ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা কোথায়, হামলা হয়েছে কোন কোন স্থাপনায়?
প্রকাশিত:
১৫ জুন ২০২৫ ১৭:৩৬
আপডেট:
১৬ জুন ২০২৫ ০২:০৮

শুক্রবার ইরানের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালায় ইসরায়েলি সেনাবাহিনী। বিবিসি হামলার বিভিন্ন ভিডিও ক্লিপ যাচাই করে পাঁচটি স্থানের তথ্য নিশ্চিত করেছে, যেগুলাে দেশটির গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনা। এর কয়েকটি রাজধানী তেহরানে, আর বাকিগুলো দেশের অন্যত্র।
ইরান শুরু থেকেই জোর দিয়ে বলে আসছে, তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি কেবল বেসামরিক ও শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে স্থাপন করা। তারপরও আন্তর্জাতিক মহল বিশেষ করে বৈশ্বিক পারমাণবিক পর্যবেক্ষক সংস্থা আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থা (আইএইএ) বার বার এ নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে আসছে।
ইরানের সেই গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনাগুলো দেশটির কোথায় কোথায় অবস্থিত আর সেগুলোতে কী কাজ হয় এবং এবার কোন কোন স্থাপনায় হামলা হয়েছে।
• নাতাঞ্জ ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র
নাতাঞ্জ ফুয়েল এনরিচমেন্ট প্লান্ট (এফইপি) হচ্ছে ইরানের সবচেয়ে বড় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র; যা ২০০৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে চালু হয়। এখানে সেন্ট্রিফিউজ নামের প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়।
সেন্ট্রিফিউজ হলো এমন একট যন্ত্র, যা ঘূর্ণন শক্তি ব্যবহার করে ইউরেনিয়াম হেক্সাফ্লুরাইড গ্যাস থেকে ইউরেনিয়াম আইসোটোপ ইউ-২৩৫-কে আলাদা করে। ইউরেনিয়াম আইসোটোপ ইউ-২৩৫ হলো পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জ্বালানি।
ইউ-২৩৫ হলো স্বল্প-সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম, যার মাত্রা থাকে তিন থেকে চার শতাংশ। তবে একে ৯০ শতাংশ পর্যন্ত সমৃদ্ধ করলে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি সম্ভব। এই প্লান্টের দুটি ইউনিট রয়েছে। একটি ইউনিট হলো পাইলট ফুয়েল এনরিচমেন্ট ফ্যাসিলিটি (পিএফইপি); যেখানে পরীক্ষামূলকভাবে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করা হয়।
আরেকটি হলো মেইন ফুয়েল এনরিচমেন্ট ফ্যাসিলিটি (এফইপি); যেখানে বড় পরিসরে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করা হয়। দুটি ইউনিটেরই অবস্থান মাটির নিচে, বিশেষ সুরক্ষা দিয়ে তৈরি যাতে বিমান হামলার আঘাত থেকে বাঁচানো যায়।
এই কেন্দ্রটিতে তিনটি বড় ভবন রয়েছে যার সবগুলোই মাটির নিচে নির্মিত এবং সেখানে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার সেন্ট্রিফিউজ রাখা যায়। তবে ১৩ জুনের হামলায় এই কেন্দ্রের অনেক ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি করেছে ইসরায়েল।
২০১৫ সালের জুলাইয়ে পারমাণবিক চুক্তিতে ইরান কিছু শর্ত মেনে নেয়। যেমন আগামী ১০ বছরে তারা নাতাঞ্জে পুরোনো ও কম কার্যকর পাঁচ হাজার ৬০টির বেশি সেন্ট্রিফিউজ বসাবে না। ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ বিষয়ক গবেষণা ও উন্নয়ন কেবল নাতাঞ্জে হবে এবং তা আট বছরের জন্য।
তবে ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর ইরান আবার উচ্চমাত্রায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করা শুরু করে। যা পরে ৬০ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছায়। যেখানে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির জন্য ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের সীমা হল ৯০ শতাংশ।
• ফোর্দো সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র
ফোর্দো কেন্দ্রে হামলার প্রমাণ এখনও মেলেনি। তবে এটিও ইরানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক কেন্দ্র। এই স্থাপনাটি তেহরান থেকে প্রায় ১৬০ কিলোমিটার দক্ষিণে কোম শহরের কাছে অবস্থিত।
এই স্থাপনাটি পাহাড়ের নিচে অনেক গোপনে ও সুরক্ষিত উপায়ে তৈরি করা হয়েছে; যা ২০০৯ সালে বিশ্বের নজরে আসে। তারপর থেকে এই প্লান্টটি নিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উদ্বেগ দেখা দেয়।
এই কেন্দ্রেও ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করা হয় এবং বলা হয়, এই প্লান্টটি বিমান হামলার বিরুদ্ধে অত্যন্ত সুরক্ষিত। এখানেও অন্তত ৩ হাজার সেন্ট্রিফিউজ রাখার ব্যবস্থা আছে। যা ইউরেনিয়ামকে অস্ত্রের জন্য প্রয়োজনীয় মাত্রায় উন্নত করতে পারে।
২০১৫ সালের চুক্তি অনুযায়ী, একে গবেষণা কেন্দ্রে রূপান্তর করার কথা ছিল এবং ১৫ বছরের জন্য ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কার্যক্রম বন্ধ রাখার বিষয়েও সম্মত হয়েছিল ইরান।
তবে যুক্তরাষ্ট্র এই চুক্তি থেকে সরে যাওয়ার পর, ইরান এখানেও আবার ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ শুরু করে এবং ২০২১ সালের মধ্যে তা ২০ শতাংশে এবং ২০২২ সালের মধ্যে ৬০ শতাংশে নিয়ে যায়।
ইরান তাদের এই সমৃদ্ধকরণের ক্ষমতা আরও বাড়াবে বলে জানিয়েছে। যা ইরানকে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির পথে নিয়ে যেতে পারে।
• খােনদাব হেভি ওয়াটার রিঅ্যাক্টর
খােনদাব রিঅ্যাক্টর আগে আরাক হেভি ওয়াটার রিঅ্যাক্টর নামে পরিচিত ছিল। এই পারমাণবিক কেন্দ্রটি ইরানের মারকাজি প্রদেশের খােনদাব শহরের কাছে অবস্থিত। এই রিঅ্যাক্টরটি শুরুতে তৈরি করা হয়েছিল গবেষণার জন্য।
তবে এই রিঅ্যাক্টরটি প্লুটোনিয়াম উৎপাদন করতে পারে, যা পারমাণবিক বোমা বানানোর উপাদান। ২০১৫ সালের চুক্তি অনুযায়ী, ইরান এই রিঅ্যাক্টরের নির্মাণ কাজ বন্ধ করে দেয় এবং এই রিঅ্যাক্টরের মূল অংশ খুলে ফেলে কংক্রিট দিয়ে বন্ধ করে দেয়। যাতে এটা আর ব্যবহার করা না যায়।
পরে এই রিঅ্যাক্টরকে নতুনভাবে নকশা করার কথা ছিল, যাতে প্লুটোনিয়ামের উৎপাদন কমানো যায় এবং এখান থেকে যেন ভবিষ্যতে অস্ত্র তৈরি করা না যায়। ইরান পারমাণবিক শক্তি কমিশনকে জানিয়েছে, তারা ২০২৬ সালের মধ্যে এই রিঅ্যাক্টরটি আবার চালু করতে চায়।
এই রিঅ্যাক্টরের ভবিষ্যৎ নিয়ে আন্তর্জাতিক মহল বেশ উদ্বিগ্ন।
• ইসফাহান পারমাণবিক প্রযুক্তি কেন্দ্র
ইসফাহান পারমাণবিক প্রযুক্তি কেন্দ্র ইউরেনিয়ামকে নানাভাবে প্রক্রিয়াজাত করে ইউরেনিয়াম হেক্সাফ্লুরাইড (ইউএফ৬) তৈরি করে। ইউরেনিয়াম হেক্সাফ্লুরাইড হলো রিঅ্যাক্টরের জ্বালানি; যা পরে নাতাঞ্জ বা ফোর্দোতে পাঠানো হয় সমৃদ্ধ করতে।
এছাড়া এখানেই তৈরি হয় পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালানি, যার মধ্যে বুশেহর বিদ্যুৎকেন্দ্রও পড়ে। ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইরান জানায়, তারা এখানে চতুর্থ গবেষণা রিঅ্যাক্টর নির্মাণ শুরু করছে।
এই কেন্দ্রটি আইএইএর নজরদারির আওতায় থাকলেও ইউরেনিয়াম উৎপাদন নিয়ে সংস্থাটি বেশ উদ্বিগ্ন। সংস্থাটির ধারণা এই ইউরেনিয়াম সামরিক কাজে ব্যবহার হতে পারে।
তবে, ইসফাহান পারমাণবিক কেন্দ্র থেকে ইরান তাদের প্রয়োজনীয় পারমাণবিক জ্বালানি তৈরি করার কথা বলে আসছে।
• বুশেহর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র
বুশেহর হলো ইরানের একমাত্র পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, যা বুশেহর শহরের দক্ষিণে পারস্য উপসাগরের উপকূলে অবস্থিত। এর নির্মাণ কাজ শুরু হয় ১৯৭৫ সালে জার্মানির সহায়তায়।
তবে, দীর্ঘ সময় এর কাজ বন্ধ ছিল। পরে রাশিয়ার সহায়তায় এর কাজ সম্পন্ন করা হয় এবং বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি চালু হয় ২০১১ সালে।
এখানে ব্যবহৃত ইউরেনিয়াম রাশিয়া থেকে আনা হয় আর ব্যবহৃত জ্বালানি আবার রাশিয়াতে ফেরত পাঠানো হয়। যাতে তা প্রক্রিয়াজাত করে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির উপাদান বানানো না যায়।
এই কেন্দ্রটি পুরোপুরি আইএইএর নজরদারির আওতায় থাকলেও ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকায় এর অবস্থান হওয়ায় নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে।
• তেহরান রিসার্চ রিঅ্যাক্টর
১৯৬৭ সালে আমেরিকার সহায়তায় বানানো এই রিঅ্যাক্টর চিকিৎসা কাজে ব্যবহৃত হয়। বিশেষ করে ক্যানসারসহ নানা রোগের চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় আইসোটোপ তৈরি করতে।
আর আইসোটোপ তৈরি করতে এই রিঅ্যাক্টরে উচ্চমাত্রায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করা হতো। তবে ১৯৮৭ সালে এটি নিম্নমাত্রার সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম ব্যবহার শুরু করে। জ্বালানি ঘাটতির কারণে এই রিঅ্যাক্টরের কার্যক্রম অনেক কমে গিয়েছিল।
পরে ২০০৯ সালে ইরান এই রিঅ্যাক্টরের জন্য জ্বালানি তৈরির করতে ইউরেনিয়াম ২০ শতাংশ পর্যন্ত সমৃদ্ধ করা শুরু করে। ২০১২ সালে ইরান নিজেদের তৈরি করা জ্বালানি রড এই রিঅ্যাক্টরে ব্যবহার শুরু করে।
• পারচিন সামরিক কমপ্লেক্স
তেহরানের দক্ষিণ-পূর্বের পারচিন হলো একটি গোপন সামরিক ঘাঁটি। আইএইএ আগের রিপোর্টে সন্দেহ করেছিল, ইরান পারচিনের এই কমপ্লেক্সটি পারমাণবিক অস্ত্র বানাতে ব্যবহার করতে পারে।
তবে ইরান শুরু থেকেই এমন দাবি অস্বীকার করে আসছে। তারা বলছে, এটি শুধুই সামরিক ঘাঁটি, পারমাণবিক কোন কার্যক্রম এখানে হয় না। তারা কাউকে সহজে ভেতরে ঢুকতে দেয় না।
২০১৫ সালে তৎকালীন আইএইএ প্রধান এই কমপ্লেক্সটি পরিদর্শন করলেও এই কেন্দ্র নিয়ে তাদের উদ্বেগ কমেনি। ২০২২ সালের মে মাসে পারচিনে বিস্ফোরণে এক প্রকৌশলী নিহত এবং আরেকজন আহত হওয়ার ঘটনায় আবার সন্দেহ তৈরি হয়।
ইরান জোর দিয়ে বলে আসছে, তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি শুধুই শান্তিপূর্ণ এবং বেসামরিক। বিশ্বের অনেক দেশ এবং আন্তর্জাতিক সংস্থা এ ব্যাপারে আশ্বস্ত হতে পারেনি। এ কারণে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা সবসময় আন্তর্জাতিক রাজনীতির একটি উত্তপ্ত ইস্যু এবং এজন্য ইরানকে দফায় দফায় নানা নিষেধাজ্ঞার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে। তবে ১৩ জুনের হামলার পর ইরানের পারমাণবিক ভবিষ্যৎ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে সেটাই এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সূত্র: বিবিসি।
সম্পর্কিত বিষয়:
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: