্লক এবং জিগজ্যাগ কিলন প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ালে ইটভাটা থেকে সৃষ্ট দূষণ উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।

দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমে উন্নত বিশ্বের মতো স্বল্প দূষণকারী ও টেকসই নির্মাণ উপকরণ ব্যবহারে মনোযোগ দেওয়া হলে দেশের পরিবেশের উন্নতি সম্ভব হবে। পাশাপাশি, পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের কার্যকর বাস্তবায়ন ও কঠোর নজরদারি নিশ্চিত করতে হবে। সঠিক পদক্ষেপ না নিলে ইটভাটার অনিয়ন্ত্রিত বিস্তার পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য আরও মারাত্মক সংকট তৈরি করবে।

অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার ।। ডিন, বিজ্ঞান অনুষদ; অধ্যাপক, পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ; যুগ্ম সম্পাদক, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) এবং চেয়ারম্যান, বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস)।


সম্পর্কিত বিষয়:


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:




রিসোর্সফুল পল্টন সিটি (১১ তলা) ৫১-৫১/এ, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০।
মোবাইল: ০১৭১১-৯৫০৫৬২, ০১৯১২-১৬৩৮২২
ইমেইল : [email protected]; [email protected]
সম্পাদক : লিটন চৌধুরী

রংধনু মিডিয়া লিমিটেড এর একটি প্রতিষ্ঠান।

Developed with by
Top