বুধবার, ২৬শে মার্চ ২০২৫, ১১ই চৈত্র ১৪৩১


ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে বাংলাদেশ, করণীয় কী?


প্রকাশিত:
২৪ মার্চ ২০২৫ ১১:১১

আপডেট:
২৬ মার্চ ২০২৫ ০৩:২৪

ছবি সংগৃহীত

বাংলাদেশ, ভূ-তাত্ত্বিক অবস্থানের কারণে ভূমিকম্পের উচ্চ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। বিশেষ করে, এটি ভারতীয় ও ইউরেশীয় টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থলে অবস্থিত, যা ভূমিকম্পের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে। বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিকভাবে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বাংলাদেশে একাধিক ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে, যা ভবিষ্যতে আরও শক্তিশালী ভূমিকম্পের ইঙ্গিত দেয়।

দুর্যোগ সূচকে বিশ্বে ভূমিকম্পের জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ২০টি শহরে তালিকায় রয়েছে ঢাকা। রাজধানী ঢাকা ছাড়াও চট্টগ্রাম, সিলেট ও ময়মনসিংহের মতো শহরগুলো অত্যন্ত ভূমিকম্প-প্রবণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত। অধিক জনসংখ্যার ঘনত্ব, অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও দুর্বল অবকাঠামো বাংলাদেশকে আরও বেশি ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে।

ভূমিকম্প শুধুমাত্র প্রাণহানি ঘটায় না, এটি অর্থনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতার ওপরও গভীর প্রভাব ফেলে। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের দুর্যোগ মোকাবিলার সক্ষমতা তুলনামূলকভাবে সীমিত, যার ফলে ভূমিকম্পের পর পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া দীর্ঘ সময় নিতে পারে।

বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি বড় ভূমিকম্প হয়েছে, যা উল্লেখযোগ্য ক্ষতি সাধন করেছে। ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পটি মেঘালয়ের কাছাকাছি হয়েছিল এবং এটি ছিল ৮.৭ মাত্রার। আরাকান থেকে দিল্লি পর্যন্ত কাঁপিয়ে তোলা ভূমিকম্পতে সেই কম ঘনত্বের জনসংখ্যার যুগেও ১৫৪২ জনের প্রাণহানি রেকর্ড হয়েছিল।

এই ভূমিকম্পে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও কলকাতার ভবনগুলো গুরুতর ফাটল ও ধসের সম্মুখীন হয়েছিল তার মধ্যে আহসান মঞ্জিল অন্যতম। এটিকে ‘রৌমারী ভূমিকম্প’ নামে আখ্যায়িত করা হয়। আসামে উৎপন্ন ১৯৫০ সালের এই ভূমিকম্পটিতে আসাম (ভারত) এবং তিব্বত (চীন) উভয়স্থানেই প্রায় ৪,৮০০ মানুষ নিহত হয়েছিল। এই ধ্বংসাত্মক ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছিল বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল মিয়ানমার এবং চীনের কিছু অংশে।

তবে এসব এলাকায় তেমন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। ১৯৯৭ সালের ২১ নভেম্বর চট্টগ্রামে ৬ মাত্রার একটি ভূমিকম্প ঘটে, যার প্রভাবে শহরের নানান স্থাপনায় ফাটল ধরে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশ নেপালে ২০১৫ সালে ৭ দশমিক ৮ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্প আঘাত হানে এবং এতে নিহত হন প্রায় ৯ হাজার মানুষ।

ওই ভূমিকম্প এতটাই শক্তিশালী ছিল যে এটি বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ভারত, ভুটান, চীনসহ আশপাশের প্রায় সব দেশে অনুভূত হয়েছিল। মিয়ানমারের কাছে উৎপন্ন ২০১৬ সালের ৪ জানুয়ারি ৬ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্পে কেঁপে উঠেছিল বাংলাদেশ। ভূমিকম্পটি ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় অনুভূত হয়, বেশকিছু ভবনে ফাটল ধরে এবং সেসময় আতঙ্কেই মারা যান ছয়জন।

সম্প্রতি বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। ২০২৫ সালের ৭ জানুয়ারি ৭.১ মাত্রার ভূমিকম্প বাংলাদেশে অনুভূত হয়, যা ঢাকা থেকে ৬১৮ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে উৎপন্ন হয়। ঠিক তার মাসখানেক পর অর্থাৎ ৫ মার্চ সকাল ১১:৩৬ মিনিটে ৫.৭ মাত্রার ভূমিকম্প ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেট অঞ্চলে অনুভূত হয় যার উৎপত্তিস্থল ছিল ভারত-মিয়ানমার সীমান্ত।

বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিকভাবে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে। ৯০ দিনে বাংলাদেশের আশেপাশে মৃদু তীব্র মাত্রার ৫০টিরও বেশি ভূমিকম্প হয়েছে এবং বিগত ১৫ বছরে ১৫০টির বেশি ছোট বড় ভূমিকম্প হয়েছে। বুয়েট ও সরকারের একটি যৌথ সমীক্ষার দেখা যায়, যদি ঢাকায় ৭ বা তার বেশি মাত্রার ভূমিকম্প হয়, তাহলে লাখ লাখ প্রাণহানির সাথে সাথে প্রায় ৭২ হাজার ভবন ধসে পড়বে, ১ লাখ ৩৫ হাজার ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং প্রায় ৭ কোটি টন কংক্রিটের ধ্বংসাবশেষ জমবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স বলছে, ঢাকার ৭৩ শতাংশ রাস্তা সংকীর্ণ, ফলে ভূমিকম্পের পর উদ্ধারকাজ পরিচালনা করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে। অনেক এলাকায় হয়তো উদ্ধার কার্যক্রম চালানোই সম্ভব হবে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগামী কয়েকদিনের মধ্যে বাংলাদেশে ৮.২ থেকে ৯ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানতে পারে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে বাংলাদেশ ও আশেপাশের এলাকায় ৪১টি ভূমিকম্প রেকর্ড করা হয়েছে, ২০২২ সালে ছিল ৫৪টি। এই তথ্যগুলো আমাদের ভবিষ্যতে বড় ধরনের ভূমিকম্পের সম্ভাবনা সম্পর্কে সতর্ক করে।

ভূমিকম্পের সময় সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া প্রাণহানি ও ক্ষতি কমাতে সাহায্য করতে পারে। ভবনের ভেতরে থাকলে টেবিল বা শক্ত কাঠামোর নিচে আশ্রয় নিতে হবে। জানালা ও ভারী আসবাব থেকে দূরে থাকতে হবে। লিফট ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকতে হবে। বাইরে থাকলে উঁচু ভবন, গাছ ও বৈদ্যুতিক খুঁটির কাছ থেকে দূরে থাকতে হবে। খোলা জায়গায় নিরাপদ স্থানে যেতে হবে। গাড়িতে থাকলে গাড়ি থামিয়ে অপেক্ষা করতে হবে। সেতু ও উঁচু রাস্তা থেকে দূরে থাকতে হবে।

ভূমিকম্পের সময় করণীয় সম্পর্কে মানুষের মধ্যে জনসচেতনতা বৃদ্ধি জানাতে প্রচার চালাতে হবে। দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য জরুরি পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে এবং দক্ষ ও প্রশিক্ষিত উদ্ধার কর্মীর মাধ্যমে প্রতিটি এলাকায় একটি করে টিম গঠন করে উদ্ধার কার্যক্রমের প্রশিক্ষণ দেওয়া।

শক্তিশালী ও স্থিতিশীল নির্মাণ উপকরণ ব্যবহার করে ভূমিকম্প-প্রতিরোধী ভবন নির্মাণ হবে। স্কুল, কলেজ ও অফিসে নিয়মিত ভূমিকম্প মহড়া করা উচিত। ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণের জন্য আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার করা প্রয়োজন। এ সম্পর্কে গবেষণা ও পর্যবেক্ষণ কার্যক্রম বৃদ্ধি করতে হবে।

বাংলাদেশ সরকার ভূমিকম্প মোকাবিলায় বেশকিছু কার্যক্রম পরিচালনা করছে। নতুন ভবন নির্মাণে ভূমিকম্প প্রতিরোধী প্রযুক্তি এবং বিল্ডিংয়ের কোডিং সিস্টেম বাস্তবায়ন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। বিভিন্ন সংস্থা ভূমিকম্প প্রস্তুতি মহড়া পরিচালনা করছে। ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণের জন্য নতুন গবেষণা কেন্দ্র চালু করা হয়েছে।

২০০৮ সালে হাইকোর্ট ভূমিকম্প মোকাবিলার জন্য একটি কমিটি গঠনের নির্দেশ দেয়। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর বেশকিছু প্রকল্প হাতে নিয়েছে, যার মধ্যে ১২ কোটি টাকার একটি প্রকল্প চলমান।

ভূমিকম্পের মতো ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় যথাযথ প্রস্তুতি ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি। বাংলাদেশ ভূমিকম্প ঝুঁকির মধ্যে থাকা একটি দেশ হওয়ায় এখানে পরিকল্পিত নগরায়ণ, ভূমিকম্প-প্রতিরোধী ভবন নির্মাণ, জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং জরুরি উদ্ধার ব্যবস্থার উন্নয়ন অপরিহার্য।

সরকার, স্থানীয় প্রশাসন এবং সাধারণ জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমেই ভূমিকম্পের সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি হ্রাস করা সম্ভব। উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ ও পূর্বাভাসের ব্যবস্থা চালু করা হলে ঝুঁকি অনেকটাই কমানো যাবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কর্মক্ষেত্র এবং আবাসিক ভবনগুলোতে নিয়মিত ভূমিকম্প মহড়া আয়োজনের মাধ্যমে মানুষকে সচেতন করা যেতে পারে।

বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য ভূমিকম্প মোকাবিলা শুধু একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার বিষয় নয়, বরং এটি দেশের ভবিষ্যৎ উন্নয়ন ও নিরাপত্তার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই ব্যক্তি, সমাজ এবং রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ভূমিকম্প মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় সকল প্রস্তুতি গ্রহণ করা এখন সময়ের দাবি।

অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার, ডিন, বিজ্ঞান অনুষদ; অধ্যাপক, পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ; যুগ্ম সম্পাদক, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) এবং চেয়ারম্যান, বায়ুমন্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস)।


সম্পর্কিত বিষয়:


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:




রিসোর্সফুল পল্টন সিটি (১১ তলা) ৫১-৫১/এ, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০।
মোবাইল: ০১৭১১-৯৫০৫৬২, ০১৯১২-১৬৩৮২২
ইমেইল : [email protected]; [email protected]
সম্পাদক : লিটন চৌধুরী

রংধনু মিডিয়া লিমিটেড এর একটি প্রতিষ্ঠান।

Developed with by
Top