বুধবার, ১২ই মার্চ ২০২৫, ২৮শে ফাল্গুন ১৪৩১


অপরাধ প্রতিরোধে অন্যান্য দেশ কীভাবে কাজ করে?


প্রকাশিত:
৯ মার্চ ২০২৫ ১১:০৮

আপডেট:
১২ মার্চ ২০২৫ ১৭:৫২

ছবি সংগৃহীত

কিশোর অপরাধ বলতে সাধারণত এমন অপরাধকে বোঝানো হয় যা কোনো কিশোর বা কিশোরী (যার বয়স ১৮ বছরের নিচে) দ্বারা সংঘটিত হয়। এই অপরাধগুলো শারীরিক, মানসিক বা সামাজিকভাবে প্রভাব ফেলতে পারে এবং সমাজের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।

কিশোর অপরাধের মধ্যে চুরি, মারামারি, মাদক সেবন, বিদ্যালয়ে বিশৃঙ্খলা, সহিংসতা বা এমনকি হত্যা পর্যন্ত হতে পারে। বাংলাদেশে কিশোর অপরাধের জন্য একটি বিশেষ আইন রয়েছে, যা কিশোরদের সংশোধন ও পুনর্বাসন করতে সহায়তা প্রদান করে। এই আইনটি হলো ‘কিশোর আদালত আইন, ২০১৩’ (The Children Act, 2013)।

এটি শিশু এবং কিশোরদের অপরাধের বিচার এবং তাদের অধিকার সুরক্ষিত করার জন্য প্রণীত হয়েছে। আইনটি কিশোরদের জন্য একটি বিশেষ বিচার ব্যবস্থার ব্যবস্থা করে, যা সাধারণ আদালতের বিচার ব্যবস্থার তুলনায় একটু ভিন্ন। এছাড়া বাংলাদেশ দণ্ডবিধি (১৯৬০) এরও কিছু ধারায় কিশোর অপরাধীদের বিচার করার নিয়ম রয়েছে, তবে কিশোরদের জন্য অধিকাংশ ক্ষেত্রে আলাদা বিচারিক ব্যবস্থা এবং বিশেষ যত্ন নেওয়া হয়।

কিশোর অপরাধের ধরন বিভিন্ন ধরনের হতে পারে, যা কিশোরদের বয়স, সামাজিক পরিবেশ, পারিবারিক অবস্থা, মানসিক অবস্থা এবং পারিপার্শ্বিক প্রভাবের ওপর নির্ভর করে। তবে সাধারণত, কিশোর অপরাধের কিছু মূল ধরন দেখা যায়। প্রধানত, কিশোররা প্রায়ই একে অপরের সাথে মারামারি, আঘাত বা শারীরিক সহিংসতা ঘটায়। অনেক সময় বন্ধুবান্ধবীর মধ্যে ঝগড়া বা উত্তেজনা বেড়ে যাওয়ার ফলে সহিংসতা ঘটে।

এছাড়াও তারা অর্থ বা বিভিন্ন সামগ্রী চুরি করে, যা তাদের অপরাধমূলক কার্যকলাপে প্ররোচিত করে। কিশোরদের মধ্যে মাদকদ্রব্য সেবন এবং মাদক বেচাকেনার প্রবণতা বাড়ছে। বন্ধুত্ব বা সমাজের প্রভাবের কারণে অনেক কিশোর মাদক সেবন শুরু করে এবং অনেক সময় মাদক ব্যবসায় জড়িত হয়ে পড়ে।

কিশোরদের মধ্যে যৌন অপরাধও দেখা যায়, যা তারা পারিবারিক বা সামাজিক অস্থিরতা বা ইন্টারনেটের মাধ্যমে অশালীন বিষয়গুলোর প্রতি আগ্রহী হয়ে এ ধরনের অপরাধে জড়িত হতে পারে। বর্তমান সময়ে কিশোররা স্কুলে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে, যেমন শিক্ষককে অপমান, সহপাঠীদের সাথে মারামারি বা শৃঙ্খলা ভঙ্গ।

এই ধরনের অপরাধ প্রায়ই মনোবিদ্যা বা পারিবারিক সমস্যার ফলস্বরূপ ঘটে থাকে। যা সিগমুন্ড ফ্রয়েড তার সাইকো ডাইনামিক থিওরি (১৯৮৬) তে উপস্থাপন করেছেন। কিশোররা আবার অকারণে গাড়ি, ঘর বা বিভিন্ন উপকরণ ভাঙচুর করতে পারে। এই ধরনের অপরাধ সাধারণত ক্ষোভ বা দুঃখ থেকে আসে এবং এতে তারা আনন্দ পায়।

কখনো কিশোররা অপরাধী গ্যাং বা বাহিনীর সদস্য হয়ে ওঠে, যেখানে তারা অবৈধ কার্যকলাপ যেমন চুরি, আক্রমণ, মাদক ব্যবসা এবং অন্য কোনো ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। কিশোর অপরাধের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ানক ধরন হলো হত্যাকাণ্ড বা গুরুতর আক্রমণ। যদিও এটি কম ঘটে, তবে কিছু কিশোর তাদের ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব বা ক্রোধের কারণে হত্যার মতো গুরুতর অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। সমসাময়িক সময়ে আমরা প্রায় এর প্রতিটা ধরনই বাংলাদেশে লক্ষ্য করছি।

কিশোর অপরাধের পেছনে নানা ধরনের কারণ থাকতে পারে, অনেক কিশোর তাদের পরিবারে ঠিকমতো যত্ন বা সমর্থন পায় না। পিতামাতার অযত্ন, শারীরিক বা মানসিক অত্যাচার অথবা একক অভিভাবক (যেমন মা অথবা বাবা) থাকার কারণে তারা অপরাধের দিকে ঝুঁকে পড়ে। জন বোলবি তার সংযুক্তি থিওরি (Attachment Theory, 1995) এই সমর্থন ও ভালোবাসার প্রয়োজনীয়তা উপস্থাপন করেছেন।

এছাড়াও পারিবারিক সহিংসতা বা মাদক সেবন, পরিবারে বিবাহবিচ্ছেদ অথবা মাদকাসক্তি কিশোরদের মানসিক অবস্থাকে প্রভাবিত করে, ফলে তারা অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। সামাজিকভাবে কিশোররা প্রভাবিত হতে পারে খারাপ বন্ধু বা অপরাধী গ্যাং দ্বারা। বন্ধুবান্ধবের প্রভাব অনেক সময় তাদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের দিকে ঠেলে দেয়।

এডউইন সাদারল্যান্ড তার (Differential Association Theory, 1939) বলেছেন, একজন ভালো মানুষ খারাপ মানুষের সাথে মেলামেশার ফলে ভালো মানুষটি খারাপ কাজ দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে। দারিদ্র্য বা দরিদ্র পরিবেশে বেড়ে ওঠা কিশোরদের জন্য অপরাধে জড়ানো সহজ হতে পারে, কারণ তাদের সামনে অন্য কোনো উপায় থাকে না। অর্থের অভাবে তারা চুরি বা অন্য অবৈধ উপায়ে উপার্জন করতে পারে।

সমাজে মাদকদ্রব্যের সহজলভ্যতা কিশোরদের মধ্যে মাদক সেবন এবং মাদক ব্যবসা করার প্রবণতা বাড়িয়ে তোলে। শিক্ষাগতভাবে অনেক কিশোরের কাছে শিক্ষা একটি সীমিত সুযোগ হয়ে থাকে। তারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেতে পারছে না অথবা স্কুলে অশিক্ষা ও বিশৃঙ্খলার কারণে তাদের আগ্রহ কমে যায়। এতে তাদের জীবনযাত্রার মান নেমে যায় এবং অপরাধে জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। অনেক সময় স্কুলের শিক্ষকদের অবহেলা বা সহপাঠীদের সঙ্গে মারামারি, বুলিং (bullying) এর মতো সমস্যা কিশোরদের মনস্তত্ত্বে প্রভাব ফেলতে পারে এবং অপরাধমূলক কাজের দিকে তাদের ঠেলে দেয়।

মানসিক অবস্থা কিশোর অপরাধের পেছনে একটা অন্যতম কারণ। মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা যেমন হতাশা, উদ্বেগ, আক্রমণাত্মক মনোভাব বা মানসিক আঘাত (যেমন যৌন নিপীড়ন বা শারীরিক নির্যাতন) অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়ানোর কারণ হতে পারে। এর মাঝে বয়সকালীন সময়ে কিশোর বয়সে শরীরের এবং মানসিকভাবে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে, যার কারণে তারা অস্থির, অভ্যস্ত বা উদ্ভট সিদ্ধান্ত নেওয়ার দিকে ঝুঁকে পড়ে।

মিডিয়াও একটি বড় ভূমিকা রাখে, যেখানে অনেক সময় কিশোররা টেলিভিশন, সিনেমা, অনলাইন ভিডিও গেমস বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে নেতিবাচক প্রভাব পায়। যেমন হিংসাত্মক কনটেন্ট দেখার কারণে তারা সহিংসতা বা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে আগ্রহী হয়ে ওঠে।

অর্থনৈতিক সংকটও একটি বড় কারণ যেখানে, কিশোররা আর্থিকভাবে কঠিন অবস্থায় থাকে এবং তাদের প্রয়োজনীয় উপকরণ বা খাবার প্রাপ্তি সম্ভব হয় না, তখন তারা অপরাধে জড়ানোর সম্ভাবনা থাকে। অনেক সময় কিশোর অপরাধীদের সঠিক বিচার বা শাস্তির ব্যবস্থা না থাকার কারণে তারা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে আবারও জড়িত হয়। তাদের শাস্তির পরিবর্তে অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের শিক্ষা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা না থাকলে অপরাধ বাড়তে থাকে।

ইউরোপে কিশোর অপরাধ কমানোর জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি ও নীতি অনুসরণ করা হয়, যা মূলত কিশোরদের পুনর্বাসন, শিক্ষাগত উন্নয়ন, সামাজিক নিরাপত্তা এবং মানসিক সহায়তা প্রদান করে। এই অঞ্চলে কিশোর অপরাধ নিয়ন্ত্রণের জন্য একাধিক কার্যকরী পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়।

ইউরোপের অনেক দেশে পুনর্বাসনমূলক বিচার ব্যবস্থা (Restorative Justice) ব্যবহার করা হয়, যেখানে কিশোর অপরাধীকে শাস্তি দেওয়ার পরিবর্তে, অপরাধের জন্য সে কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির প্রতি দায়বদ্ধ, তা বোঝানো হয়। এই ব্যবস্থা অপরাধী এবং ভুক্তভোগী উভয়ের মধ্যে আলোচনার সুযোগ সৃষ্টি করে, যার মাধ্যমে কিশোর অপরাধীর মধ্যে অনুশোচনা এবং সমাজে পুনঃসংযুক্তি সহজ হয়।

এখানে ইন্সটিটিউশনাল হোমস থাকে যেখানে কিশোরদের শাস্তির বদলে তাদের আচরণ সংশোধন এবং তাদের সঠিক শিক্ষা দেওয়া হয়। দক্ষতা উন্নয়ন কর্মসূচি যেমন চাকরি প্রশিক্ষণ, সৃজনশীল কার্যকলাপ এবং প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কিশোরদের ভালো কর্মসংস্থান সৃষ্টির চেষ্টা করা হয়, যাতে তারা অপরাধের পথে না যায়।

যুক্তরাষ্ট্রে ফ্যামিলি থেরাপি বা মেন্টরিং প্রোগ্রাম পরিচালনা করা হয়, যেখানে কিশোরদের পরিবারের সদস্যদের সহায়তা দেওয়া হয়। এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রে সমাজসেবামূলক কাজের সুযোগ রাখা হয়। এর মাধ্যমে কিশোররা তাদের অপরাধের জন্য প্রতিকার করে এবং একই সঙ্গে তাদের মধ্যে সামাজিক দায়িত্বশীলতার অনুভূতি তৈরি হয়। এতে বিভিন্ন প্রিভেনশন প্রোগ্রাম, কিশোরদের জন্য বিশেষ পুলিশ ইউনিট থাকে যারা অপরাধ প্রতিরোধে কাজ করে এবং কিশোরদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। এতে কিশোরদের জন্য সঠিক সহায়তা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করা হয়।

বাংলাদেশেও শুধু কঠোর আইন প্রয়োগ বা জিরো টলারেন্স পদ্ধতি না নিয়ে এই সব কার্যক্রমের মাধ্যমে বর্তমান সময়ের সৃষ্ট অপরাধ ও বিশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।

মো. মাজহারুল ইসলাম ।। সহকারী অধ্যাপক, ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়


সম্পর্কিত বিষয়:


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:




রিসোর্সফুল পল্টন সিটি (১১ তলা) ৫১-৫১/এ, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০।
মোবাইল: ০১৭১১-৯৫০৫৬২, ০১৯১২-১৬৩৮২২
ইমেইল : [email protected]; [email protected]
সম্পাদক : লিটন চৌধুরী

রংধনু মিডিয়া লিমিটেড এর একটি প্রতিষ্ঠান।

Developed with by
Top