বুধবার, ১৯শে মার্চ ২০২৫, ৫ই চৈত্র ১৪৩১


যুদ্ধবিরতি চুক্তি ভেঙে গাজায় হামলা কেন?


প্রকাশিত:
১৯ মার্চ ২০২৫ ১২:১৬

আপডেট:
১৯ মার্চ ২০২৫ ১২:১৭

ছবি সংগৃহীত

নতুন করে গাজার বিস্তৃত এলাকায় ইসরায়েলের হামলায় নিহত হয়েছেন গাজা উপত্যকার ডি-ফ্যাক্টো প্রধানমন্ত্রী ইশাম দা-লিসসহ বেশ কিছু শীর্ষ নেতৃত্ব। ইসরায়েলি বাহিনী গাজার শীর্ষ নেতৃত্বকে হত্যার মধ্য দিয়ে নিজেদের নিরাপদ রাখার অংশ হিসেবে এই হামলা পরিচালনা করেছে বলে জানিয়েছে।

দীর্ঘ ১৫ মাসের যুদ্ধের পর ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে অভিষেকের আগের দিন হামাস-ইসরায়েলের মধ্যকার যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষরকে অনেকেই আশা জাগানিয়া হিসেবে দেখেছিলেন। ধারণা করা হয়েছিল যে, ‘যুদ্ধবিরতি না হলে এর জন্য দায়ী পক্ষকে নরকের স্বাদ গ্রহণ করতে হবে’—ট্রাম্পের এ ধরনের কঠোর বার্তার কারণেই তার দায়িত্ব গ্রহণের ঠিক আগ মুহূর্তে একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।

প্রত্যাশার পারদ নিম্নমুখী হতে সময় লাগেনি। দুই পক্ষের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরের কিছুদিন পর থেকেই গাজা নিয়ে ট্রাম্পের ভিন্ন পরিকল্পনা যেন আগুনে ঘি ঢেলে দেওয়ার মতো হয়ে উঠল! ‘গাজা আর বসবাসের উপযুক্ত নয় এবং যারা এর অধিবাসী তাদের অন্যত্র সরে যাওয়া উচিত’—এ ধরনের মন্তব্যের সাথে গাজাকে একটি উন্নতমানের পর্যটন নগরী হিসেবে গড়ে তুলতে ট্রাম্পের পরিকল্পনার বিষয়টি যখন চাউর হতে থাকে, তখন আর বুঝতে বাকি রইল না যে পরিকল্পিত তিন দফার এই যুদ্ধবিরতি প্রথম দফার পর আর আলোর মুখ দেখতে পারবে না।

ইতিমধ্যে প্রথম দফার যুদ্ধবিরতি শেষে অতিক্রান্ত হয়েছে ১৬ দিন। যুদ্ধবিরতির সময় থেকেই এবং এই সময়ের মধ্যে হামাস এবং ইসরায়েলের মধ্যকার বন্দি বিনিময় নিয়ে বিরোধের জেরে দ্বিতীয় দফায় এই চুক্তি গড়ানো নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। প্রথম দফায় শর্ত ছিল দুই পক্ষই নির্দিষ্ট কিছু সংখ্যক ইসরায়েলি জিম্মি এবং ইসরায়েলের কারাগারে আটক হামাস সদস্যদের ফেরত দেবে এবং ইসরায়েল গাজায় মানবিক সহায়তা প্রবেশের পথ উন্মুক্ত করে দেবে।

দ্বিতীয় দফায় সব জিম্মিদের মুক্ত করে দেবে উভয় পক্ষ তবে গাজা থেকে সব সেনাসদস্য ফেরত নেবে ইসরায়েল। এই সময়ের মধ্যে ইসরায়েলের কিছু জিম্মির মৃতদেহ হস্তান্তর করে হামাস, যাদের মধ্যে ছিলেন ইসরায়েলের সেনা ইদা আলেক্সান্দারসহ ৪ জন। ইসরায়েল অভিযোগ করেছে যে, হামাস এদের ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যা করেছে।

অন্যদিকে হামাসের পক্ষ থেকেও প্রতিশ্রুত বন্দিদের ফেরত না দেওয়া নিয়ে ইসরায়েলকে অভিযুক্ত করে। ইসরায়েল দাবি জানিয়েছিল, দ্বিতীয় দফায় গড়ানোর আগে প্রথম দফার যুদ্ধবিরতিকে আরও দীর্ঘায়িত করতে। তাদের দিক থেকে সেনাদের সরিয়ে নিলে হামাস তাদের জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়। অন্যদিকে হামাসের দিক থেকে যুদ্ধবিরতির দ্বিতীয় দফায় প্রবেশ এবং সব ইসরায়েলি সেনা সরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে চাপ দিতে থাকে।

পরিস্থিতি যখন এমন, এই অবস্থায় ডোনাল্ড ট্রাম্পের পরিকল্পনা ইসরায়েলি বাহিনীকে নতুন করে গাজায় হামলা চালানোর জন্য উসকানি হিসেবে দেখা হচ্ছে। কিছুদিন আগেও যুদ্ধবিরতি নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে বিরোধের জেরে একপর্যায়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলে বসেছিলেন, ‘ইসরায়েলের উচিত এই যুদ্ধবিরতি থেকে বের হয়ে আসা’। এর প্রতিফলন আমরা অল্প সময়ের মধ্যেই দেখতে পাচ্ছি।

প্রথম দফার যুদ্ধবিরতির ১৬ দিন অতিক্রান্ত হওয়ার পর দুই পক্ষের মধ্যে দরকষাকষি গড়ায় নতুন করে ইসরায়েলের হামলার মধ্য দিয়ে। ১৮ মার্চ ২০২৫ ইসরায়েলের এই হামলায় ৪ শতাধিক নিরীহ ফিলিস্তিনি প্রাণ হারায়, যাদের মধ্যে অনেক নারী এবং শিশু রয়েছে।

শুধু তাই নয়, বাইডেন প্রশাসনের সময় নিরীহ মানুষ হত্যার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র যতটা কঠোরতা দেখিয়েছিল, বর্তমান সময়ে এসে এটা দৃশ্যমান নয়, বরং হামলার আগে আরবিতে লিফলেট ছড়িয়ে মানুষকে নিরাপদে চলে যাওয়ার বিষয়ে আগে সতর্ক করা হলেও এবারের হামলার আগে এমনটা অনুসরণ করা হয়নি, যা থেকে অনুমান করা যেতে পারে যে বাইডেন প্রশাসনের তুলনায় ট্রাম্প প্রশাসন ইসরায়েলের বিষয়ে অনেকটাই নমনীয়।

যদিও যুক্তরাষ্ট্রের সব প্রশাসনই ইসরায়েলের প্রতি সহানুভূতিশীল, এক্ষেত্রে ট্রাম্পের পরিকল্পনা ইসরায়েলকে আর আগ্রাসী হওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছে—এমন দাবিকে অগ্রাহ্য করার সুযোগ নেই।

বাস্তবে ট্রাম্প কি চাচ্ছেন, তা এখনো স্পষ্ট নয়। একদিকে তিনি ইসরায়েলকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন, গাজা খালি করার কথা বলছেন, আবার অন্যদিকে হামাসের সাথে নিজের প্রতিনিধিদল কাতারে পাঠিয়ে সরাসরি আলোচনা করছেন। এ সবকিছু খুব গোলমেলে ঠেকছে। তিনি কি সত্যিই গাজা খালি করার পরিকল্পনায় অটল রয়েছেন নাকি এর মধ্য দিয়ে তিনি হামাসকে নতুন কোনো চাপে রেখে যুক্তরাষ্ট্রের নির্দিষ্ট কোনো স্বার্থসিদ্ধি করতে চাইছেন, এসব নিয়েও আলোচনা রয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের সব সরকারই হামাসকে একটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসেবে দেখে এসেছে, তাদের এই নীতিকে সবসময়ই সমর্থন করেছে ইউরোপের দেশগুলো এবং তারা এই সংগঠনের সাথে যেকোনো ধরনের আলোচনা থেকে সবসময় দূরে থেকেছে।

বর্তমান এই অবস্থায় এসে একদিকে ইসরায়েলের হামলা নতুন করে শুরু হয়েছে, আবার অন্যদিকে হামাসের সাথে আলোচনা, শুধু তাই নয়, ইরানের সাথেও নতুন করে আলোচনা শুরু করার বিষয়ে ট্রাম্পের প্রস্তাব এবং ইরানের প্রত্যাখ্যান—এ সবকিছুকে এক সুতোয় আনতে গেলে আমরা যা বুঝতে পারব তা হচ্ছে ট্রাম্প তথা যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের এই মুহূর্তে এটাই উপলব্ধি হয়েছে যে ইরান ইতিমধ্যে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের ৬০ শতাংশে পৌঁছে গেছে, যা ৯০ শতাংশে উত্তীর্ণ হলে পরমাণু অস্ত্র তৈরির দ্বারপ্রান্তে পৌঁছানো হবে।

এমনটা হলে যুক্তরাষ্ট্র তথা মধ্যপ্রাচ্যে তাদের পরম মিত্র ইসরায়েলের জন্য এটা একটা বড় হুমকি হিসেবে বিবেচিত হবে এবং যেকোনো সময় ইরান-ইসরায়েলের মধ্যকার উত্তেজনা পরমাণু অস্ত্রে ব্যবহারের সম্ভাবনা সৃষ্টি করতে পারে।

এমন অবস্থায় ইসরায়েলের দিক থেকে হামাসকে নতুন করে চাপে রেখে, আবার যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে হামাসের সাথে আলোচনা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ইরানকে এই বার্তা দেওয়া যে তাদের জন্য আপসের সুযোগ রয়েছে। এদিকে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ বন্ধ নিয়ে ট্রাম্পের পরিকল্পনার অংশ হিসেবে রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের সাথে দীর্ঘ ফোনালাপ শুরু করেছেন ট্রাম্প।

আমাদের এটাও স্মরণে রাখা প্রয়োজন যে, ইরানের সবচেয়ে বড় মিত্র হচ্ছে রাশিয়া। আবার সম্প্রতি চীনের পক্ষ থেকেও আলোচনার প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়েছে ইরান। সেক্ষেত্রে হামাসকে দুর্বল করার ইসরায়েলি চেষ্টা ইরানকে আর বেশি প্রতিক্রিয়াশীল করে তুলতে পারে, যার পেছনে নিঃসন্দেহে প্রত্যক্ষভাবে রুশ এবং পরোক্ষভাবে চীনের সমর্থন থাকবে।

ইসরায়েল কি হামাসকে এভাবে চাপে রেখে তাদের দলিত হয়ে যেতে থাকবে নাকি চীন এবং রাশিয়ার নীরবতা ভাঙার সময় এসেছে, এটা এই মুহূর্তে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। তবে ট্রাম্পের পদক্ষেপ থেকে বোঝা যাচ্ছে যে তিনি খুব কৌশলী পথে এগোচ্ছেন।

ড. ফরিদুল আলম ।। অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়


সম্পর্কিত বিষয়:


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:




রিসোর্সফুল পল্টন সিটি (১১ তলা) ৫১-৫১/এ, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০।
মোবাইল: ০১৭১১-৯৫০৫৬২, ০১৯১২-১৬৩৮২২
ইমেইল : [email protected]; [email protected]
সম্পাদক : লিটন চৌধুরী

রংধনু মিডিয়া লিমিটেড এর একটি প্রতিষ্ঠান।

Developed with by
Top