শুক্রবার, ২৬শে এপ্রিল ২০২৪, ১৩ই বৈশাখ ১৪৩১

Rupali Bank


স্বপ্নের দেশ, দুঃস্বপ্নের দেশ


প্রকাশিত:
১২ জুন ২০২০ ১৬:৪৯

আপডেট:
১৩ জুন ২০২০ ১৭:৫৬

করোনার এই দুঃসময়ে খবর মানেই মন খারাপ করা খবর, সংবাদ মানেই দুঃসংবাদ। তার মাঝেই হঠাৎ করে সারা পৃথিবী থেকে একটা খবর নির্মল শীতল বাতাসের মতো এসে আমাদের সবার হৃদয়কে জুড়িয়ে দিয়ে গেল। হঠাৎ করে আমরা আবার মানুষের উপর বিশ্বাস ফিরে পেতে শুরু করেছি, অনুভব করতে শুরু করেছি আমার দেশ, মুখের ভাষা, গায়ের রং ভিন্ন হতে পারে কিন্তু সারা পৃথিবীতে আমরা সবার আগে একজন মানুষ। এই পৃথিবীতে আমাদের সবার সমান অধিকার।

পুরো ব্যাপারটা শুরু হয়েছিল আমেরিকার একটা দৈনন্দিন “নিয়মিত” ঘটনা দিয়ে। জর্জ ফ্লয়েড নামে একজন কালো মানুষ গ্রেপ্তার হওয়ার সময় সাদা পুলিশের হাতে মারা গিয়েছে। আমেরিকার জন্য এটি এমন কোনো বড় ঘটনা নয়, সেই দেশে প্রতিবছর পুলিশের হাতে হাজার খানেক মানুষ মারা যায়। সেখানে কালো মানুষের সংখ্যা তেরো শতাংশ থেকেও কম কিন্তু পুলিশের হাতে মারা যাওয়ার সময় কালো মানুষের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি, গড়ে দিনে এক আধজন প্রায় নিয়মিতভাবেই মারা যায়। ব্যাপারটা প্রায় সবাই মেনেই নিয়েছে। মার্চ মাসের ১৩ তারিখ ব্রিওনা টেইলর নামে একটা কালো মেয়েকে কেন্টাকিতে গুলি করে মেরে ফেলা হয়েছে। একজন মাদক ব্যবসায়ীকে ধরার জন্য ভুল বাসায় দরজা ভেঙে ঢুকে পুলিশ ২৭ বছরের এই হাসিখুশি ইমারজেন্সি স্বাস্থ্যকর্মীকে গুলি করে মেরেছে, একটা বা দুটো নয় তার শরীর আটটা বুলেট দিয়ে ঝাঁজরা করে ফেলা হয়েছিল।

যে মাদক ব্যবসায়ীকে ধরার জন্য ভুল করে তার বাসায় এই অপারেশন চালানো হয়েছিল সেই মানুষটি কিন্তু আগেই গ্রেফতার হয়েছিল। এতো বড় ঘটনার পরেও কিন্তু পুলিশের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। আমেরিকায় শুধু যে পুলিশেরা মোটামুটি ইনডেমনিটি নিয়ে যখন খুশি একজন কালো মানুষকে মেরে ফেলতে পারে তা নয়, আমেরিকার সাধারণ সাদা মানুষেরাও প্রায় নিয়মিতভাবে কালো মানুষদের গুলি করে মেরে ফেলতে পারে। ফেব্রুয়ারি মাসে জর্জিয়াতে একজন ৬৪ বছরের বাবা এবং তার ৩৪ বছরের ছেলে মিলে আহমদ আরবেরি নামে ২৬ বছরের একজন কালো যুবককে শুধুমাত্র অপরাধী সন্দেহ করে প্রকাশ্যে গুলি করে মেরে ফেলেছে। পুরোপুরি নিরপরাধী নিরীহ এই কালো যুবকটি তখন জগিং করছিল। বাবা এবং ছেলের গায়ের রঙ সাদা তাই প্রথমে কিছুই হয়নি, যখন একটা ভিডিওতে এই নৃশংস হত্যাকান্ডটি প্রকাশ পেয়েছে এবং একটা হৈ চৈ শুরু হয়েছে তখন শেষ পর্যন্ত আড়াই মাস পরে বাবা এবং ছেলেকে খুনের দায়ে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

আমেরিকায় এরকম উদাহরণের কোন শেষ নেই। তাই সন্দেহভাজন একজন অপরাধীকে গ্রেপ্তার করার সময় পুলিশের সাথে ধস্তাধস্তিতে তার মারা যাওয়ার ব্যাপারটি আমেরিকাতে খুবই স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। কেউ সেটা নিয়ে অবাক হয় না। ঠিক একইভাবে জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুও খুবই স্বাভাবিক একটা ঘটনা হিসেবে সবার চোখের আড়ালে থেকে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ঘটনাক্রমে সেটি হয়নি তার একমাত্র কারণ পথচারীদের একজন পুরো ঘটনাটি ভিডিও করে ইন্টারনেটে দিয়ে দিয়েছে। পৃথিবীর মানুষ এক ধরনের আতংক এবং অবিশ্বাস নিয়ে দেখেছে যন্ত্রণাকাতর একজন মানুষ কাতর গলায় বলছে, “আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না, আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না”, কিন্তু তার পরেও একজন নির্বিকার সাদা পুলিশ হ্যান্ডকাফ দিয়ে দুই হাত পিছনে বাধা থাকা অবস্থায় হাটু দিয়ে জর্জ ফ্লয়েডের ঘাড়ে চাপা দিয়ে ধীরে ধীরে তাকে মেরে ফেলছে। ভিডিওটি অনেকেই দেখেছে, আমি দেখিনি, আমার দেখার সাহস হয়নি। হলিউডের সিনেমাতে গুলি খেয়ে একজনকে মরে যেতে দেখা এক ব্যাপার কিন্তু সত্যি সত্যি একজন মানুষের ঘাড়ে হাঁটু দিয়ে চেপে ধরে তাকে নিঃশ্বাস নিতে না দিয়ে ধীরে ধীরে হত্যা করার ঘটনাটি দেখা সম্পূর্ণ অন্য ব্যাপার। যারা দেখেছে তারা দৃশ্যটি কোনোভাবে ভুলে যেতে পারছে না। তাদের কাছে শুনেছি পুরো হত্যাকাণ্ডের সময় চারজন পুলিশের কর্মকান্ড ছিল আশ্চর্যরকম হৃদয়হীন, মানুষ একটা পশুকেও এত অবহেলায় হত্যা করে না।

আমেরিকার মানুষ ঘটনাটি দেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভুলে যেতে পারতো—অতীতে অনেকবার তারা ভুলে গেছে কিংবা ভুলে যেতে বাধ্য হয়েছে। এবারে কিন্তু সেটি ঘটেনি। কীভাবে কীভাবে জানি এই ঘটনাটি মনুষত্বের মূল জায়গাটিকে স্পর্শ করেছে। করোনার অবরুদ্ধ পরিবেশেও মানুষ প্রতিবাদ করতে শুরু করেছে। ফেসবুকের অর্থহীন প্রতিবাদ নয়, রাজপথের দৃপ্ত প্রতিবাদ। শুধু কালো মানুষ নয়, তাদের পাশাপাশি সেই দেশের সাদা মানুষ, এশীয় মানুষ, লাতিনো মানুষ। পুরুষের পাশাপাশি মহিলা, যুবার পাশাপাশি বয়স্ক, বৃদ্ধ। পৃথিবীর যে কোনো আন্দোলন থামানোর জন্য সেটাকে ভিন্নপথে ঘুরিয়ে দিতে হয়, এই আন্দোলনটিকেও ভিন্নপথে ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য বর্ণ বিদ্বেষীরা ভিতরে ঢুকে উচ্ছৃংখল হয়ে একটু ভাঙচুর আর লুটপাট করার চেষ্টা করলো, তাদের নেতা ডোনাল্ড ট্রাম্প হুংকার দিয়ে বললেন, “যখনই লুটপাট তখনই গুলি!” সুবিচারের জন্য আন্দোলন যখন তীব্র থেকে তীব্রতর হতে শুরু করল, প্রেসিডেন্ট রাস্তায় মিলিটারি নামিয়ে তাদের দমন করার হুমকি দিলেন। ওয়াশিংটনে হোয়াইট হাউজের খুব কাছাকাছি যখন সহস্র মানুষের স্লোগানে মুখরিত হতে লাগলো তখ্ন আতংকিত প্রেসিডেন্ট হোয়াইট হাউজের নিচে বাংকারে গিয়ে লুকিয়ে রইলেন।

শেষ পর্যন্ত হত্যাকারী পুলিশ অফিসারকে গ্রেফতার করা হলো। আন্দোলন যখন আরও তীব্র হয়ে সারা আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়তে লাগল তখন সেই ঘটনার সময় উপস্থিত বাকি তিনজন পুলিশ অফিসারকেও গ্রেপ্তার করা হলো।

কিন্তু এই আন্দোলনটি এখন শুধু মাত্র কয়েকজন সাদা পুলিশ অফিসারের বিচারের দাবিতে নয়। আন্দোলনটি এখন শত শত বছরের শোষণ নির্যাতনের বিরুদ্ধে। বর্ণবাদের বিরুদ্ধে। আন্দোলনটি এখন আর শুধু আমেরিকার মাঝে সীমাবদ্ধ নেই ধীরে ধীরে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ছে। করোনা ভাইরাসের তীব্র নিষেধাজ্ঞার মাঝে লক্ষ লক্ষ মানুষ ফেসবুকের মেরুদণ্ডহীন প্রতিবাদ না করে সত্যিকারের প্রতিবাদের জন্য রাস্তায় নেমে এসেছে।

পৃথিবীতে বর্ণবাদের কারণে যত অবিচার হয়েছে তার পুরো মূলোৎপাটন করার প্রতিজ্ঞা নিয়ে পৃথিবীর মানুষ ভাইরাসের আতঙ্কের মাঝে পথে নেমেছে। কী হবে এখন পৃথিবীতে? কিন্তু পৃথিবী কীভাবে এরকম একটা জায়গায় পৌঁছেছে সেটা কী আমরা জানি?



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:




রিসোর্সফুল পল্টন সিটি (১১ তলা) ৫১-৫১/এ, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০।
মোবাইল: ০১৭১১-৯৫০৫৬২, ০১৯১২-১৬৩৮২২
ইমেইল : [email protected]; [email protected]
সম্পাদক : লিটন চৌধুরী

রংধনু মিডিয়া লিমিটেড এর একটি প্রতিষ্ঠান।

Developed with by
Top