শনিবার, ১৫ই মার্চ ২০২৫, ১লা চৈত্র ১৪৩১


আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক যোগাযোগের অনন্য শিক্ষক


প্রকাশিত:
১৫ মার্চ ২০২৫ ১১:৪৬

আপডেট:
১৫ মার্চ ২০২৫ ১৬:৩৮

ছবি সংগৃহীত

আবু আহসান মোহাম্মদ শামসুল আরেফিন সিদ্দিক বা আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিককে আমি প্রথম দেখি ২০০৪ সালের এপ্রিল মাসে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে তিনি প্রথম বর্ষে যোগাযোগ ধারণা কোর্সটি পড়াতেন। লম্বা চড়া মানুষ, পরিপাটি পোশাকে ধীর পায়ে পথ চলেন, কথা বলেন নিচুকণ্ঠে। যতটা না বলেন, তার চেয়ে শোনেন অখণ্ড মনোযোগে।

২০০৪ সালে সাংবাদিকতা বিভাগের ক্লাস হতো কলাভবনের ১০৮৮ নম্বর কক্ষে। একটা প্রায় অকেজো এসি’র ঘো ঘো শব্দ আর পুরাতন আমলের বেঞ্চে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শুরু হয়েছিল। তবে সেই দিনগুলো অন্য রকমভাবে রাঙিয়ে তুলছিলেন অধ্যাপক আরেফিন সিদ্দিক, ড. সাখাওয়াত আলী খান, সিতারা পারভীনসহ অন্যান্য শিক্ষকরা।

মফস্বল জীবনের বিচ্ছিন্নতার কালে এই শিক্ষকদের মাধ্যমে আমরা আবিষ্কার করছিলাম নতুন এক পৃথিবী। যেখানে পরিচিত হচ্ছিলাম ডেভিড কে. বার্লো, মার্শাল ম্যাকলুহান, নোয়াম চমস্কিসহ নানা তাত্ত্বিকের চিন্তার সাথে।

মনোজগতের ভাঙা-গড়া আর ব্যক্তি জীবনের বিচ্ছিন্নতা ও সংকটের সেই সময়ে আমাদের সঙ্গী ছিলেন নিচুস্বরে কথাবলা অধ্যাপক আরেফিন সিদ্দিক। যতদূর মনে আছে স্যার, প্রতি সপ্তাহে আমাদের ৩টা ক্লাস নিতেন। আর বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে স্যারকে বিভিন্ন প্রতিবাদ সভায় দেখতাম। তখনো আমি জানতাম না স্যার শিক্ষক রাজনীতিতে সক্রিয়। কারণ শ্রেণিকক্ষে তিনি কখনোই রাজনীতির কথা তুলতেন না। তার নিজস্ব রাজনৈতিক ভাবাদর্শ কখনোই প্রকাশ করতেন না।

আমার স্পষ্ট মনে আছে, যোগাযোগ ধারণা ক্লাসে ‘মিথ্যা’ সম্পর্কে তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা তুলে ধরেছিলেন। তার মুখ থেকেই আমি প্রথম জেনেছিলাম মিথ্যা তিন প্রকার। প্রথম প্রকার ছিল নিপাট মিথ্যা যে মিথ্যা কারও ক্ষতির উদ্দেশ্যে মিথ্যা বলায়, দ্বিতীয়টি ছিল সাদা মিথ্যা যাতে কারও ক্ষতি হয় না, বরং অন্যের ভালো করার চেষ্টা থাকে আর শেষটি ছিল ধূসর মিথ্যা।

সত্য-মিথ্যার মাঝামাঝি এই বয়ানের অবস্থান। অনেকটা গা বাঁচানোর চেষ্টা। আমাদের নিত্যদিনে বলা মিথ্যা সম্পর্কে এই তত্ত্বটি স্যার এত চমৎকারভাবে তুলে ধরেছিলেন তা আজও মনে দাগ কেটে আছে।

একবার ক্লাসে আলাপ হয়েছিল সংবাদপত্রের রাজনীতি ও রাজনৈতিক সংশ্লেষ নিয়ে। আমরা তখন নবীন শিক্ষার্থী। সংবাদপত্রের ট্রিটমেন্ট, টুইস্ট ও পলিটিক্স নিয়ে মাত্র অ-আ-ক-খ শিখছি। একদিন ক্লাসে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, স্যার আমরা কোন সংবাদপত্র পড়বো? আমরা তো সংবাদপত্রের রাজনীতি বুঝতে পারছি না? মোটামুটি গোলকধাঁধায় আছি?

এমন সময় স্যার বলেছিলেন, তোমরা দিনকাল পড়বে, জনকণ্ঠ পড়বে, প্রথম আলো পড়বে, ডেইলি স্টার পড়বে, যেটা ভালো লাগবে সেটাই পড়বে। আর পড়তে পড়তেই ভালোমন্দ বোঝার সামর্থ্য তৈরি হবে যার মাধ্যমে নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিতে পারবে কোন সংবাদপত্রটি বেশি বস্তুনিষ্ঠ। কোন সংবাদপত্রটি অধিক গ্রহণযোগ্য।

হ্যাঁ, অধ্যাপক আরেফিন সিদ্দিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আওয়ামী লীগ ঘরানার রাজনীতি করতেন। ক্লাসে তিনি দিনকাল ও জনকণ্ঠের মধ্যে একটি সংবাদপত্র বাছাই করে বলতে পারতেন। তিনি সে পথে হাঁটেননি। তিনি শিক্ষকের সততা বজায় রেখেছিলেন।

আরেফিন সিদ্দিক সততাকে সম্মানও করতেন। আমাদের এক ব্যাচমেট এখন সরকারি আমলা। সে একবার ক্লাসের উপস্থিতি খাতায় বন্ধুর জন্য প্রক্সি দিয়েছিল। পরে ক্লাস শেষে স্যার গুণে দেখলেন সিগনেচার উপস্থিত শিক্ষার্থীর চেয়ে বেশি। স্যার, জিজ্ঞাসা করলেন কে করেছে এই কাজ? স্যার কঠোর হলেন? একটু ভীতির মধ্যেই আমাদের ওই সহপাঠী উঠে দাঁড়ালেন? স্বীকার করলেন অপরাধ? স্যার, তাকে ক্ষমা করেছিলেন। সততার জন্য ধন্যবাদ দিয়েছিলেন।

আরেক দিনের ক্লাসের স্মৃতি। ক্যাম্পাসে দুই ছাত্র সংগঠনের মধ্যে ব্যাপক মারামারি হয়েছে। বেদম পিটুনিতে একদল ক্যাম্পাস ছাড়া। তখন আরেফিন সিদ্দিক আমাদের ক্লাসে, ১০৮৮ নম্বর কক্ষে। হঠাৎ গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অফিস সহকারী হাদী ভাই ছুটে এলেন।

ক্লাস রুমে ঢুকে আতঙ্কিত হয়ে জানালেন, আরেফিন স্যারের লেকচার থিয়েটারের ব্যক্তিগত বসবার কক্ষ ভাঙচুর করা হয়েছে। কলাভবনে স্যারের নাম ধরে শ্লোগানও হচ্ছে। একটা ভীতিকর পরিবেশ। আরও বেশি ভীত হাদী ভাই। আমার স্পষ্ট মনে আছে, আমাদের ব্যাচের বন্ধুরা স্যারকে পেছনে সরিয়ে সবাই ১০৮৮ নম্বর কক্ষের দরজায় অবস্থান নিয়েছিলেন। এক অজানা শঙ্কায় শিক্ষকের সুরক্ষায় প্রতিরক্ষা দেয়াল হয়েছিলেন ব্যাচের বন্ধুরা।

২০০৯ সালে স্যার উপাচার্য হলেন। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই, স্যারের এই নিয়োগ আমাদের জন্য বিশেষ গর্বের ছিল। বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে আমরা নিজেদের একটু বেশি ক্ষমতাবানও মনে করতাম। কিন্তু তিনি নিজেকে ক্ষমতাবান মনে করতেন বলে আমার মনে হয় না। উপাচার্য হওয়ার পরও আমরা স্যারকে কাছেই পেয়েছি। বলা যায় সহৃদয়বান শিক্ষকের মতোই কাছে পেয়েছি।

২০০৮ সালের ২০ জুন আমার সহপাঠী সাইফুল সামিন এক ট্রেন দুর্ঘটনায় দুই পা হারিয়েছিলেন। কী বীভৎস সেইসব দিন। কতটা কঠিন ছিল দুই পা হারানো তার সেই সময়ের পথচলা। সাইফুল ও আমি একই হলের শিক্ষার্থী ছিলাম, আমরা একই কক্ষে থাকতাম। সে কারণে তার দু-একটি বিষয়ে আমি উপাচার্য আরেফিন সিদ্দিকের সাথে আলাপ করেছিলাম।

আমি নিজে সাক্ষী, আরেফিন সিদ্দিক কতটা সংবেদনশীলভাবে শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। সেই সময়ে অধ্যাপক আরেফিন সিদ্দিক, শাওন্তী হায়দার, রোবায়েত ফেরদৌস ও নাদির জুনাইদসহ অন্যান্য শিক্ষকের স্নেহ ও সান্নিধ্যে সাইফুল আগুন পাখির মতো আবারও ফিরেছেন জীবনের ছন্দে। সাইফুল এখন দেশসেরা সহ-সম্পাদক।

তবে একথা বলার অপেক্ষা রাখে না উপাচার্য আরেফিন সিদ্দিকের অনেক ব্যর্থতাও ছিল। উপাচার্য হিসেবে তার দীর্ঘ সময়ে ক্যাম্পাসে অনেক শিক্ষার্থী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। বলার অপেক্ষা রাখে না অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। অনেক শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী অন্যায়ের শিকার হয়েছেন। এমনকি আওয়ামী লীগ করা শিক্ষকরাও বঞ্চিত হয়েছেন। এসব সত্য।

এছাড়া উপাচার্য হয়ে আরেফিন সিদ্দিক অনেক ছোটখাটো রাজনৈতিক দলের আলোচনায় প্রধান অতিথি হিসেবে যেতেন তা নিয়েও অনেক সমালোচনা আছে। এই সমালোচনাগুলো উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। কিন্তু তিনি তো একজন মানুষ, দেবতা নন, তিনিও দোষ-ত্রুটির ঊর্ধ্বে নন।

আরেফিন সিদ্দিক কেমন ছিলেন? তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য কি ছিল? তা নিয়ে একটি মূল্যায়ন করেছিলেন তার শিক্ষক অধ্যাপক ড. সাখাওয়াত আলী খান। নানা বিতর্কে অধ্যাপক আরেফিন সিদ্দিক তখন প্রায় কোণঠাসা। তখন ইমেরিটাস অধ্যাপক হিসেবে অধ্যাপক সাখাওয়াত আলী খান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে ক্লাস নেন।

একটা গবেষণার কাজে সাক্ষাৎকার শেষে অধ্যাপক সাখাওয়াত আলী খানের সাথে আলাপ হয়েছিল। তখন তিনি বলেছিলেন, ‘আরেফিন আমার ছাত্র, ওর কমিউনিকেশন স্কিল অন্য লেভেলের। সহ্য ক্ষমতা অন্য পর্যায়ের। ওরে কেউ আটকাতে পারবে না।’

অধ্যাপক আরেফিন সিদ্দিকির বিদায় বেলায় তার সম্পর্কে তার শিক্ষক সাখাওয়াত আলী খানের কথাগুলো বারবার মনে পড়ছিল। খুব সম্ভবত যোগাযোগের শিক্ষক আরেফিন সিদ্দিকের যোগাযোগ সামর্থ্য আসলেই অনন্য ছিল। যে যোগ্যতায় এই বিভাগের হাজারও শিক্ষার্থীর হৃদয়ের সাথে তিনি যোগাযোগ স্থাপন করতে পেরেছিলেন। এই আত্মিক যোগাযোগ হয়তো চালু থাকবে দীর্ঘদিন। আমার ধারণা, একজন শিক্ষকের স্থান শিক্ষার্থীর হৃদয় গহীনে। সেখানেই শিক্ষকের বাস। যেখানে শিক্ষক থাকেন পরম যত্নে, অমলিন।

রাহাত মিনহাজ ।। সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]


সম্পর্কিত বিষয়:


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:




রিসোর্সফুল পল্টন সিটি (১১ তলা) ৫১-৫১/এ, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০।
মোবাইল: ০১৭১১-৯৫০৫৬২, ০১৯১২-১৬৩৮২২
ইমেইল : [email protected]; [email protected]
সম্পাদক : লিটন চৌধুরী

রংধনু মিডিয়া লিমিটেড এর একটি প্রতিষ্ঠান।

Developed with by
Top