দ্য লিটল মাস্টার শচীন টেন্ডুলকার
প্রকাশিত:
২৪ এপ্রিল ২০২৫ ১১:০২
আপডেট:
২৪ এপ্রিল ২০২৫ ১৫:০১

২৪ এপ্রিল দিনটি অন্যরকম ক্রিকেট বিশ্বে, এইদিনে পৃথিবীতে জন্ম নিয়েছিলেন এমন একজন যাকে আধুনিক ক্রিকেটের অবতার বললেও অত্যুক্তি হয় না! হয় কী? ২০২৪ সালের এই দিনে তিনি পালন করেছিলেন তার গড়া ফাউন্ডেশনে, সমাজের অবহেলিত মেয়ে শিশুদের সাথে সময় কাটিয়েছিলেন, ফুটবল খেলেছিলেন। এই ভিন্ন মাত্রা শুধু তিনিই দিতে পারেন, কারণ তিনি শচীন রমেশ টেন্ডুলকার।
তিনি ‘ক্রিকেট ঈশ্বর’, ২০২৫ জন্মদিনের আগের সপ্তাহেও সংবাদের শিরোনাম হয়েছেন তিনি। কীভাবে? আরসিবি অধিনায়ক রজত পাতিদার ৩০ ইনিংসে আইপিএলে দ্রুত এক হাজার রানের নতুন রেকর্ড গড়েছেন। তো পুরোনো রেকর্ডটি কার? ছিল শচীন টেন্ডুলকারের! ভাবতে পারেন এই ধুম-ধারাক্কার যুগে এসেও শচীন কতটা সর্বজনীন?
সেই শচীন, যিনি ১৯৭৩ সালের ২৪ এপ্রিল মুম্বাইয়ে জন্মগ্রহণ করেন এমন এক পরিবারে, যেখানে ছিল সাহিত্য চর্চার বীজ। বাবা রমেশ টেন্ডুলকার মারাঠি ভাষার কবি ও সাহিত্যিক, পেশায় কলেজ শিক্ষক। বাবা রমেশের জীবনটা ছিল ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ, প্রথম স্ত্রী মারা যাওয়ার পর তারই বোন রজনীকে ঘরে আনেন তিনি।
নিতিন, অজিত ও সবিতা—বোনের এই তিন সন্তানকে নিয়ে শুরু হয় রজনীর নতুন সংসার। তিনের সাথে যোগ হয় নতুন এক অতিথি। পরিবারের সেই আদরের সন্তানের নাম শচীন। বাবা রমেশ টেন্ডুলকার ছিলেন বাঙালি সংগীতজ্ঞ শচীন দেব বর্মনের দারুণ ভক্ত, ছোট ছেলের নামও রাখেন তাই প্রিয় মানুষটির নামে। কালে-কালে সেই শচীনই হলেন ক্রিকেটের ‘মাস্টার ব্লাস্টার’।
মাত্র ১৬ বছর বয়সে তার অভিষেক দেখেছে ক্রিকেট বিশ্ব, পরের ২৪ বছর ছড়ি ঘুরিয়েছেন তাবৎ বোলারদের ওপর। অসংখ্য রেকর্ড পড়িমরি করে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে তার পায়ে—১০০ আন্তর্জাতিক সেঞ্চুরি, ৩৪ হাজার রান এই বিশ্বে আর নেই কারও ভাণ্ডারে। শততম সেঞ্চুরিটা করেছিলেন ঢাকায়, এশিয়া কাপের সেই ম্যাচে বাংলাদেশ হারিয়েছিল ভারতকে—কিন্তু জয় হয়েছিল শচীনের। ভারতীয় এক কবি লিখেছিলেন—‘শততম সেঞ্চুরি শ্রেষ্ঠ উপহার, করতালি-হর্ষধ্বনি তোমার পুরস্কার!’ জয়-পরাজয়ের চেয়েও কখনো কখনো ব্যক্তির অর্জন বড় হয়ে যায়, তারই এক অনন্য দৃষ্টান্ত সেই ম্যাচ।
২০১১ সালে ভারত যখন বিশ্বকাপ জিতেছিল, সেই দলটির সদস্য ছিলেন শচীন। কালের সেরা ব্যাটসম্যান ভিরাট কোহলি তার অগ্রজকে শ্রদ্ধা জানিয়েছিলেন এই বলে—‘২১টি বছর শচীন দেশের বোঝা কাঁধে বয়ে বেড়িয়েছেন, এখন আমাদের দায়িত্ব তাকে কাঁধে তুলে সেই সম্মানটা ফিরিয়ে দেওয়া।’
মনে করে দেখুনতো, ২০১৩ সালের নভেম্বরের সেই বিকেলের কথা! মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়াম তখন শচীন-শচীন রবে উচ্চকিত! একসময় মাইক্রোফোন ধরলেন তিনি, ছলছল চোখ আর কেঁপে-কেঁপে ওঠা কণ্ঠে যা শোনালেন তাতো কবিতারই নামান্তর—‘আমার ২৪ বছরের জীবন যেটা ছিল ২২ গজের মাঝে, অবিশ্বাস্য হলেও সত্য সেটা শেষ হতে যাচ্ছে! সেসব মানুষ যাদের অবদান ছিল তাদের আমি ধন্যবাদ দিতে চাই। আমার হাতে একটা তালিকা আছে যাতে কারও নাম ভুলে না যায়! এটা সত্যিই কঠিন এক সময় কথা বলার জন্য!’
শচীন সেদিন তার ক্যারিয়ারের প্রান্তরেখা শেষ বিকেলের আলোয় মিলিয়ে দিয়েছিলেন। শুধু মাঠের ক্রিকেটার হিসেবে নয় মানুষ হিসেবেও যে অনেক বড় তিনি, তা প্রমাণের বিন্দুমাত্র সুযোগ হেলায় হারাননি দারুণ মেধাবী মানুষটি।
শচীন মানেই যেন অদ্ভুত সব ব্যাপার-স্যাপার! আজও গণমাধ্যম তার পিছু ছোটে খবরের সন্ধানে, নতুন কিছু পাওয়ার লোভে। সারাজীবন যে লোকটি ব্যাট করলেন ডানহাতে, সেই লোকটিই কিনা কলম ধরেন বাঁ-হাতে। শোনা যায়, ক্রিকেট পাগল শচীন ছোটবেলায় ক্রিকেট ব্যাগ মাথার নিচে দিয়ে ঘুমাতেন।
একসময় স্বপ্ন দেখেছিলেন ফাস্ট বোলার হবেন, তবে লিজেন্ড ডেনিস লিলি তাকে পছন্দ করেননি! ভাগ্যিস লিলি সেদিন শচীনকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন, না হলে ব্যাট হাতে তার অনন্য সৃষ্টি কি পৃথিবী দেখতে পেত? তিন পাউন্ডের ওপরে ভারি ব্যাট চালাতেন শচীন, যা অন্য কোনো ব্যাটার চিন্তাও করতে পারতেন না।
স্ত্রী অঞ্জলি কিছুই খেতেন না যতক্ষণ ব্যাট করতেন লিটল মাস্টার। তার জীবনে ক্রিকেটটাই ছিল সবার ওপরে। বাবা-মা, ভাই-বোন, স্ত্রী-সন্তানরাও তাকে সেভাবেই সহযোগিতা করে গেছেন জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে। পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চি উচ্চতার মানুষটির জীবন সাফল্যে ভর-ভরান্ত, এরমাঝেও ‘কাঁটা হেরি ক্ষান্ত কেন কমল তুলি’ হয়ে আছে ক্রিকেটের মক্কা লর্ডসে কোনো সেঞ্চুরি করতে না পারার আক্ষেপ!
ক্রিকেটার না হলে টেনিস খেলোয়াড় হতেন এরকম কথা বহুবার বলেছেন শচীন। জন ম্যাকেনরো ছিলেন তার আইডল, রজার ফেদেরারের সাথে রয়েছে তার গাঢ় বন্ধুন্ত। মোটর স্পোর্টস কারেও দারুণ আগ্রহ তার, মাইকেল শুমাখার তাকে উপহার দিয়েছিলেন স্পোর্টস কার।
মজার ব্যাপার স্যার ডোনাল্ড ব্রাডম্যান শচীনকে দেখে উৎফুল্ল হয়ে বলেছিলেন—তিনি হয়তো শচীনের মতোই খেলতেন, কিছু মিল রয়েছে তাদের মাঝে। নিজের স্ত্রীকে সেকথা জিজ্ঞাসাও করেছিলেন—‘আমি কি তার মতো খেলতাম?’ স্ত্রী হেঁসে বলেছিলেন-‘হ্যাঁ!’
তবে শচীনের প্রিয় ক্রিকেটিং আইডল কিন্তু সুনীল গাভাস্কার, ইমরান খান ও স্যার ভিভিয়ান রিচার্ডস! অদ্ভুত এক কুসংস্কার মেনে চলতেন শচীন, সবসময় বাঁ পায়ের প্যাড আগে পরতেন! কখনোই এর অন্যথা করেননি আজীবন।
তবে সবচেয়ে বড় আইডল মা রজনী টেন্ডুলকার! ওয়াংখেড়ের সেই ‘শেষ ভাষণ’-এ মাকে তীব্রভাবে স্মরণ করেছিলেন এককালের বিস্ময় বালক! মাতৃজঠর থেকে বের হয়ে আসার পর জীবনের প্রতিটি স্তরে যে সেই মহীয়সীর অবদান। শচীন বললেন, ‘আমার মতো দুষ্টু শিশুকে দেখেশুনে রাখা মোটেও সহজ কাজ ছিল না। আজীবন চাকরি করেও আমার মা আমার যত্নআত্তিতে বিন্দুমাত্র ছাড় দেননি। আমার স্বাস্থ্য ও ফিটনেস নিয়ে সারাজীবন সচেতন তিনি। ২৪ বছর ধরে ভারতের হয়ে খেলা এবং তারও আগে বেড়ে ওঠার সময় এই কাজটি তিনি নিখুঁতভাবে করেছেন। আমি আমার মায়ের এই নিবেদনের কথা কীভাবে ভুলবো?’
বড় ভাই নিতিন সবসময় মনে করিয়ে দিতেন তার ভরসার কথা। অজিত শুধু রমাকান্ত আচরেকারের কাছে সঁপে দিয়ে বসে থাকেননি। নিজের ক্রিকেট ক্যারিয়ারটাও বিসর্জন দিয়েছেন ছোট ভাইয়ের জন্য। শচীন নিজেও তার পরিশুদ্ধ হয়ে ওঠার পেছনে অজিতের সমালোচনাকে গুরুত্ব দেন।
বোন সবিতার কিনে দেওয়া সেই কাশ্মীরি উইলো’র ব্যাটের কথা শচীন ভোলেননি ক্যারিয়ারের শেষ দিন পর্যন্ত! এমন একটি পরিবারের সান্নিধ্যে বড় হওয়ার পর শচীন যাকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পেয়েছেন সেই অঞ্জলিও তার চিকিৎসা পেশা বিসর্জন দিয়েছেন! পাশে থেকেছেন দৃঢ়চিত্তে, কন্যা সারা আর পুত্র অর্জুনের জীবনাচারও ওই ক্রিকেটময়!
শচীন তার দায়িত্ব ভোলেননি আজীবন, কী মাঠে, কী মাঠের বাইরে। সত্যিকারের এক ক্রীড়া আদর্শ হয়ে উঠেছেন তাবৎ বিশ্বের জন্য। তার অবসর নেওয়ার পরপরই ভারতের সর্বোচ্চ খেতাব ভারতরত্ন পেয়ে যান, এত কম বয়সে যেটি পাওয়ার রেকর্ড নেই আর কারও। শচীন হচ্ছেন সেই ক্রিকেটার যার চরম প্রতিদ্বন্দ্বীও তাকে ঘিরে যা বলেন তা কবিতা হয়ে যায়, সাহিত্যরস যেন বেয়ে-বেয়ে পড়ে। এই যেমন ব্রায়ান লারা বলেছিলেন, ‘পৃথিবীতে এমন একজন ব্যাটসম্যান আছে শুধুমাত্র তার খেলা দেখতে আমি টিকিট কেটে গ্যালারিতে বসে খেলা দেখতে রাজি আছি, আর তিনি হচ্ছেন শচীন টেন্ডুলকার। তিনি জিনিয়াস, আর আমি একজন সাধারণ।’ চির প্রতিদ্বন্দ্বীর ওপর কী পরিমাণ শ্রদ্ধা ও সম্মান থাকলে এমন কথা বলা যায়?
এখন আর শচীনের খেলা দেখার সুযোগ নেই। বৈশ্বিক অর্ন্তজালে ছড়িয়ে থাকা তার অসংখ্য ভিডিও আর ছবি একালের যুবক-কিশোরদের জন্য ক্রিকেট শেখা ও জানার বই হতে পারে! তার সম্পর্কে মহেন্দ্র সিং ধোনি একবার বলেছিলেন, শচীনের অনুশীলন দেখলেও নাকি মনে হয় ক্রিকেটের ব্যাকরণ বইয়ের দিকে তাকিয়ে আছেন তিনি। শুভ জন্মদিন ক্রিকেট ঈশ্বর, জীবন হোক আনন্দময়, সুখময়, সুস্বাস্থ্যে ভরা।
মানজুর মোরশেদ ।। এডিটর, টি-স্পোর্টস
[email protected]
সম্পর্কিত বিষয়:
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: