জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের বাংলাদেশ সফর যে আশা জাগায়
প্রকাশিত:
১৭ মার্চ ২০২৫ ১১:৪৬
আপডেট:
১৭ মার্চ ২০২৫ ২০:৪২

জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস সম্প্রতি বাংলাদেশ সফরে এসে কক্সবাজারের উখিয়াই অবস্থিত রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করেছেন। নিঃসন্দেহে এর একটি ভূরাজনৈতিক সমীকরণ রয়েছে। তবে যেটি চোখে পড়ার মতো সেটি হলো বিশ্ব মিডিয়াতে এর ফলাও প্রচার।
রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে এতদিন বিশ্ব মিডিয়া নীরব উপস্থিতি দেখিয়েছে কিন্তু জাতিসংঘ মহাসচিবের বাংলাদেশে আগমন উপলক্ষে বিশ্ব মিডিয়া ইতিবাচকভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এর বড় কারণ ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের রয়েছে আকাশ ছোঁয়া স্বীকৃতি। যা ছয় মাসে আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। তার হাত ধরে আমরা পেয়েছি একের পর এক আন্তর্জাতিক সংযুক্তি। রোহিঙ্গা ইস্যুতে বিগত সরকার অনেক উদ্যোগ হাতে নিয়েছিলেন কিন্তু তা আর বাস্তবায়িত হয়নি। তবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জাতিসংঘের মহাসচিবকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। এটা সত্য যে, জাতিসংঘ যদি চেষ্টা চালায় তাহলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়টি আরও সহজ হবে। অন্তত সমাধান সূত্রও পাওয়া যাবে।
মিয়ানমারের বর্তমান অবস্থা:
এই মুহূর্তে গৃহযুদ্ধে পুড়ছে পুরো মিয়ানমার। রাখাইন, মংডুসহ একের পর এক গুরুত্বপূর্ণ শহর বিদ্রোহীদের দখলে। অন্যান্য জায়গায় তাদের সঙ্গে তুমুল লড়াই চলছে জান্তা সরকারের। উল্লেখ্য, ২০২১ সালে মিয়ানমারের সেনা অভ্যুত্থানের পর সেখানে সরকার গঠন করেছে জান্তা সরকার।
আড়াই বছর ধরে তারাই দেশ চালাচ্ছে। সেই থেকে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের দাবিতে বারবার বিদ্রোহ হয়েছে মিয়ানমারে। এরপর জোট বাঁধে তিন বড় বিদ্রোহী গোষ্ঠী টিএনএলএ (তাং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি), আরাকান আর্মি ও এমএনডিএএ (মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স আর্মি)। এই জোটের নাম ‘ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স।
২০২৩ সালের ২৭ অক্টোবর থেকে বিদ্রোহী জোট শুরু করে ‘অপারেশন ১০২৭’। এর জেরে মিয়ানমারের বেশ কয়েকটি প্রদেশে প্রবল বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠেছে। তার ওপর মিয়ানমারের উত্তরের রাজ্য রাখাইন দখল নিয়ে নেয় আরাকান আর্মি। এই রাখাইনই এখন গৃহযুদ্ধের কেন্দ্রবিন্দু। প্রাণ বাঁচাতে দেশ ছেড়ে পালাচ্ছে হাজার হাজার রোহিঙ্গা। অনুপ্রবেশ করছে আমাদের দেশে।
রোহিঙ্গাদের বরাদ্দ ও মহাসচিবের আশ্বাস:
সম্প্রতি ইউএস স্টেট ডিপার্টমেন্টে রোহিঙ্গাদের খাদ্য সহায়তার বাজেট সাড়ে ১২ ডলার থেকে কমিয়ে ৬ ডলারে নামিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই বরাদ্দ অনুযায়ী সারা মাসে প্রতি বেলায় একটি করে কলা কেনাই তাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়বে। বৈশ্বিক মূল্য বৃদ্ধি ও তার ওপর সহায়তা তহবিলের কাটছাঁট যা একরকম নাটকীয় প্রভাব পড়বে শরণার্থীদের ওপর।
তাই তো এবারের কক্সবাজার সফরকালে জাতিসংঘ মহাসচিব মি. গুতেরেস সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘খাদ্য সহায়তা কমালে লোকজন আরও বেশি ভোগান্তিতে পড়বে এবং অনেকে মারাও যাবে। আমরা সেটা কোনোভাবেই হতে দিতে পারি না যে, বিশ্ববাসী রোহিঙ্গাদের ভুলে যাবে। এই তহবিল হ্রাস সরাসরি এবং ভয়াবহ প্রভাব পড়বে মানুষের ওপর—তাদের বেঁচে থাকার জন্য পর্যাপ্ত খাবার আছে কি না, মৌলিক স্বাস্থ্যসেবা আছে কি না, অন্যান্য প্রয়োজনীয় পরিষেবা এবং সুরক্ষা আছে কি না, তা আমাদের নজর দিতে হবে।’
তবে আশার বিষয় হলো, জাতিসংঘের মহাসচিব প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, রোহিঙ্গাদের খাদ্য সহায়তা কমানোর বিষয়টি তিনি বিশ্বের বিভিন্ন দেশকে জানাবেন এবং কার্যকরী ভূমিকা রাখতে সহযোগিতা করবেন।
সলিডারিটি ইফতার:
কক্সবাজারে এবার এক আশ্চর্য ঘটনা সাক্ষী হয়েছে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা। প্রায় এক লাখ শরণার্থীর সঙ্গে ইফতার করেছেন জাতিসংঘের মহাসচিব। তা নিয়ে আমাদের প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, ‘জাতিসংঘের মহাসচিব তার শত ব্যস্ততার মাঝেও আপনাদের সঙ্গে ইফতার করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন, যা আমাদের জন্য সত্যিই সৌভাগ্যের বিষয়। আজ তিনি আপনাদের সঙ্গে ইফতার করছেন, এটি তার আপনাদের প্রতি আন্তরিকতা ও সহমর্মিতার প্রতীক।’
মূলত প্রতিবছর জাতিসংঘ মহাসচিব যেকোনো একটি মুসলিম দেশে গিয়ে ‘সলিডারিটি ইফতার’ করেন। যার মাধ্যমে তিনি মুসলিম ধর্ম ও বিভিন্ন সংস্কৃতির সাথে তার একাত্মতার জানান দেন। তবে এবারের সলিডারিটি ইফতারটি ভীষণ আলাদা। এর মাধ্যমে বিশ্ববাসীকে একটি নির্মোহ বার্তা দিয়েছি আমরা। এটি এখন স্পষ্ট যে রোহিঙ্গাদের পেছনে ফেলে রাখার দিন আর নেই।
সংকট মোকাবিলায় মহাসচিবের প্রস্তাবনা:
রোহিঙ্গা সমস্যা যে শুধু বাংলাদেশের সমস্যা তা নয় বরং এটি বৈশ্বিক সমস্যায় রূপান্তরিত হয়েছে। দেশের রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে এবারের জাতিসংঘ মহাসচিবের দৃঢ় প্রস্তাবনাগুলো অনেকটা আশার আলো দেখাচ্ছে। তার প্রথম প্রস্তাবনা হলো, চূড়ান্তভাবে মিয়ানমারকেই সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করতে হবে।
দ্বিতীয় প্রস্তাবনা হলো, আশ্রিত শরণার্থীদের স্বেচ্ছায়, নিরাপদে এবং টেকসই প্রত্যাবর্তনের জন্য যতক্ষণ না পরিস্থিতি অনুকূল হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত সহযোগিতা করা।
তৃতীয় প্রস্তাবনা হলো, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সাথে নিয়ে সমস্যার সমাধান করা।
চতুর্থ প্রস্তাবনা হলো, শরণার্থীদের সঙ্গে মানবিক ও সংহতিপূর্ণ আচরণ করা।
বাংলাদেশ আশ্রিত রোহিঙ্গাদের হালচাল:
মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর হাতে ব্যাপক নিপীড়নের শিকার হয়ে বাংলাদেশে পাড়ি দিয়েছে প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা। তাদের প্রত্যাবাসন বিলম্ব হওয়ায় দিন দিন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সন্ত্রাস ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বেড়েই চলছে। মাদক ও অস্ত্র চোরাচালানসহ ভয়ংকর অপরাধেও তাদের সম্পৃক্ত থাকার তথ্য পাওয়া যাচ্ছে।
অনেক রোহিঙ্গা বাংলাদেশের পাসপোর্ট নিয়ে বিদেশে গিয়ে দেশের শ্রমবাজারের ক্ষতি করছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। সন্ত্রাসবাদের সঙ্গেও তাদের সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে ফলে রোহিঙ্গারা শুধু বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে উঠেছে না বরং দক্ষিণ এশিয়ার পুরো অঞ্চলের জন্যও নিরাপত্তা হুমকি। সব মিলিয়ে রোহিঙ্গা সমস্যা বাংলাদেশের জন্য এখন গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান সূত্র:
রোহিঙ্গাদের তাদের নিজ দেশে প্রত্যাবাসনই একমাত্র সমাধান হলেও নানা জটিলতায় আটকে আছে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া। প্রত্যাবাসনের জন্য একটি অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে আসিয়ান এবং জাতিসংঘসহ আঞ্চলিক অংশীদারদের সঙ্গে সংলাপ এবং সহযোগিতাকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত।
রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে বহুমুখী কূটনৈতিক প্রচেষ্টা জরুরি। মিয়ানমার ও রাখাইন রাজ্যে যুদ্ধ বন্ধে এবং স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে প্রভাবশালী দেশগুলোর কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য মিয়ানমারের ওপর যথাযথ চাপ প্রয়োগ করা। এ ব্যাপারে তাদের এই নীরবতা; এমনকি চীন, ভারত বা রাশিয়ার মতো দেশগুলোর মিয়ানমারের সামরিক জান্তার প্রতি সমর্থন বা এ ব্যাপারে তাদের নীতি পুনর্বিবেচনা করা উচিত।
দ্রুত রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান না হলে নানা ঘাত-প্রতিঘাত সৃষ্টি হতে পারে এবং বিভিন্ন গোষ্ঠী এ সুযোগ নিয়ে শুধু বাংলাদেশ নয়, পুরো অঞ্চলে অস্থিতিশীল অবস্থার সৃষ্টি করতে পারে।
জাতিসংঘ মহাসচিবের সফরে আমাদের প্রাপ্তি:
জাতিসংঘ নিশ্চয়ই কোনো আঞ্চলিক সংগঠন নয়, বিশ্বব্যাপী এর ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। জাতিসংঘ যে কথাটি বলবে পৃথিবীর অন্যান্য দেশ তা সমীহ করতে অনেকটা বাধ্য। প্রাপ্তির খাতা যে নেহায়েত কম এটা কিন্তু এখনই বলা যাচ্ছে না। তবে সংকট নিরসনের রাস্তা যে উন্মোচিত হলো এটা বলা যাচ্ছে। জাতিসংঘ মহাসচিবের সফর নিশ্চয়ই বৈশ্বিক একটি তাৎপর্য বহন করে। এর উপরে তার প্রস্তাবনা নিশ্চয়ই আশার আলো দেখাবে।
আমাদের শক্তি হলো অধ্যাপক ড. ইউনুসের মতো আমাদের একজন লিডার পেয়েছি। যার ডাকে বিশ্বের তাবড়-তাবড় নেতৃত্ব সমীহ করতে বাধ্য। তার দূরদর্শী ও কারিশম্যাটিক নেতৃত্বে এই সমস্যার সমাধান আমরা অচিরে করতে পারবো। এবারের জাতিসংঘের মহাসচিবের এই সফর নিশ্চয়ই আমাদের কাছে ভরসার জায়গা। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তিনি তার জাত চেনাবেন এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
প্রশান্ত কুমার শীল ।। শিক্ষক ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক
[email protected]
সম্পর্কিত বিষয়:
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: