ইসরায়েলের অর্থ ও সহায়তায় চলছে সিরিয়া ভাঙার পরিকল্পনা, শামিল যুক্তরাষ্ট্রও
প্রকাশিত:
১৪ আগস্ট ২০২৫ ১২:২৬
আপডেট:
১৪ আগস্ট ২০২৫ ১৪:৩২

সিরিয়াকে ভাঙার একটি সংগঠিত পরিকল্পনা ইসরায়েলের অর্থ ও সহায়তায় এগিয়ে চলেছে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রও প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত রয়েছে—এমনটাই জানাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক অনুসন্ধানী গণমাধ্যম দ্য ক্রেডল। বিশ্লেষকদের মতে, প্রকল্পটি মূলত সিরিয়ার পশ্চিমাঞ্চলকে কেন্দ্র করে সাজানো হলেও এর প্রভাব বিস্তৃত হতে পারে লেবানন পর্যন্ত।
মার্কিন সিনেটের ফরেন রিলেশনস কমিটির গত ১৩ ফেব্রুয়ারির এক শুনানিতে সিনেটর জেমস রিশ বলেন, 'সিরিয়ার মানচিত্র যেন এক সমতল রুবিক্স কিউবের মতো, যেখানে বিভিন্ন অঞ্চলের বিভাজন সুস্পষ্ট। আমরা মূলত পশ্চিম অংশ নিয়েই কথা বলছি।' এই মন্তব্যটি ছিল মার্চ মাসে আলভী সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সংঘটিত গণহত্যার কয়েক সপ্তাহ আগের। রিশের মতে, পশ্চিমাঞ্চল নিয়ন্ত্রণে না আনতে পারলে পুরো দেশ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়।
ওয়াশিংটন ইনস্টিটিউট ফর নিয়ার ইস্ট পলিসির ম্যানেজিং ডিরেক্টর মাইকেল সিংও শুনানিতে বলেন, পশ্চিম সিরিয়ায় সরকারের সঙ্গে সরাসরি মোকাবিলা করা এবং বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে সমন্বয় গড়ে তোলা সম্ভব। এসব বক্তব্য এখন বাস্তব রূপ নিচ্ছে এক বহুমুখী সামরিক–রাজনৈতিক অভিযানে, যার মূল তত্ত্বাবধান করছে ইসরায়েল। পরিকল্পনার লক্ষ্য—সাম্প্রদায়িক বিভাজন উসকে দিয়ে সিরিয়া–লেবানন সীমান্তে নতুন বাস্তবতা তৈরি।
পরিকল্পনাটি লেবাননের গভীরে প্রবেশ করেছে। এখানে হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে ব্যাপক সামরিক অভিযান চালানোর পাশাপাশি লেবাননের উপকূলীয় অঞ্চলে সশস্ত্র সিরীয় বাহিনী মোতায়েন রাখার উদ্যোগ রয়েছে। ইসরায়েলি সেনাপ্রধান ইয়াল জামিরা ও ক্যাপ্টেন রবার্ট এই প্রকল্পের সরাসরি পরিচালনায় আছেন, আর অর্থায়নে রয়েছে উগ্রপন্থী ইসরায়েলি সরকার। যদিও গণমাধ্যমে এটিকে খ্রিষ্টানসহ সংখ্যালঘুদের সুরক্ষার উদ্যোগ হিসেবে প্রচার করা হচ্ছে, বিশ্লেষকেরা বলছেন, প্রকৃত উদ্দেশ্য হলো চার্চ, মঠ এবং ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলোতে হামলা চালিয়ে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি করা এবং ইসরায়েলি হস্তক্ষেপের পথ তৈরি করা।
সম্প্রতি সিরিয়ার নিরাপত্তাবাহিনী তারতুসের মার এলিয়াস ম্যারোনাইট চার্চে হামলার পরিকল্পনায় যুক্ত একটি সেল গ্রেপ্তারের খবর দিয়েছে। নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের মতে, এটি ছিল নির্দিষ্ট গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে পরিচালিত উচ্চ পর্যায়ের অভিযান। এর আগে গণমাধ্যমে দাবি করা হয়েছিল, ‘ক্রিশ্চিয়ান মিলিটারি কাউন্সিল’ গঠন হয়েছে এলিয়াস সাব নামে এক নেতার নেতৃত্বে, যদিও তার অস্তিত্বের প্রমাণ মেলেনি।
মার্কিন কৌশলগত পরামর্শক প্রতিষ্ঠান টাইগার হিল পার্টনার্স ৫ আগস্ট ঘোষণা দেয়, তারা ‘ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট অব ওয়েস্টার্ন সিরিয়া’র আনুষ্ঠানিক প্রতিনিধি হবে। প্রায় ১০ লাখ ডলারের এই এক বছরের চুক্তির আওতায় তারা খ্রিষ্টান, দ্রুজ, আলভী, কুর্দ ও ‘মধ্যপন্থী সুন্নি’দের পক্ষে কাজ করবে এবং মার্কিন নীতি-নির্ধারকদের সঙ্গে সমন্বয় করবে।
এ ছাড়া জুলাইয়ের শেষ দিকে ‘ম্যান অব লাইট—সারায়া আল-জাওয়াদ’ নামে এক উপকূলীয় বিদ্রোহী গোষ্ঠী আত্মপ্রকাশ করে। তাদের ঘোষণায় সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আবু মুহাম্মাদ আল-জোলানি, কাতারের আমির ও তুরস্কের প্রেসিডেন্টের সমালোচনা করা হয়, পাশাপাশি ইসরায়েলি সাংবাদিক এডি কোহেন ও প্রবাসী কিছু আলভী, দ্রুজ ও খ্রিষ্টান নেতাদের ধন্যবাদ জানানো হয়। এর আগে ১৭ ও ২১–২২ জুলাই তেল আভিভের এক হোটেলে ইসরায়েলি সরকারি কর্মকর্তা এবং নির্বাসিত আলভী–দ্রুজ নেতাদের দুই দফা বৈঠক হয়।
৬ আগস্ট সাংবাদিক এডি কোহেন ঘোষণা দেন, যুক্তরাষ্ট্রে আলভী–দ্রুজ জোট গঠনের প্রস্তুতি চলছে। একই সময়ে ফাঁস হওয়া একটি অডিওতে শোনা যায়, ইসরায়েলি মধ্যস্থতাকারীদের সহায়তায় ২ হাজার ৫০০ বিদেশি যোদ্ধা সিরিয়ায় পাঠানোর পরিকল্পনা রয়েছে।
যদিও এই পরিকল্পনা দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে, সিরিয়ার ভেতরে ও বাইরে থেকে একাধিক পক্ষ তা ব্যর্থ করার চেষ্টা করছে। ইতিমধ্যে সাফিতা চার্চে হামলা ও দামেস্কে বড় ধরনের বোমা হামলা প্রতিহত হয়েছে। এক আঞ্চলিক নিরাপত্তা সূত্র দ্য ক্রেডলকে জানায়, ইসরায়েল সাম্প্রদায়িক বিভাজনকে ব্যবহার করে সংখ্যালঘুদের সামরিক ও রাজনৈতিক হাতিয়ার বানাতে চাইছে। লক্ষ্য—সিরিয়াকে টুকরো করা এবং দুইটি কৌশলগত করিডর খোলা, একটি সুয়েইদা থেকে হাসাকা পর্যন্ত, অন্যটি উপকূল থেকে আফ্রিন পর্যন্ত।
‘পশ্চিম সিরিয়া’ প্রকল্প সম্পূর্ণভাবে গোপন থাকবে নাকি প্রকাশ্য রূপ নেবে, তা সময় বলবে। তবে এর গতিপথ স্পষ্ট—সংখ্যালঘু সুরক্ষার আড়ালে বিদেশি পৃষ্ঠপোষকতায় সিরিয়ার ভৌগোলিক অখণ্ডতা ধ্বংসের একটি সক্রিয় অভিযান ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে।
সম্পর্কিত বিষয়:
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: