সোমবার, ১৪ই এপ্রিল ২০২৫, ১লা বৈশাখ ১৪৩২

Shomoy News

Sopno


ডেঙ্গুর জিনগত পরিবর্তন যেভাবে সংক্রমণ বাড়ায়


প্রকাশিত:
১৩ এপ্রিল ২০২৫ ১০:৪০

আপডেট:
১৪ এপ্রিল ২০২৫ ১৩:৩৪

ছবি সংগৃহীত

ডেঙ্গু জ্বর বাংলাদেশের জন্য একটি অন্যতম জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন, অপরিকল্পিত নগরায়ন এবং জনসচেতনতার অভাবের ফলে এডিস মশাবাহিত এই রোগের প্রকোপ ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে।

প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে ডেঙ্গুর সংক্রমণ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে, যা জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর মারাত্মক চাপ সৃষ্টি করে। আগাম ব্যবস্থা না নিলে ২০২৫ সালে ডেঙ্গু পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে।

বাংলাদেশে ডেঙ্গুর সংক্রমণ প্রথম ধরা পড়ে ২০০০ সালে, তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় এর প্রকোপ আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে ২০১৯ ও ২০২৩ সালে ডেঙ্গু ভয়াবহ রূপ নেয় এবং মৃত্যুহারও উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যায়।

বর্তমানে ডেঙ্গু শুধু ঢাকায় সীমাবদ্ধ নেই, বরং সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে বাংলাদেশে ডেঙ্গুর সংক্রমণ অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় চিকিৎসা ব্যবস্থাও চাপে পড়েছে।

ডেঙ্গুর জন্য দায়ী মূলত এডিস এজিপ্টি এবং এডিস এলবোপিক্টাস প্রজাতির মশা। এগুলো সাধারণত দিনের বেলায়, বিশেষ করে সকাল ও সন্ধ্যার সময় মানুষকে কামড়ায়। তবে আমাদের গবেষণায় প্রমাণিত, ডেঙ্গু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রাতের বেলায়ও কামড়ায়।

এডিস মশা সাধারণত পরিষ্কার ও জমে থাকা পানিতে ডিম পাড়ে। যেমন—ফুলের টব, পরিত্যক্ত টায়ার, প্লাস্টিকের পাত্র, ফ্রিজের ট্রে, এসির পানির জমানো স্থান ইত্যাদি।

অপরিকল্পিত নগরায়ন এবং ছোট শহরে অধিক জনসংখ্যার কারণে প্রচুর পরিমাণে ছোট বড় পাত্র তৈরি হয় যার মধ্যে পানি জমা হয়ে মশার বংশবৃদ্ধির সুযোগ তৈরি করছে।

প্লাস্টিকের বহুল ব্যবহারের ফলে তৈরি হচ্ছে নানা ধরনের প্লাস্টিকের পাত্র তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো প্লাস্টিকের বোতল, কাপ, ব্যাগ ইত্যাদি। এসব পাত্রে বৃষ্টি হলেই কম বেশি পানি জমা হয় এডিস মশার প্রজননের জন্য আদর্শ জায়গা তৈরি করে।

বাংলাদেশের গ্রাম থেকে শহরে প্রায় সব জায়গায় অপরিকল্পিত নগরায়ন ও দুর্বল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ফলে ডেঙ্গুর প্রকোপ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। অপরিকল্পিত ড্রেনেজ ব্যবস্থা এবং বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের অভাবে বিভিন্ন স্থানে পানি জমে থাকে, যা মশার বংশবৃদ্ধির ক্ষেত্র তৈরি করে। শহরে উঁচু ভবন ও ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় আলো-বাতাস চলাচল কম হওয়ায় মশার সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পায়।

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশে তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা বৃদ্ধি পেয়েছে, যা ডেঙ্গু সংক্রমণের জন্য অত্যন্ত সহায়ক পরিবেশ তৈরি করেছে। গবেষণায় দেখা গেছে, উষ্ণ আবহাওয়ায় ডিম থেকে পূর্ণবয়স্ক মশা হয়ে উঠতে কম সময় লাগে, ফলে মশার সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পায়।

আগে শুধুমাত্র বর্ষাকালে ডেঙ্গু দেখা যেত, কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এখন গ্রীষ্মকালেও ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে অনিয়মিত ও অতি বর্ষণের ফলে বিভিন্ন স্থানে পানি জমে থাকে, যা মশার জন্মের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করে।

ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটি প্রধান ধরন বা সেরোটাইপ (DENV-1, DENV-2, DENV-3, এবং DENV-4) রয়েছে। একবার একটি সেরোটাইপ দিয়ে কোনো ব্যক্তি আক্রান্ত হলে, শরীরে সেই সেরোটাইপের বিরুদ্ধে ইমিউনিটি গড়ে ওঠে। ওই একই সেরোটাইপ দিয়ে দ্বিতীয়বার আক্রান্ত না হলেও অন্য সেরোটাইপের ডেঙ্গু ভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি থেকে যায়।

ভাইরাস খুব দ্রুত মিউটেটেড বা পরিবর্তিত হতে পারে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, ডেঙ্গুর ধরন পরিবর্তিত হলে সংক্রমণ আরও মারাত্মক হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, DENV-2 এবং DENV-3 ধরনের সংক্রমণ সাধারণত বেশি মারাত্মক রূপ নেয়, এবং এগুলো ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভারের ঝুঁকি বাড়ায়।

একবার একটি ধরন বা সেরোটাইপ দিয়ে আক্রান্ত হওয়ার পর যদি অন্য ধরন দ্বারা সংক্রমিত হয়, তাহলে এন্টিবডি-ডিপেন্ডেন্ট এনহান্সমেন্ট (ADE) নামক একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সংক্রমণ আরও গুরুতর হতে পারে। এই প্রক্রিয়াতে ইমিউন সিস্টেম ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং রোগী রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে।

পরিবর্তিত পরিবেশে ভাইরাস খুব দ্রুত অভিযোচিত হয়। ভাইরাসের জিনগত পরিবর্তনের ফলে এটি আরও সংক্রামক হতে পারে এবং ভ্যাকসিন বা চিকিৎসা পদ্ধতিও কম কার্যকর হয়ে যেতে পারে।

তাই অন্টোলজিক্যাল সার্ভিলেন্সের পাশাপাশি সেরো সারভিলেন্স বা ভাইরাসের জিনগত পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ করতে নিয়মিত জেনেটিক সার্ভিলেন্স করা প্রয়োজন।

ডেঙ্গুর প্রতিটি সেরোটাইপ ও তার সংক্রমণের ধরন নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা করা উচিত। সাধারণ জনগণ, চিকিৎসক ও নার্সদের ডেঙ্গুর নতুন ধরন ও ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতন করা জরুরি।

ডেঙ্গু বাংলাদেশের জন্য একটি ক্রমবর্ধমান স্বাস্থ্যঝুঁকি হয়ে উঠেছে। এটি প্রতিরোধে সরকারি উদ্যোগ, গবেষণা, জনসচেতনতা এবং ব্যক্তিগত প্রতিরোধ ব্যবস্থা একসঙ্গে কাজ করতে হবে।

নগর পরিকল্পনা উন্নত করা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কার্যকর করা এবং জনগণকে সচেতন করা হলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। এখনই কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে ভবিষ্যতে ডেঙ্গুর প্রভাব আরও মারাত্মক হতে পারে।

তাই, সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে আনা এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে ডেঙ্গু প্রতিরোধের জন্য এখনই যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি।

ড. কবিরুল বাশার ।। অধ্যাপক, প্রাণীবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]


সম্পর্কিত বিষয়:


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:




রিসোর্সফুল পল্টন সিটি (১১ তলা) ৫১-৫১/এ, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০।
মোবাইল: ০১৭১১-৯৫০৫৬২, ০১৯১২-১৬৩৮২২
ইমেইল : [email protected]; [email protected]
সম্পাদক : লিটন চৌধুরী

রংধনু মিডিয়া লিমিটেড এর একটি প্রতিষ্ঠান।

Developed with by
Top