ঘুষ না পেয়ে মামলা দিয়ে গ্রাহক হয়রানি
বেপরোয়া বিপিডিবি’র প্রকৌশলী সাইফুল ইসলাম
প্রকাশিত:
১১ জানুয়ারী ২০২১ ১৮:৩২
আপডেট:
১২ জানুয়ারী ২০২১ ২৩:৪২

ঘুষের টাকা না পেয়ে মামলা (সিআর-২৯২/২০) দিয়ে গ্রাহক হয়রানি করছেন বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) চাঁদপুরের বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগের উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো. সাইফুল ইসলাম। শুধু তা-ই নয়, মামলা পরবর্তী আদালত কর্তৃক গ্রাহক বরাবর প্রেরিত সমনের কপি ১০ দিন নিজের হেফাজতে রেখে হাজিরার দিন দুপুর ১২টায় ভুক্তভোগীর কাছে ওই কপি পৌঁছান তিনি।
কোড়ালিয়া রোড, চাঁদপুরের বাসিন্দা ভুক্তভোগী মো. রহমত উল্লাহ জানান, ২০২০ সালের ১০ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টায় বিদ্যৎ অফিসের একজন বাড়িতে এসে আমার হাতে একটি কাগজ ধরিয়ে দেন। কাগজটি খুলে দেখি আদালত কর্তৃক আমার প্রতি সমন জারি করা হয়েছে এবং ১০ ডিসেম্বরের মধ্যেই আমাকে কুমিল্লা আদালতে গিয়ে জবাব দিতে হবে। সমনের কপিতে ম্যাজিস্ট্রেট ৩০ নভেম্বর স্বাক্ষর করে চাঁদপুর বিদ্যৎ অফিসে পাঠানোর পর সাইফুল স্যার ১০ দিন পর (হাজিরার তারিখে) আমার হাতে কপি পৌঁছান। কাঁদোস্বরে তিনি বলেন, ঘুষের মাত্র ৯ হাজার টাকা না পেয়ে স্যার আমার যে ক্ষতি এবং হয়রানি করলেন, তা মানুষ মানুষকে করে না।”
রহমত উল্লাহ বলেন, “যান্ত্রিক ত্রুটির কারনে ২০১৭ সালের অক্টোবরে আমার বৈদ্যুতিক মিটারটি বন্ধ হয়ে গেলে সংশ্লিষ্ট এলাকার লাইনম্যান বাবরকে (অবসরপ্রাপ্ত) বিষয়টি জানাই। লাইনম্যান বাবর মিটার বন্ধের বিষয়টি মিটাররিডার হোসেনকে জানাতে বলেন। হোসেনকে জানানোর পর তিনি বিষয়টি অফিসকে অবহিত করেন এবং নতুন মিটার সংযোগ না হওয়া পর্যন্ত প্রতিমাসে গড়ে ৩০০ ইউনিটের বিল পরিশোধ করতে হবে মর্মে অফিস থেকে আমাকে জানানো হয়। অফিসের নির্দেশমতো আমি প্রতিমাসে ৩০০ ইউনিট বিদ্যুতের বিল পরিশোধ করে আসছি। এরমাঝেই লাইনম্যান বাবরকে কয়েকদফায় নতুন মিটার সংযোগের অনুরোধও করি। তবে বিভিন্ন অযুহাতে আমাকে আর নতুন সংযোগ দেয়া হয় নাই। নিরুপায় হয়ে ২০১৭’র নভেম্বর হতে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রতিমাসে গড়ে ৩০০ ইউনিটের বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করেন তিনি।”
রহমত উল্লাহ জানান, “উল্লেখিত সময়ের মধ্যে অফিস কর্তৃক আমাকে নতুন মিটার সংযোগ অথবা বিল সংক্রান্ত বিষয়ে কোনোপ্রকার সতর্কীকরণ নোটিশ প্রদান করা হয়নি। গত বছরের ১মার্চ বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড, চাঁদপুরের বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগের উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো. সাইফুল ইসলাম হঠাৎ করেই আমার বিদ্যুৎ সংযোগটি বিচ্ছিন্ন করেন। কিছুসময় পর আমাকে অফিসে ডেকে নিয়ে নতুন মিটার সংযোগের জন্য আবেদন করতে বলেন। আমি তার কথায় ওইদিনই নতুন সংযোগের জন্য আবেদন করি। এসময় নতুন মিটার সংযোগের ফি ছাড়াও সাইফুল ইসলাম আমার কাছে অতিরিক্ত ১৫ হাজার টাকা দাবি করেন। ওইদিন তাকে নগদ ৬ হাজার টাকা দেই এবং বাকি টাকা পরে পরিশোধ করবো মর্মে তিনি আমাকে নতুন সংযোগ দেবার আশ্বাস দেন। তবে ছয় হাজার টাকার কোন রশিদ তিনি আমাকে দেন নাই। কিছুদিনের মধ্যেই আমাকে নতুন প্রিপেইড মিটার প্রদান করা হয়। এর কিছুদিন পর মহামারি করোনা শুরু হয়। অন্য সবার মতো আমারও ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ যায়। তাছাড়া আমার ছোট ছেলেটা ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে কাতার থেকে দেশে ফিরেছে। ভিসার মেয়াদ থাকা স্বত্বেও অদ্যাবধি আর কাতার যেতে পারে নাই। যে কারণে স্যারের বাকি টাকাটা আর শোধ করা হয়নি।”
রহমত উল্লাহ আরও বলেন, “২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মো. সাইফুল ইসলাম সঙ্গে কয়েকজনকে নিয়ে আমার পুরোনো মিটারের বিল বকেয়া আছে মর্মে দাবি করেন এবং কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমার নতুন প্রিপেইড সংযোগটি বিচ্ছিন্ন করে আমাকে পুনরায় অফিসে যেতে বলেন। কোনো উপায় না দেখে ঢাকায় আমার সাংবাদিক শ্যালককে বিষয়টি জানানোর পর মোবাইল ফোনে সাইফুল স্যারকে অনুরোধ করলে কয়েক ঘন্টা পর আমার সংযোগটি পুনরায় চালু করা হয়। এর দু’দিন পর সাইফুল স্যার আমাকে অফিসে ডেকে পাঠায়। অফিসে দেখা করতে গেলে তিনি আমাকে পুরোনো মিটারের বকেয়া বাবদ ৫২,৫৩৭/- (বায়ান্ন হাজার পাঁচশত সাইত্রিশ) টাকা দাবি করেন এবং একটি বিল ধরিয়ে দেন। এরপর থেকেই উল্লেখিত বিল পরিশোধের জন্য তিনি আমাকে নিয়মিত চাপ প্রয়োগসহ বিভিন্ন হুমকী দিয়ে চরেছেন।”
রহমত উল্লাহ বলেন, আমার কোনো বিল বকেয়া নাই। প্রবাস জীবন শেষ করে পৈত্রিক ভিটায় টিনসেড বাড়ি করে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বসবাস করছি। আমার স্থায়ী কোনো আয় নাই। তারউপরে বিদ্যুতের এ ঝামেলা আমাকে চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। সাইফুল ইসলামের হয়রানি প্রসঙ্গে বিপিডিবি, চাঁদপুরের নির্বাহী প্রকৌশলী এসএম ইকবালকে জানাতে গেলেও তিনি ‘তুই-তোকারি’ ব্যবহার করে আমাকে রুম থেকে বের করে দিয়েছেন।
এসব বিষয়ে মুঠোফোনে (০১৭০৮-৫৫২৩৭৮) জানতে চাইলে মো. সাইফুল ইসলাম এ প্রতিবেদককে বলেন, অসম্ভব। আমি কাউকে হয়রানি কিংবা কারো কাছ থেকে কোনপ্রকার অনৈতিক সুবিধা গ্রহণ করি না। সরকার আমাকে বেতন দেন। আমি সরকারের দেয়া দায়িত্ব পালন করি মাত্র। সম্প্রতি একটি টিভি চ্যানেল আপনার অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে রিপোর্ট করেছে- এমন প্রসঙ্গ তুলতেই তিনি সংযোগটি বিচ্ছন্ন করে দেন।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড, চাঁদপুরের বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগের উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো. সাইফুল ইসলামের হয়রানী ও চাঁদাবাজী সংশ্লিষ্ট এলাকার গ্রাহকদেরকে অতিষ্ট করে তুলেছে। বিদ্যুতের মিটার নিষ্ক্রিয়করণ, সংযোগ বিচ্ছিন্নকরণ, মামলা ও পুলিশের ভয় দেখানোসহ বিভিন্ন অযুহাতে সাইফুল ইসলাম গ্রাহকদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। সম্প্রতি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে (এসএ টিভি) সাইফুল ইসলামের ঘুষ-দুর্নীতি-অনিয়মের বিষয়ে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। রিপোর্টে একাধিক ভুক্তভোগী সাইফুল ইসলাম কর্তৃক নানানভাবে হয়রানীর কথা উল্লেখ করেছেন। চাঁদপুরের ফার্নিচার ও ভ্যান সার্ভিস ব্যবসায়ি খোরশেদের কাছ থেকে দেড় লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি। আরেক ব্যবসায়ি নুর মোহাম্মদের কাছ থেকেও ছত্রিশ হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন সাইফুল ইসলাম।
সাইফুল ইসলামের বিরুদ্ধে ঘুষ গ্রহণ ও গ্রাহক হয়রানির অভিযোগ প্রসঙ্গে বিপিডিবি চেয়ারম্যান এর চিফ স্টাফ অফিসার প্রকৌশলী মনিরুজ্জামান সময়নিউজকে বলেন, বিষয়টি তদন্ত করা হবে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে।
সম্পর্কিত বিষয়:
বিপিডিবি
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: