বৃহঃস্পতিবার, ৭ই আগস্ট ২০২৫, ২৩শে শ্রাবণ ১৪৩২

Shomoy News

Sopno


যাঁদের জন্য প্রবাসফেরা, তাঁদেরই কবরে শোয়ালেন বাহার


প্রকাশিত:
৭ আগস্ট ২০২৫ ১৩:৩৫

আপডেট:
৭ আগস্ট ২০২৫ ১৫:৫৭

ছবি সংগৃহীত

ওমানপ্রবাসী আবদুল বাহার অনেক বছর পর ফিরছিলেন দেশে। মা, স্ত্রী, মেয়ে, নানি, ভাইয়ের স্ত্রী ও ভাইয়ের মেয়ে—সবাই যাচ্ছিলেন ঢাকায়, তাকে আনতে। বিমানবন্দর থেকে ফিরতি পথে ছিল আনন্দ, ছিল হাসি, ছিল খুনসুটি। কারও কল্পনাতেও ছিল না, সেই আনন্দময় পথই শেষ হবে মৃত্যুর মিছিলে।

গতকাল বুধবার সকালে লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার উত্তর জয়পুর ইউনিয়নের চৌপল্লী গ্রামে পৌঁছায় বাহারের পরিবারের সাতজনের মরদেহ। তারা সবাই নিহত হয়েছেন একটি ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনায়।

নিহতরা হলেন বাহারের নানি ফয়জুন নেসা (৮০), মা খুরশিদা বেগম (৫৫), স্ত্রী কবিতা বেগম (৩০), দুই বছরের মেয়ে মীম আক্তার, ভাবি লাবনী বেগম (৩০), ভাতিজি রেশমি আক্তার (১০) এবং লাবনীর মেয়ে লামিয়া আক্তার (৯)।

দুর্ঘটনা সকাল হওয়ার আগেই

গতকাল ভোর পাঁচটার দিকে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার আলাইয়াপুর এলাকায়, লক্ষ্মীপুর থেকে মাত্র ১০ কিলোমিটার দূরে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে একটি খালে পড়ে যায় তাদের বহনকারী মাইক্রোবাসটি। বাহার ছাড়া আর কেউ বাঁচেননি।

দুর্ঘটনার পর ভোরের আলো ফোটার আগেই ভেঙে পড়ে একটি গোটা পরিবার। বাহারকে জীবিত উদ্ধার করা হলেও বাকিদের আর ফেরা হয়নি। সকাল ১১টার দিকে গ্রামের বাড়িতে এসে পৌঁছায় একসঙ্গে সাতটি লাশ।

যে উঠানে হাসি ছিল, সেখানে কেবল কান্না

চৌপল্লী গ্রামের বাহারদের বাড়ির উঠানে সারি করে রাখা হয় মরদেহগুলো। গোসলের জন্য টানানো হয় শামিয়ানা, পাতা হয় চেয়ার। মানুষ জড়ো হয় শত শত। কান্না ও স্তব্ধতা ছড়িয়ে পড়ে পুরো গ্রামে। এত মৃত্যু একসঙ্গে দেখেনি কেউ।

আমি ফিরছিলাম সবাইকে বুকে জড়িয়ে ধরতে

উঠানে দাঁড়িয়ে একজন স্বজনকে বলছিলেন আবদুল বাহার, ‘আমি ফিরছিলাম সবাইকে বুকে জড়িয়ে ধরতে। অথচ ফিরে পেয়েছি সাতটা লাশ। আমি এখন কাকে নিয়ে বাঁচব?”

তার কণ্ঠে চাপা কান্না। ‘গাড়িতে বসে আমরা কত হাসিঠাট্টা করছিলাম। আম্মা বলছিলেন, ‘তোর জন্য কত অপেক্ষা করছি, বাপ।’ কথাটা শেষ হওয়ার আগেই বিকট শব্দে ধাক্কা লাগে। এরপর আর কিছু মনে নেই। দেখি, গাড়ি খালের পানিতে ভাসছে।’

বাহার জানান, চালক একাধিকবার ঘুমের কারণে গাড়ি নিয়ন্ত্রণ হারাতে বসেছিলেন। কুমিল্লার দিকেও দুর্ঘটনা ঘটতে যাচ্ছিল। তখন তাঁকে বিশ্রাম নিতে বলা হয়েছিল। কিন্তু তিনি কথা না শুনেই গাড়ি চালাতে থাকেন।

‘খালে পড়ার পর আমরা দরজা খুলতে বলি। কিন্তু তিনি জানালা দিয়ে বের হয়ে যান, আমাদের ফেলে রেখে,” বলেন বাহার।

একসঙ্গে সাতজনের বিদায়

বিকেল সাড়ে পাঁচটায় একসঙ্গে ছয়জনের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। বাহারের নানির মরদেহ নেওয়া হয় পাশের হাজিরপাড়া ইউনিয়নে। বাকিদের দাফন হয় জয়পুর ইউনিয়নের চৌপল্লী গ্রামের পারিবারিক কবরস্থানে। দুটি কবর পাশাপাশি, সামান্য দূরে আরও চারটি। সন্ধ্যায় একে একে মা, স্ত্রী, মেয়ে ও স্বজনদের নিজ হাতে কবর দেন বাহার।

একটি বাড়ি, সাতটি শোকঘর

চৌপল্লী গ্রামের কাছারিবাড়িতে পাশাপাশি সাতটি ঘর। একটি ঘরে থাকেন বাহারের বাবা, বৃদ্ধ আবদুর রহিম। ছেলে ফিরবে বলে কত আয়োজন করছিলেন তিনি। এখন বিছানায় নিঃশব্দে কাঁদছেন। স্ত্রী, শাশুড়ি, দুই পুত্রবধূ ও তিন নাতনিকে একসঙ্গে হারিয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন তিনি।

গ্রামের মানুষও হতবিহ্বল। স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বলেন, ‘একটি গোটা পরিবার শেষ হয়ে গেল। এমন দৃশ্য আগে কখনো দেখিনি। পুরো গ্রাম আজ শোকস্তব্ধ।’


সম্পর্কিত বিষয়:


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:




রিসোর্সফুল পল্টন সিটি (১১ তলা) ৫১-৫১/এ, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০।
মোবাইল: ০১৭১১-৯৫০৫৬২, ০১৯১২-১৬৩৮২২
ইমেইল : [email protected]; [email protected]
সম্পাদক : লিটন চৌধুরী

রংধনু মিডিয়া লিমিটেড এর একটি প্রতিষ্ঠান।

Developed with by
Top