উৎসবে-আনন্দে শিশুদের বিনোদন কেমন হওয়া উচিত
প্রকাশিত:
৩০ মার্চ ২০২৫ ১১:৩২
আপডেট:
১ এপ্রিল ২০২৫ ১৭:১২

জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদের ৩১ অনুচ্ছেদে বর্ণিত হয়েছে; খেলাধুলাসহ সাংস্কৃতিক ও শৈল্পিক কার্যকলাপে শিশুদের অংশগ্রহণের অধিকার রয়েছে। প্রশ্ন হলো, শিশুদের জন্য খেলাধুলাসহ সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের পরিকল্পনা ও ডিজাইন কারা করেন? কীসের ওপর ভিত্তি করে করেন? এমন ডিজাইন ও পরিকল্পনা তৈরিতে শিশুরা কীভাবে ভূমিকা পালন করে?
শিশুদের জন্য মুক্ত খেলার পরিবেশ আমাদের হা-হুতাশের একটি জায়গা। একই সাথে যেসব টেলিভিশন ভিত্তিক কনটেন্ট আমরা বড়রা শিশুদের জন্য তৈরি করি সেটাও স্পষ্ট কমতি বিদ্যমান। এই কমতির সবচেয়ে বড় কারণ হলো শিশুদের চাহিদা অনুযায়ী তাদের জগতের কোনো খোঁজখবর না করেই আমরা বড়রা অধিকাংশ কনটেন্ট শিশুদের জন্য বলে চাপিয়ে দেই।
আমরা কোনো প্রোগ্রাম পরিকল্পনার আগে কি শিশুদের সাথে কথা বলি? ডাটা সংগ্রহ করি? না। আমরা ধরেই নেই শিশুদের জন্য যেকোনো প্রোগ্রাম ডিজাইনে থাকবে ছড়া, কিছু শিশুসুলভ গানের নাচ, কথায় বা উচ্চারণে অস্বাভাবিক কণ্ঠস্বর। আমরা ধরেই নেই শিশুদের পছন্দের তালিকায় রাখতেই হবে জাদু, কার্টুন বা ছবি আঁকা! অথচ ওদের জগত কত বড়!
বড়দের অধিকারের প্রশ্নে, জায়গাগুলোয় বড়দের দুর্দান্ত অংশগ্রহণ থাকে অনেক ক্ষেত্রেই। কিন্তু যখন শিশুদের অধিকার রক্ষার প্রশ্ন আসে তখন আমরা বড়রা ওদের জগতকে যেভাবে দেখি, যেভাবে নিজেদের শৈশব কেটেছে, হাল ফ্যাশনে কী চলছে; এসব কিছুর একটা ছাপ তৈরি করি অথচ সেখানে শিশুদের কণ্ঠস্বর কতটা গুরুত্বপূর্ণ!
শিশুদের কথা শোনার জাতিগত অভ্যাস আমাদের কি তৈরি হয়েছে? আমরা কি শিশুদের মানুষ ভাবতে শিখেছি? আমরা কি সময় নিয়ে পৃথিবীর নানা বিষয়ে তাদের মতামত নেই? আমাদের ভাবনায় থাকে একটাই কথা; ওরা কি বোঝে? আসলে কি শিশুদের সাথে কথা না বলা পর্যন্ত জানার কোনো সুযোগ নেই যে তারা তাদের চারপাশের জগৎ সম্পর্কে কী ভাবে, কীভাবে ভাবে, কীভাবে দেখে, কীভাবে গ্রহণ করে?
শিশুদের অধিকার রক্ষার জন্য এই যে আমরা বড়রা শিশুদের পুরো জগতকে কোনো রকমের ইন্টার্যাকশন ছাড়াই চিনে ও বুঝে ফেলি; অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে এর চেয়ে শিশু সুলভ পদক্ষেপ আর কী হতে পারে? এমন শিশুসুলভ পদক্ষেপ আমি দেখতে পাই টেলিভিশনের নানা প্রোগ্রামে।
দেখুন ১৮ বছর বয়স এর নিচে একজন মানুষকে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে শিশু হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এমতাবস্থায় এই যে একটা বড় পরিসরের নানা বয়সের শিশু এদের প্রত্যেককেই হিসেবের ভেতরে এনে কি প্রোগ্রাম ডিজাইন করা হয়?
এবারে আমার শৈশব এর স্মৃতি কিছুটা রোমন্থন করি। খুব ছোটবেলায় বিটিভি দেখেই বড় হয়েছি অনেকগুলো দিন। ম্যাকগাইভার ভীষণ পছন্দের ছিল। ‘ওশিন’ দেখতাম। দেখতাম ‘ইত্যাদি’। এগুলো পারিবারিক কনটেন্ট যদি হয় তাহলে এগুলো ঠিক কোনো কোনো বয়সের শিশুদের উপযোগী কনটেন্ট?
এখানে একটা বিষয় আনতেই হয়, পারিবারিক মানে কোনো এডাল্ট সিন নেই তাই তো? পারিবারিক মানে বাবা-মায়ের কোনো ইন্টিমেইট দৃশ্যও নেই। পারিবারিক কনটেন্ট আসলে কী? এবং এই পরিবারের মধ্যে যে শিশুদের আমরা অন্তর্ভুক্ত করি, কনটেন্ট দেখার ক্ষেত্রে তাদের অংশগ্রহণ কীভাবে নিশ্চিত করি? সম্ভব হয়?
টেলিভিশন আজকার ঠিক কত শতাংশ মানুষ দেখেন? কত শতাংশ মানুষ পছন্দের কনটেন্ট খুঁজে পান। আমার নিজের ক্ষেত্রে নেটফ্লিক্স কিছুটা সময় নেয়। এছাড়া যেহেতু বেশিরভাগ কনটেন্ট ইউটিউবে পরবর্তীতে পাওয়া যায় কাজেই টেলিভিশন এর ব্যবহার সময়ের সাথে আমি নিজেই খুব কম করি। এবার আমার চারপাশের শিশুরা যাদের আমি চিনি তাদের প্রসঙ্গ নিয়ে একটু আলোচনা করি।
শিশুদের জন্য এখনকার আধুনিক টেলিভিশনের ইন্টারনেটভিত্তিক কনটেন্ট বহুল জনপ্রিয়। তবে ‘দুরন্ত’ নামক একটি চ্যানেল শিশুদের জন্য কিছু কনটেন্ট তৈরি করার চেষ্টা করছে। আমি নিজে কনটেন্টগুলো দেখেছি এবং আমার কন্যাকেও দেখিয়েছি। কিছু ভালো কনটেন্ট তারা তৈরি করতে সক্ষম কিন্তু এখানে বয়সের রেঞ্জ আমার দৃষ্টিতে একটি নির্দিষ্ট দলের জন্য।
আমি বলতে চাইছি ১৮ বছরের নিচে সব শিশুদের জন্য কনটেন্ট অনুপস্থিত। বাকি চ্যানেলগুলোর ক্ষেত্রে অবস্থা বেশ দুর্বল। উৎসব ছাড়া শিশুদের কেন্দ্র করে ঠিক কতগুলো প্রোগ্রাম তৈরি করা হয়? কেন অর্থ বরাদ্দ হয় না? কেন বিজ্ঞাপনদাতাদের অংশগ্রহণ বাড়ানো সম্ভব হয় না? কেন গৎবাঁধা কিছু প্রোগ্রামের বাইরে আমরা বের হতে পারছি না?
শিশুদের বিনোদন জগতকে সমৃদ্ধ করার কথা ভাবার আগে জানতে হবে কেন শিশুদের অধিকারের এই জায়গায় শিশুদের মতামত গ্রহণের কোনো সুযোগ নেই। কেন তৈরি হচ্ছে না? এরপর স্পষ্টভাবে আসবে প্রোগ্রামের মান নিয়ে প্রশ্ন। আসবে প্রোগ্রামের ফ্রিকোয়েন্সি নিয়ে প্রশ্ন।
আসবে সব বয়সের শিশুদের অন্তর্ভুক্তি করা নিয়ে প্রশ্ন। আসবে নতুনত্ব নিয়ে প্রশ্ন। আসবে শিশুদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি নিয়ে প্রশ্ন। আসবে টেলিভিশনকে নতুনভাবে, নতুন রূপে হাজির করার বিষয়ে প্রশ্ন। আসবে ইউটিউবের অসংখ্য কনটেন্ট-এর ভিড়ে বাংলাদেশের শিশুদের জন্য বাংলা ভাষায় এক্সক্লুসিভ কিছু কনটেন্ট তৈরির প্রশ্ন। আসবে শিশুদের সাথে সময় মিলিয়ে কনটেন্ট প্রদর্শনের সময় নির্ধারণের প্রশ্ন।
আমি নিজে সেই শিশুবেলা থেকে দেখছি বিভিন্ন উৎসবের ছুটিতে টানা যে প্রোগ্রামগুলো তৈরি করা হয় তার মধ্যে শিশুদের জন্য যে হাতেগোনা কিছু প্রোগ্রাম হতো সেগুলো বাদ দিয়ে বড়দের জন্য তৈরি প্রোগ্রাম বেশি দেখেছি। মজার বিষয় হলো, অনেক আগে তৈরি হানিফ সংকেতের তৈরি একটি নাটকের ডায়ালগ হঠাৎ মনে পড়লো, এ জন্যেই বলে স্বামী ও স্ত্রীর মাঝে কোনো গোপনীয়তা থাকতে নেই।
আমি তখন স্কুল পড়ুয়া। সে সময় এমন সব নাটক দেখতেই বেশি আনন্দ পেতাম। শিশুদের জন্য প্রজাপতির পাখা পরে গৎবাঁধা নাচ, বাবু বাবু টাইপের কণ্ঠে জাদুকরের জাদু, ডানে বামে ঢুলে ঢুলে গাওয়া গান; এগুলো একেবারেই টানেনি। এখন ভাবতে বসে নিজেকে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করছে ঠিক কী ধরনের টেলিভিশন কনটেন্ট হলে আমি দেখতাম?
কনটেন্ট কেমন হলে ছুটির সময়কার প্রোগ্রামের তালিকায় আমি ছোটদের প্রোগ্রামগুলো দেখতাম? হয়তো এমন কোনো প্রোগ্রাম যেখানে ছোটদের জন্য নয় বরং মানুষদের জন্য চিন্তা করে বানানো! এমন কিছু যা ভাবায়। ইদানীং ইরানের কিছু ভালো সিনেমার ডাবিং দেখি। এগুলো বেশ লাগে। হয়তো এমন কিছু!
এখনকার শিশুরা ইন্টারনেট ভিত্তিক কনটেন্ট-এর প্রতি বেশ এক্সপোজড। কাজেই তাদের জগতে অনেক বৈচিত্র্য। এমন সব গেমস এরা খেলে যেখানে শব্দ আর স্পেশাল এফেক্টের দারুণ মিশেল এদের এসবের মধ্যেই বুঁদ করে রাখে। এরা বুঁদ হয়ে আছে নানা সব টিকটকে। ইংরেজি ভাষায় তৈরি নানা সব কনটেন্টই থাকে বেশিরভাগ সময়। সেখানে বাংলা ভাষার প্রতি আগ্রহ তৈরি করতেই এমন সব কনটেন্ট-এর পরিকল্পনা থাকা উচিত যেগুলো এ সময়ের শিশুদের মানদণ্ডে কিছুটা হলেও উতরে যাবে।
দেখুন, আমি নিজে বাংলা ভাষার কটা চ্যানেল দেখি? আন্তর্জাতিক নানা চ্যানেল বিভিন্ন উৎসব উপলক্ষে বহু কনটেন্ট তৈরি করে। কাজেই না চাইতেও তুলনা চলে আসেই। প্রতিযোগিতা নিঃসন্দেহে বেড়েছে। এমতাবস্থায় মান বৃদ্ধি ছাড়া গতি নেই। যদি না আমরা মনে করি যে শিশুদের কনটেন্ট দেখবে কে?
কাজেই কোনোরকম দায়সারাভাবে কিছু একটা করে অনএয়ার করি তা কি তারা দেখবে? দেখবে না এমন উত্তর ধরে এগোতে থাকলে নিশ্চিতভাবে প্রোগ্রামের মান বৃদ্ধির কোনো সম্ভাবনাই নেই কিন্তু তাই বলে শিশুদের অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে বড়দের দায় এড়িয়ে চললে তো হয় না!
কাজেই শিশুর অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে বিনোদনের এই জায়গাটাকে বিশেষভাবে চিহ্নিত করতে হবে। গুরুত্ব দিতে হবে, তৈরি করতে হবে। রাষ্ট্রের ওপর দায় চাপিয়ে দেবো না। এখন রাষ্ট্রের দিকে তাকিয়ে না থেকে নিজেদেরই সমাধানের রাস্তাগুলো খুঁজে বের করতে হবে। চলুন শুরু করি।
ফারহানা মান্নান ।। প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী, শৈশব; শিক্ষা বিষয়ক লেখক ও গবেষক
সম্পর্কিত বিষয়:
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: