শুক্রবার, ২৫শে এপ্রিল ২০২৫, ১২ই বৈশাখ ১৪৩২

Shomoy News

Sopno


মসজিদে বিস্ফোরণ

পাইপ পরিত্যক্ত ২২ বছর, গ্যাস বন্ধ করেনি তিতাস


প্রকাশিত:
১৩ সেপ্টেম্বর ২০২০ ১৭:১০

আপডেট:
১৩ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২১:২০

ফাইল ছবি

নারায়ণগঞ্জের পশ্চিম তল্লার বায়তুস সালাত জামে মসজিদে বিস্ফোরণে প্রাণহানির পর পাশের মাটি খুঁড়ে যে গ্যাসপাইপে ছয়টি ছিদ্র পাওয়া গেছে, সেটি ২২ বছর ধরে কোনো কাজে না লাগলেও তাতে গ্যাসের প্রবাহ বন্ধ করা হয়নি।

ওই পাইপের ছিদ্র থেকে গ্যাস বেরিয়ে তা মসজিদে জমা হয়ে এই বিস্ফোরণ ঘটেছে বলে ধারণা করছেন ঘটনার তদন্ত সংশ্লিষ্ট ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা।

মূল যে লাইন থেকে ওই পাইপে গ্যাস আসে, সেখানে ১৯৯৮ সালে আরেকটি মোটা পাইপ বসিয়ে আশপাশের বাড়িগুলোতে গ্যাস সংযোগ দেওয়া হয়েছে। এরপর অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়া ওই লাইনে কেন গ্যাস বন্ধ করা হয়নি, তার সদুত্তর দিতে পারেনি তিতাস গ্যাসের স্থানীয় কর্মকর্তারা।

তারা বলছেন, যারা ওই পাইপ বসিয়ে গ্যাস সংযোগ নিয়েছিল তাদেরই ‘দায়িত্ব ছিল’ বিষয়টি তিতাস কর্তৃপক্ষের নজরে আনা। তারা তা করেননি বলেই মূল লাইন থেকে এই পাইপের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়নি।

তবে স্থানীয় অফিসের এই ব্যাখ্যার সঙ্গে একমত নন তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। তার মতে, পরিত্যক্ত লাইনের বিষয়ে স্থানীয় অফিসেরই ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ছিল।

এদিকে এই ঘটনার ১০-১২ দিন আগেই মসজিদে গ্যাসের গন্ধ পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন মসজিদ কমিটির নেতারা। তারপরেও কেন মসজিদের জানালা খোলা রাখা হয়নি, সে বিষয়েও তাদের কাছে কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি।

তবে নামাজ পড়ে বিস্ফোরণের আগ মুহূর্তে মসজিদ থেকে বেরিয়ে আসা পাশের একজন দোকানদার বলেছেন, যেদিন বিস্ফোরণ ঘটে, তার আগের দুই দিন প্রচণ্ড গরম ছিল। সে কারণে মসজিদের এসি ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন তারা। আর এসি চালালে জানালগুলো বন্ধ রাখতেই হয়।

গত ৪ সেপ্টেম্বর রাত সাড়ে ৮টার দিকে এশার নামাজ চলাকালে ফতুল্লার পশ্চিম তল্লা এলাকার বায়তুস সালাত জামে মসজিদে বিকট শব্দে বিস্ফোরণে অর্ধশতাধিক মানুষ অগ্নিদগ্ধ হন।

তাদের মধ্যে এক শিশু এবং ওই মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন, মসজিদ কমিটির সাধারণ সম্পাদক, কোষাধ্যক্ষসহ অন্তত ৩১ জনের মৃত্যু হয়েছে। আরও কয়েকজন আশঙ্কাজনক অবস্থায় শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন আছেন।

মসজিদের ছয়টি এসির বিস্ফোরণে ওই ঘটনা ঘটেছে বলে প্রাথমিকভাবে মনে করা হলেও পরে জানা যায়, মসজিদের পাশ দিয়ে চলে যাওয়া তিতাসের গ্যাসলাইনে ছিদ্র থাকায় মসজিদের ভেতরে গ্যাস জমা হয়। বৈদ্যুতিক স্পার্ক থেকে ওই গ্যাসে আগুন ধরে বিস্ফোরণের এ ঘটনা ঘটে বলে ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তাদের ধারণা।

ফায়ার সার্ভিসের পাশাপাশি তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ, জেলা প্রশাসন এবং নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন এ ঘটনার তদন্ত করছে।

বায়তুস সালাত মসজিদের পূর্ব পাশে উত্তর-দক্ষিণমুখী একটি সড়ক পশ্চিম তল্লা থেকে রেললাইন পার হয়ে খানপুর পর্যন্ত চলে গেছে। ওই সড়ক থেকে মসজিদের উত্তরপাশ ঘেঁষে ছয় ফুট প্রশস্ত আরেকটি রাস্তা পশ্চিম দিকে সবুজবাগের দিকে গেছে। দুটি রাস্তাই কংক্রিট ঢালাই করা।

২২ বছর আগে পাশ দিয়ে ৩ ইঞ্চি ব্যাসের মোট পাইপ বসিয়ে গ্যাস লাইন নেওয়ার পর সরু এই পাইপটি কোনো কাজে লাগছিল না, তারপরেও সেটিতে গ্যাসের প্রবাহ বন্ধ করা হয়নি।তল্লা পশ্চিমপাড়া থেকে খানপুরমুখী সড়কের মাঝামাঝি তিতাসের একটি সরবরাহ লাইন রয়েছে। সেই লাইন থেকে ৩ ইঞ্চি ব্যাসের আরেকটি লাইন মসজিদের উত্তরপাশ ঘেঁষে চলে গেছে সবুজবাগের দিকে। এই সংযোগ লাইনটি ১৯৯৮ সালে স্থাপন করা হয়।

স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ৩ ইঞ্চি ব্যাসের লাইনটি যাওয়ার আগে আশির দশকের মাঝামাঝি সবুজবাগ এলাকার তিনজন বাড়ি মালিক পৌনে এক ইঞ্চি ব্যাসের একটি পাইপের মাধ্যমে গ্যাস সংযোগ নেন। নতুন সংযোগ যাওয়ার পর ওই তিনটি বাড়ির সামনে থেকে পুরোনো সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। তবে সড়কের মূল লাইন থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়নি।

দুর্ঘটনার পর ৩ ইঞ্চি ব্যাসের পাইপে কোনো ছিদ্র পাওয়া যায়নি। তবে উত্তর পাশে ওই লাইনের পাশে পৌনে এক ইঞ্চির যে পরিত্যক্ত লাইন, তাতে ছয়টি ছিদ্র পাওয়া গেছে। এই লাইনটি মসজিদের ৪ নম্বর পিলার ঘেঁষা। পরিত্যক্ত ওই লাইনের ছিদ্র থেকেই মসজিদে গ্যাস জমে বিস্ফোরণ ঘটেছে বলে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা প্রাথমিকভাবে ধারণা করছেন।

বায়তুস সালাত জামে মসজিদ কমিটির সভাপতি আবদুল গফুর বলেন, সবুজবাগের দিকে ৩ ইঞ্চি ব্যাসের নতুন সংযোগ যাওয়ার পর ওই তিনটি বাড়িতেও নতুন সংযোগ দেওয়া হয়। যার যার বাড়ির সামনে আগের লাইনের ‘রাইজার’ কেটে মুখ বন্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু লাইনের গোড়ায় বন্ধ করেনি।

“গ্যাসসহ পাইপটা রয়ে গেল। পুরো লাইন থেকে থেকেই গ্যাস বের হয়ে মসজিদে ঢুকেছে। তারা যদি সেই সময় লাইনটা ফেলে না রেখে কেটে নিয়ে যেত তাহলে এমন পরিস্থিতি হত না। অথবা তারা চাইলে মেইন লাইন থেকে এই পরিত্যক্ত লাইনটি বিচ্ছিন্ন করে রাখতে পারত। তারা সেটাও করেনি।”

তিনি বলেন, মসজিদের সামনের সড়কে সব সময় পানি জমে থাকে। তারা প্রায় দেড় থেকে দুই মাস ধরে সড়কের পানিতে বুদবুদ দেখতে পাচ্ছিলেন। ঘটনার ১০-১২দিন আগেই মসজিদের ভেতরে গ্যাসের গন্ধ পাওয়া যায়। তবে গন্ধ খুব তীব্র ছিল না সে সময়।

আবদুল গফুর বলেন, “মসজিদ কমিটির সাধারণ সম্পাদক তিতাসের অফিসে গিয়ে বিষয়টি জানিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু লাইন মেরামতের জন্য তিতাস থেকে নাকি ৫০ হাজার টাকা চেয়েছে, সেক্রেটারি আমাকে সেটাই বলেছেন।”

তিতাসের ছিদ্র হওয়া পাইপটি মসজিদের পিলার ঘেঁষা থাকলেও মসজিদের মেঝের নিচে ছিল না। তারপরও গ্যাস মসজিদের ভেতরে কীভাবে গেল জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের পরিচালক (অপারেশন্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিল্লুর রহমান শনিবার বলেন, মসজিদের ভেতরে ছয় থেকে সাতটি জায়গা দিয়ে গ্যাস উঠতে দেখেছেন তারা। গ্যাস কোনো না কোনোভাবে মাটির নিচ দিয়ে মসজিদে গেছে বলে তাদের ধারণা।

“আমরা যে আলামত পাচ্ছি, যেহেতু পাইপটি একেবারে মসজিদের বর্ডার দিয়ে গেছে, কোনো বাধা পেয়ে গ্যাস মসজিদের ভেতর দিয়ে উঠেছে। গ্যাস অন্য দিক থেকেও উঠতে পারে। তা তদন্ত শেষ করে বলা যাবে।”

তিতাসের কমিটির প্রধান আব্দুল ওয়াহাব তালুকদার গত বুধবার সাংবাদিকদের বলেছিলেন, মসজিদের পূর্ব ও উত্তর পাশে পুরো সড়ক খুঁড়ে সব লাইন বের কর পরীক্ষা করেছেন তারা। পূর্ব পাশে কোনো ছিদ্র পাওয়া না গেলেও উত্তর পাশের পাইপে ছয়টি ছিদ্র পাওয়া গেছে। সেগুলো মেরামত করার পর এলাকায় গ্যাস সরবরাহ শুরু করা হয়েছে আবার।

ওই দিন তিনি বলেছিলেন, মসজিদের উত্তর পাশে ৪ নম্বর কলামের ভিত্তি তিতাসের পাইপলাইন ছাড়িয়ে রাস্তার দিকে ছয় ইঞ্চি চলে গেছে। বেইজমেন্টের ফাউন্ডেশনের কাজ করার সময় তিতাসের পাইপের র‌্যাপিং নষ্ট করা হয়েছে। এ কারণে মাটির সংস্পর্শে এসে পাইপ ছিদ্র হয়েছে। সেই ছিদ্র দিয়ে গ্যাস বের হয়েছে।

তবে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির নারায়ণগঞ্জ অঞ্চলের উপ-মহাব্যবস্থাপক মো. মফিজুল ইসলাম শনিবার বলেন, পৌনে এক ইঞ্চি ব্যাসের যে গ্যাস লাইনে ছিদ্র পাওয়া গেছে, সেটি আশির দশকে তিনজন গ্রাহক টেনে নিয়েছিলেন। ১৯৯৮ সালে একই পথ ধরে একটি তিন ইঞ্চি ব্যাসের লাইন যাওয়ার পর তারা পুরাতন লাইন থেকে নতুন লাইনে ‘শিফট’ করেছেন। নতুন লাইনে কোনো ছিদ্র ছিল না।

“গ্রাহক পর্যায়ের ওই লাইনটি সেই সময় থেকে পরিত্যক্ত ছিল। গ্রাহকরা বিষয়টি তিতাসকে জানাননি। তিতাসের লাইন নয়, ওই লাইন গ্রাহকের ছিল। যে কাস্টমাররা লাইনটা নিয়েছিল, তারা যদি এটা পরিত্যক্ত করে থাকে, তাহলে তাদেরই দায়িত্ব সেটা তিতাসকে জানানো।”

গ্যাসের মূল লাইন থেকে পরিত্যক্ত পাইপ বিচ্ছিন্ন করার দায়িত্ব কার জানতে চাইলে তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলী আল মামুন বলেন “পরিত্যক্ত পাইপের বিষয়টি তিতাসের স্থানীয় অফিসের জানা থাকার কথা। আঞ্চলিক অফিসেরই ওই পাইপটি কেটে দেওয়ার কথা। এখন কীভাবে এই পাইপটি রয়ে গেছে সেটা তদন্তের মাধ্যমে বলা যাবে।”

মসজিদ কমিটির পক্ষ থেকে গ্যাসের বিষয়ে অভিযোগ জানানো হয়েছিল বলে যে দাবি করা হয়েছে সে বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “এ বিষয়ে তিতাসকে কেউ কিছু জানায়নি। এমনকি স্থানীয় থানায়ও বিষয়টি জানানো হয়নি।

“আমাদের একটা রেজিস্ট্রার খাতা মেইনটেইন করা হয়। সেখানে গত ৬-৭ মাসে এ ধরনের কোনো অভিযোগ আসেনি। তিতাসের কার কাছে অভিযোগ দেওয়া হয়েছে, তারা এখন বলতে পারছে না। হয়ত স্থানীয় কোনো লোক মারফত তারা খবর পাঠিয়ে থাকতে পারে।”


সম্পর্কিত বিষয়:

নারায়ণগঞ্জ

আপনার মূল্যবান মতামত দিন:




রিসোর্সফুল পল্টন সিটি (১১ তলা) ৫১-৫১/এ, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০।
মোবাইল: ০১৭১১-৯৫০৫৬২, ০১৯১২-১৬৩৮২২
ইমেইল : [email protected]; [email protected]
সম্পাদক : লিটন চৌধুরী

রংধনু মিডিয়া লিমিটেড এর একটি প্রতিষ্ঠান।

Developed with by
Top