হামজা চৌধুরী কি নতুন ত্রাতা, নাকি দিক বদলের উপলক্ষ্য?
প্রকাশিত:
২৩ মার্চ ২০২৫ ১১:১৭
আপডেট:
২৪ মার্চ ২০২৫ ২১:১৮

১৭ মার্চ দুপুরের দিকে একটি দীর্ঘ শরীর নামলো সিলেট আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। মাথাভরা ঝাঁকড়া চুল। মুহূর্তেই তাকে ঘিরে তৈরি হলো জনঅরণ্য। অনেক প্রতীক্ষার প্রহর শেষে বাংলাদেশের মানুষের ভালোবাসায় ভিজে যিনি ইংল্যান্ড থেকে এলেন, তিনি হামজা চৌধুরী (Hamza Choudhury)। পুরো নাম হামজা দেওয়ান চৌধুরী। ইংল্যান্ডের আলো-হাওয়া আর সিস্টেমে বেড়ে ওঠা ফুটবলার। ইতিহাসে এত বড় প্রোফাইলের ফুটবলার বাংলাদেশ জাতীয় দল কখনো পায়নি। সত্যিটা বললে, পাওয়ার স্বপ্নই আগে দেখেনি।
চারদিকে ১২০ ডেসিবেলের ক্যাকোফোনি। ক্লান্তি স্পষ্ট শরীরে। ঘামছেন। তারই মধ্যে সাংবাদিকদের চাহিদামতো প্রশ্নের উত্তরে হামজা সিলেটি কলোকিয়ালে বললেন, ‘আমরা উইন খরমু’।
২৫ মার্চ মঙ্গলবার, বাংলাদেশের সিলেট সন্নিহিত উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় শৈল শহর শিলংয়ে ভারতের বিপক্ষে ম্যাচটি জেতা যাবে কি না, সেটি রাত দশটার দিকেই জানা যাবে। তার আগে বাংলাদেশের সীমানা পেরিয়েও কোটি কোটি চোখ ওই ঝাঁকড়া চুলো দীর্ঘ শরীর আর আট নম্বর জার্সিতে আটকে থাকবে। বাংলাদেশ কি জিতবে? পুরো দেশই প্রত্যাশায় রঙিন। প্রত্যাশার তীরকে হামজাই অনেক উঁচুতে বেঁধে দিয়েছেন, ওই যে দেশের জার্সি গায়ে তোলার আগেই বলে দিয়েছেন, ‘আমরা উইন খরমু’!
জিতলে হামজা জ্বরে পারদ চড়বে অস্বাভাবিক। ড্র করলেও হামজা উন্মাদনা ভাটার টান দেখার সম্ভাবনা কম। এ ম্যাচে হয়তো পারা গেল না, কিন্তু ফিরতি ম্যাচ জিততে হামজা-টনিক তো থাকছেই। হেরে গেলেই সর্বনাশ। আমাদের স্বভাবগত আবেগ চোট পাবে। আমরা মুখ ফসকে তখন বলেও ফেলতে পারি, হামজাকে দিয়ে আর হবে না।
বিনা বিনিয়োগে সাফল্যের উচ্চাকাঙ্ক্ষা আমাদের সামান্যতেই হতাশ করে। জানি না আমরা কতটা তলিয়ে দেখতে রাজি থাকবো যে, ১১ জনের ফুটবলে একজন মাত্র খেলোয়াড় কোনো জাদুদণ্ড দিয়ে অলৌকিক কিছু করতে পারে না। ২০০৫ সালে সাফ ফুটবলে পাকিস্তান দলের হয়ে খেলা জেশ রেহমান (Zesh Rehman)-এর উদাহরণ আমরা ভুলিনি।
অনেক প্রত্যাশা নিয়ে পাকিস্তানের হয়ে সেবার খেলতে আসেন ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের দল ফুলহ্যামে খেলা ডিফেন্ডার। তেমন কিছুই করতে পারেননি। সেমিফাইনালে জেশের পাকিস্তানকে ১-০ গোলে হারিয়ে ফাইনালে ওঠে বাংলাদেশ। পাকিস্তানের হয়ে আর খেলতে দেখা যায়নি জেশকে।
জেশের চেয়ে হামজার প্রোফাইল অবশ্যই বড়। মূল পজিশন ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার। রাইটব্যাকেও স্বচ্ছন্দ। আক্রমণাত্মক মিডফিল্ডারের ভূমিকাতেও মানিয়ে নিতে পারেন। মোট কথা, চৌকশ ফুটবলার। বোঝাই যায় তাকে কেন বার্সেলোনাও একসময় খুব করে পেতে চেয়েছিল। হামজা হলেন, রদ্রি-বুসকেটস ঘরানার খেলোয়াড়।
১৮১ বছরের পুরোনো ক্লাব লেস্টার সিটির একাডেমিতে পরিপুষ্ট হয়ে ২০১৫-১৬ মৌসুমে পেশাদার ক্যারিয়ার শুরু লেস্টার সিনিয়র দলে। রূপকথা লিখে প্রথমবারের মতো প্রিমিয়ার লিগ জেতা দলে সেবার কোনো ম্যাচ খেলারই সুযোগ পাননি। পরের মৌসুমেও বসে থাকতে হয়।
২০১৭-১৮ মৌসুমে লিগ ও লিগ কাপ মিলিয়ে খেলেন ৯টি ম্যাচ। সেই থেকেই গ্যারি লিনেকারের সাবেক ক্লাবের নীল জার্সিতে তাকে চিনে নেয় ইংলিশ ফুটবল। নামের সঙ্গে চৌধুরী পদবী যুক্ত থাকায় তার মধ্যে উপমহাদেশীয় শেকড়ের সংযোগ খোঁজার চেষ্টা করেছি। যখন জেনেছি, তার শরীরে বইছে অর্ধেক ক্যারিবীয় আর অর্ধেক বাঙালি রক্ত, আমরা উচ্ছ্বসিত হয়েছি।
এই উচ্ছ্বাস আরও বাড়িয়ে দিয়েছে ২০১৯ ও ২০২০ সালে রাশেদুল ইসলামের দুটি প্রতিবেদন। হামজার সঙ্গে মোবাইল ফোনে বাংলায় কথা বলে প্রথম আলোর এই ক্রীড়া সাংবাদিকই বাংলাদেশের হয়ে তার খেলার ইচ্ছেটা উসকে দিয়েছেন। তখনই ইংল্যান্ড অনূর্ধ্ব-২১ দলে খেলে ফেলা হামজা সামনে দেখছিলেন ইংল্যান্ড দলের প্রবেশদ্বার।
দুই/তিন বছর ইংল্যান্ডের জন্য অপেক্ষা করতে চেয়েছিলেন। তার সামনে দ্বিতীয় বিকল্প ছিল শুধুই বাংলাদেশ। না আসল বাবার দেশ, গ্রেনাডা নয়। কারণ ততদিনে মা রাফিয়া চৌধুরী ও সৎ বাবা দেওয়ান মোর্শেদ চৌধুরীর জন্মভূমি বাংলাদেশকেই নিজের শেকড় জ্ঞান করেছেন ইংল্যান্ডে জন্ম নেওয়া হামজা।
সেই দুই বছরের ছোট্টটি থেকে পেশাদার ফুটবলার হওয়ার আগ পর্যন্ত অজস্রবার এসেছেন হবিগঞ্জের বাহুবলে। এখানকার মাটির সঙ্গে হয়েছে সখ্য, ফুটবলে পা ছুঁয়েছেন প্রথম এখানেরই ঘাসে। বাংলাদেশের ছবিটা তাই আঁকাই ছিল হৃদয়ে। শুধু ছোট্ট একটা ডাক শোনার অপেক্ষায় ছিলেন।
বাফুফের আগের সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন প্রথম ডাক পাঠালেন। সেটাই তাকে অনেকটা এগিয়ে দিলো চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের দিকে। বর্তমান সভাপতি তাবিথ আওয়ালের সহযোগিতায় ঠিক হলো সবকিছু। যোগফল, এক সকালে লেস্টার সিটির হয়ে শতাধিক ম্যাচ খেলা হামজার ম্যানচেস্টার থেকে উড়ে আসা সিলেট বিমানবন্দরে। আর তাকে ঘিরে ফিফা র্যাংকিংয়ের ১৮৫ নম্বর দেশটির ফুটবলে বয়ে গেল আবেগের লাভাস্রোত।
হামজা-আবেগ দেখে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকেই ট্রল করেছেন—হামজা এসে গেল, এবার দরকার রুস্তম। হামজা আর রুস্তম বাংলাদেশ সরকারের দুটি উদ্ধারকারী জাহাজ। বড় নদীতে আকস্মিক লঞ্চ বা ফেরি ডুবে গেলে উদ্ধার করতে ছুটে আসে হামজা অথবা রুস্তম। কিংবা কখনো কখনো দুটি জাহাজই একসঙ্গে।
অচলায়তন ভেঙে হামজা একাই হয়তো বাংলাদেশের ফুটবলকে উদ্ধার করতে পারবেন না। তবে সঙ্গে রুস্তমের মতো কাউকে পেলে বড় সাহসে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারবেন।
এ দেশের অপেশাদার অথবা অপেশাদার বৃত্তে থাকতে চাওয়া ফুটবলে প্রবাসীদের এনে নতুন রক্ত সঞ্চালনের প্রথম চিন্তাটা কাজী সালাউদ্দিনের। যখন দেখলেন, সারা পৃথিবীর মতো ক্লাবের তৈরি করে দেওয়া ফুটবলার এখানে পাওয়া যাবে না, জাতীয় দলে ডেকে খেলোয়াড়দের তৈরি করতে হবে, আবার সেই খেলোয়াড় নিয়ে টানাটানি করবে ক্লাবগুলো, চোখ রাঙাবে; সালাউদ্দিন নেমে পড়লেন বিদেশের লিগে খেলা বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত খেলোয়াড়ের খোঁজে।
সেই সুবাদেই পাওয়া জামাল ভূঁইয়া-তারেক কাজীকে। জামাল-তারেক হয়তো খুব উঁচু মানের নন, কিন্তু ডেনিশ ও ফিনিশ লিগের নিচু স্তরে খেলেও বাংলাদেশের ঘরোয়া লিগের খেলোয়াড়দের চেয়ে বেশি পেশাদার মানসিকতা তারা আত্মস্থ করেছেন। হামজা আসায় এটা সঞ্চারিত হবে খেলোয়াড়দের। যে শরীর লগ্নি করে পেশাদার ফুটবল খেলে কাড়ি কাড়ি টাকা কামাবে, সেই শরীরটাকে ফুটবলের জন্য সবসময় তৈরি রাখো-এই শিক্ষাটা হামজার কাছ থেকে তপু-মোরসালিনরা হয়তো নেবেন।
এটাও ঠিক, এক হামজাকে এনেই দেশের ফুটবলকে মগডালে তুলে দেওয়া গেছে, এটা যদি ভেবে থাকেন দেশের ফুটবলের ভাগ্যবিধাতারা, বড় ভুল করবেন। হামজাকে দিতে হবে যোগ্য অনুশীলন সুবিধা। সাপোর্ট স্টাফও হতে হবে, উঁচুমানের। তার ক্লাবের সঙ্গে (লিস্টারশায়ার বা শেফিল্ড ইউনাইটেড) অনুশীলন সমন্বয় করতে হবে। আর এসব ঠিকঠাক করতে পারলেই হামজার স্পর্শ বাংলাদেশের ফুটবলে ফলাতে পারে সোনা।
হামজা প্রকল্পটা ঠিকঠাক কার্যকর হলে ভবিষ্যতে হয়তো এমএলএসে খেলা কুইন সুলিভানকেও আমরা দেখবো লাল-সবুজের জার্সিতে। অন্য কোনো ইউরোপিয়ান দেশ থেকেও হঠাৎ বৃষ্টির মতো পেয়ে যেতে পারি উপহার। ঠিক এখানেই নিরাপত্তাহীনতা কাজ করবে ঘরোয়া ফুটবলারদের মধ্যে। সেটি হবে তাদের জন্য জেগে ওঠার ডাক। তবে চিরস্থায়ী স্বার্থবাদী একটি গোষ্ঠীর জোট, যাকে বলে সিন্ডিকেশন, গড়ে ওঠার আশঙ্কাও যে এখানে থাকে না, তা নয়। সেটি নির্মূল করে দেয়ার সততা থাকতে হবে ফুটবলের প্রশাসকদের।
আশার কথা, জেগে উঠছে ফুটবলপ্রিয় একটি নতুন প্রজন্ম। ফুটবল যে সত্যিকারের বৈশ্বিক খেলা, এরা সেটা বুঝতে পেরেছে, পেতে শুরু করেছে ফুটবল-অমৃতের স্বাদ। আমরা আশাবাদী, গোষ্ঠীতন্ত্রের বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকবে এরা।
এক হামজা এসে বাংলাদেশ দলের বাজারমূল্য বাড়িয়ে দিয়েছেন। একটা জরিপে দেখলাম, যেখানে ভারতের পুরো দলের বাজারমূল্য ৭২ কোটি রুপি, সেখানে হামজার একারই সেটি ৫৫ কোটি রুপি।
হামজার কারণে ভারত এশিয়ান কাপ বাছাইয়ের ম্যাচের আগে বাংলাদেশ নিয়ে একটু উদ্বিগ্ন না হয়ে পারেই না। সমীকরণটা মিলিয়ে দিচ্ছেন অবসর ভেঙে ফিরে আসা ৪০ বছর বয়সী স্ট্রাইকার সুনীল ছেত্রী।
সুনীলের কাজ সুনীল করুন। আমরা তাকিয়ে থাকবো হামজার দিকে। আমরা হামজাকে আরেকজন জেশ রহমান হতে দিতে পারি না। হামজা হোন আমাদের ফুটবলের শুভাশীর্বাদ। প্রথমত মাঠের খেলায়, তারপর সামগ্রিক উন্নতির সূচকে।
পবিত্র কুন্ডু ।। স্পোর্টস এডিটর, এটিএন নিউজ
সম্পর্কিত বিষয়:
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: