অপমৃত্যু ও হত্যার অভিযোগে মামলা দুটি করা হয়
রাজশাহীতে একই পরিবারের চারজনের লাশ উদ্ধারের ঘটনায় দুই মামলা
প্রকাশিত:
১৬ আগস্ট ২০২৫ ১১:৫৩
আপডেট:
১৬ আগস্ট ২০২৫ ১৫:২৬

শুক্রবার (১৫ আগস্ট) সন্ধ্যায় নগরীর মতিহার থানায় মামলা দুটি দায়ের করা হয়। এর আগে ওই এলাকা থেকে স্বামী-স্ত্রীসহ দুই ছেলে-মেয়ের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।
মতিহার থানায় মামলাগুলোর মধ্যে একটি হত্যা মামলা ও অপরটি অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে। হত্যা মামলার বাদি নিহত মনিরা বেগমের মা শিউলী বেগম। আর অপমৃত্যু মামলার বাদি নিহত মিনারুল ইসলামের বাবা রুস্তম আলী। এই মামলাগুলোতে কাউকে আসামি করা না হলেও বিষয়টি তদন্ত করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
মৃতরা হলেন- মিনারুল ইসলাম (৩০), তার স্ত্রী সাধিনা বেগম (২৮), ছেলে মাহিম (১৩), মেয়ে মিথিলা (১৮ মাস)।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, মিনারুল ইসলাম কৃষি কাজ করেন। তার অনেক ঋণ রয়েছে। তারা মাটির ঘরে বসবাস করতেন। মিনারুল ঝুলছিলেন সিলিং ফ্যানের সঙ্গে। পাশে বিছানায় পড়ে আছে বড় ছেলে। পাশের ঘরে মা ও মেয়ে পড়ে আছে। তাদের সবাইকে মৃত অবস্থায় উদ্ধার করেছে পুলিশ।
এদিকে, ঘর থেকে একটি চিরকুট উদ্ধার করেছে পুলিশ। যেখানে মিনারুলের বরাত দিয়ে লেখা রয়েছে ঋণের চাপ আর খাবারের অভাবে স্ত্রী ও দুই সন্তানকে হত্যার পর তিনি আত্মহত্যা করেছেন। চিরকুটের সত্যতা এবং প্রকৃত ঘটনা জানতে তদন্ত করছে পুলিশ।
এ বিষয়ে মতিহার থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুল মালেক বলেন, ‘‘এই ঘটনায় দুইটি পৃথক মামলা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে ঋণের কারণে এমন ঘটনা ঘটেছে বলে মনে হচ্ছে। বিষয়টি পুলিশ তদন্ত করছে। মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের মর্গে রাখা হয়েছে। আজ শনিবার (১৬ আগস্ট) সকালে ময়নাতদন্ত হবে। এরপর আইনগত ব্যবস্থাগ্রহণ শেষে মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হবে।”
‘আমরা মরে গেলাম ঋণের দায়ে আর খাওয়ার অভাবে’‘আমরা মরে গেলাম ঋণের দায়ে আর খাওয়ার অভাবে’
পুলিশের ধারণা, প্রথমে স্ত্রী ও মেয়েকে ও পরে ছেলেকে শ্বাসরোধে হত্যা করে মিনারুল আত্মহত্যা করেন। ঘটনাস্থল থেকে একটি চিরকুট উদ্ধার করেছে পুলিশ, যেখানে অভাব ও ঋণের চাপকে এ হত্যাকাণ্ড ও আত্মহত্যার কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
আত্মীয়-স্বজন ও পুলিশ সূত্রে জানা যায়, মিনারুল আগে একসময় জুয়া খেলতেন। পরে ছেড়ে দেন। এ জন্য তিনি অনেক ঋণগ্রস্ত ছিলেন। দেড় বছর আগে বাবা রুস্তম আলী ধানিজমি বিক্রি করে ঋণের একটা অংশ পরিশোধ করেন। এরপরও তার ২ লাখ টাকার মতো ঋণ ছিল। এই ঋণের জন্য প্রতি সপ্তাহে তাকে ২,৭০০ টাকার বেশি কিস্তি পরিশোধ করতে হচ্ছিল। কিন্তু কিস্তি চালাতে বেশ হিমশিম খাচ্ছিলেন মিনারুল। বাবাকে মিনারুল আর কিছু জমি বিক্রি করে পুরো টাকা পরিশোধ করতে বলেছিলেন। কিন্তু বাবা জমি বিক্রি করতে রাজি হননি। এ নিয়ে মা-বাবার সঙ্গে মিনারুল কথা বলা বন্ধ করে দেন। এমনকি ছেলেমেয়েদেরও মিশতে দিতেন না।
মিনারুলের চাচি জানেহার বেগম জানান, আগে থেকেই জুয়ায় আসক্ত ছিলেন মিনারুল। প্রায় দেড় বছর আগে তার বাবা রুস্তম আলী দেড় লাখ টাকায় জমি বিক্রি করে আংশিক ঋণ শোধ করেন। তবে পুরো ঋণ শোধ না হওয়ায় বাবার প্রতি ক্ষোভ ছিল মিনারুলের। এ কারণে বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলতেন না, যদিও সন্তানদের দাদা-দাদির সঙ্গে ভালো সম্পর্ক ছিল।
পবা উপজেলার পারিলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. সাহেদ আলী বলেন, ‘‘মিনারুল ঋণগ্রস্ত ছিলেন। তাকে সপ্তাহে ২,৭০০ টাকার বেশি কিস্তি দিতে হতো। তিন দিন আগে আমার কাছ থেকে ২ হাজার টাকা ধার নিয়ে চালসহ অন্যান্য জিনিসপত্র কিনেছেন। বর্ষাকালে কাজ তেমন ছিল না। এ জন্য চাপে ছিল।”
তিনি বলেন, ‘‘সকালে (শুক্রবার) ঘটনা জানার পর দ্রুত সেখানে যায়। পরে পুলিশকে জানাই। সে আগে জুয়া খেলত, পরে আর খেলেনি। ঋণের একটি টাকা মিনারুলের বাবা পরিশোধ করেছেন। এ জন্য জমিও বিক্রি করেছিলেন। আরেকটি ঋণ টানছিল মিনারুল।’’
মিনারুলের বাবা রুস্তম আলী বলেন, ‘‘ছেলের কিছু ঋণ ছিল। সেটা খুব বেশি না। নতুন করে কোনো ঋণ আছে কি না, তা জানি না। আগে যেটা ঋণ করেছিল, সেটা ধানিজমি বিক্রি করে দিয়েছি। পরে আর কবে কবে ঋণ করেছিল, সেটা আমার জানা নেই।’’
মিনারুলের মা আঞ্জুয়ারা বলেন, ‘‘কোনো গন্ডগোল ছিল না। ভরণপোষণ আমিই দিই। ধারদেনা ছিল, মাটি (জমি) বিক্রি করে আমি দিয়েছি। আবার নতুন করে ধার করেছে। আজ (শুক্রবার) সকালে মিনারুলের বাবা মাছ কিনে আনলে ডাকাডাকি করি। পরে দেখি ছেলে ঝুলে আছে। নাতিকে আমিই মানুষ করেছি। আমার ওখানেই থাকত। কীভাবে কী হয়ে গেল।’’
রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের (আরএমপি) কমিশনার আবু সুফিয়ান বলেন, ‘‘ধারণা করা হচ্ছে- স্ত্রী, ছেলে ও মেয়েকে হত্যার পর মিনারুল আত্মহত্যা করেছে। মরদেহগুলো শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছে। একটি চিরকুট উদ্ধার হয়েছে যেখানে ঋণগ্রস্ততার কথা লেখা রয়েছে। বিষয়টি তদন্ত করা হচ্ছে।”
সম্পর্কিত বিষয়:
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: