মঙ্গলবার, ১৭ই জুন ২০২৫, ২রা আষাঢ় ১৪৩২

Shomoy News

Sopno


দুদকের মামলায় ফাঁসছেন সাবেক সচিবসহ ৭৫ জন


প্রকাশিত:
১৯ সেপ্টেম্বর ২০২১ ১৯:১৭

আপডেট:
১৯ সেপ্টেম্বর ২০২১ ২১:৩৭

ফাইল ছবি

এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লি. ও ইন্টারন্যাশনাল লিজিং থেকে পি কে হালদার সিন্ডিকেটের ৪ হাজার ৩০০ কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনায় ২০টি মামলা দায়েরের প্রাথমিক অনুমোদন দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এসব মামলায় অর্থ আত্মসাতে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়ায় ৭৫ জনকে আসামি করা হচ্ছে। আসামিদের মধ্যে সাবেক সিনিয়র সচিবসহ অন্তত দেড় ডজন প্রভাবশালী ব্যক্তির নাম রয়েছে। দুই-এক দিনের মধ্যে মামলাগুলো দায়ের করা হবে বলে কমিশন সূত্র জানিয়েছে।

মামলায় যাদের আসামি করা হচ্ছে, তাদের মধ্যে রয়েছেন: এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লি.-এর চেয়ারম্যান ও সাবেক সিনিয়র সচিব মো. সিদ্দিকুর রহমান, ভাইস চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলম, সাবেক পরিচালক উজ্জ্বল কুমার নন্দী, পরিচালক বীরেন্দ্র কুমার সোম, পরিচালক এম এ হাফিজ, পরিচালক সোমা ঘোষ, মো. আতাহারুল ইসলাম, পি কে হালদার, ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের এমডি রাশেদুল হক, এসভিপি নাহিদা রুনাই, সৈয়দ আবেদ সামাদ, বাসুদেব ব্যানার্জি, পাপিয়া ব্যানার্জি, নওশেদুল ইসলাম, মো. নুরুজ্জামানসহ প্রতিষ্ঠানটির সব পরিচালক।

এছাড়া দুদকের তদন্ত টিম প্রাথমিকভাবে তথ্য পেয়েছে যে রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানির (আরজেএসসি) দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের গাফিলতির কারণে পি কে সিন্ডিকেট ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামে লাইসেন্স নিয়ে লিজিং থেকে ঋণের নামে শত শত কোটি টাকা আত্মসাতের সুযোগ পেয়েছে। কমিশন জয়েন্ট স্টকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিষয়ে খোঁজখবর নিচ্ছে। গাফিলতি প্রমাণিত হলে তাদের চার্জশিটের অন্তর্ভুক্ত করা হতে পারে বলে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। এদিকে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেছে কি না, সে বিষয়টিও খতিয়ে দেখছে দুদক। তাদের দায়িত্বে ইচ্ছাকৃত কোনো গাফিলতি পেলে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে কমিশন সূত্র জানিয়েছে।

অন্যদিকে অভিযুক্তদের লেনদেনবিষয়ক বিভিন্ন তথ্যের জন্য ২০টি ব্যাংকে চিঠি দিয়েছেন দুদকের তদন্তকারী কর্মকর্তা। ইতিমধ্যে দুদক টিম বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এফএএস ফাইন্যান্স ও ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের পাঁচ বছরের অডিট প্রতিবেদন সংগ্রহ করে পর্যালোচনা করেছে। শিগিগরই সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের তলব করা হবে। এছাড়া সাবেক ডেপুটি গর্ভনর এস কে সুর ও এক্সিকিউটিভ ডাইরেক্টর শাহ আলমকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হতে পারে বলে দুদক সূত্র জানিয়েছে।

যেভাবে অর্থ আত্মসাৎ :

দুদকের অনুসন্ধান সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, পিপলস লিজিংয়ের মতো ইন্টারন্যাশনাল লিজিং ও এফএএস ফাইন্যান্সেও পি কে হালদার বিভিন্ন কাগুজে প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে লুটতরাজ চালিয়েছেন। দুদকের অনুসন্ধানে প্রাথমিকভাবে প্রমাণ পাওয়া গেছে যে এফএএস ফাইন্যান্স থেকে পি কে হালদার সংশ্লিষ্ট ২০টি প্রতিষ্ঠানের নামে জালিয়াতির মাধ্যমে ঋণ নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে এস এ এন্টারপ্রাইজ, মুন ইন্টারন্যাশনাল লি., সুখাদা প্রোপার্টিজ লি., ন্যাচার এন্টারপ্রাইজ, আরবি এন্টারপ্রাইজ, দিয়া শিপিং লি., নিউটেক এন্টারপ্রাইজ, নিউট্রিক্যাল লি., মেসার্স বর্ন, কণিকা এন্টারপ্রাইজ, দ্রিনান অ্যাপারেলস, এন্ড বি এন্টারপ্রাইজ, এমার এন্টারপ্রাইজ, জিঅ্যান্ডজি এন্টারপ্রাইজ, তামিম অ্যান্ড তালহা, হাল ইন্টারন্যাশনাল, মেরিন ট্রাস্ট লি., আর্থস্কোপ এবং এমটিবি মেরিন কাগুজে ও অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতীয়মান হয়েছে। দুটি প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা পাওয়া গেলেও তা বন্ধ রয়েছে। ঋণ নেওয়া ঐ সব প্রতিষ্ঠানের মালিকেরাও তাদের বাসায় থাকেন না বা বিদেশে পলাতক রয়েছেন। জালিয়াতির মাধ্যমে ঋণ নেওয়া এসব প্রতিষ্ঠানের ঋণের বিপরীতে মর্টগেজ (বন্ধক) নেই বললেই চলে। ফলে ঋণের টাকা আদায়ের আর কোনো সম্ভাবনা নাই। দুদক টিম প্রমাণ পেয়েছে, এভাবে ২০টি কাগুজে প্রতিষ্ঠানকে প্রায় ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়, অথচ ঐ সব প্রতিষ্ঠানের হিসাবে এসব অর্থ যায়নি। বরং পি কে সিন্ডিকেটের বিভিন্ন হিসাবে বিতরণ করা হয়েছে।

দুদক কর্মকর্তারা বলছেন, মূলত এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লি.-এর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাগণ অসত্ উদ্দেশ্যে ক্ষমতার অপব্যবহার-পূর্বক প্রতারণার মাধ্যমে অপরাধমূলক বিশ্বাস ভঙ্গ করে ঋণ আবেদন যাচাই-বাছাই ছাড়াই কোনো মর্টগেজ গ্রহণ ছাড়াই প্রায় ২০টি কাগুজে প্রতিষ্ঠানকে ভুয়া ঋণ পাইয়ে দিতে সহযোগিতা করেছেন। এ জালিয়াতি অনুসন্ধানে কমিশন এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লি.-এর চেয়ারম্যান, পরিচালনা পর্ষদ, ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ ২২ কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। দুদকের জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যানসহ পরিচালকগণ ঋণ অনুমোদনে তাদের অনিয়মের কথা স্বীকার করেছেন এবং এজন্য তারা দুঃখ প্রকাশ করেছেন। প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছেন যে পি কে হালদার প্রায় সময়ই এমডি রাসেল শাহরিয়ারের রুমে আসতেন এবং বোর্ড মিটিংয়ে প্রায়ই উপস্থিত থাকতেন। যদিও পি কে হালদার ঐ প্রতিষ্ঠানের কেউ ছিলেন না।

ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেডের ব্যাপারে দুদক সূত্র বলছে, এই আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ৩ হাজার কোটি টাকা লুটে নেওয়া হয়েছে। এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক ও রিলায়েন্স ফাইন্যান্স লিমিটেডের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রশান্ত কুমার (পি কে হালদার) হালদারের নেতৃত্বে টাকাগুলো লুট করা হয়। এর মূল চাবিকাঠি নাড়েন রিলায়েন্স ফাইন্যান্সের তখনকার ডিএমডি রাশেদুল হক, যিনি পরে প্রতিষ্ঠানটির এমডিও হন। দুদক সূত্রে জানা যায়, রাশেদুল হক মূলত পি কে হালদারকে লুটে সাহায্য করেছেন। তিনি পি কে হালদারের ডানহাত ছিলেন। ২০১০ সালে পি কে হালদার যখন রিলায়েন্স ফাইন্যান্সের এমডি ছিলেন তখন রাশেদুল হক রিলায়েন্স ফাইন্যান্সের ডিএমডি ছিলেন। পি কে হালদার যখন এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হন, তখন রাশেদুল হক ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের এমডি হিসেবে যোগদান করেন। এমডি হিসেবে যোগ দিয়েই সব প্রতিষ্ঠানের কর্তৃত্ব নিজের হাতে নিয়ে নেন রাশেদুল। কোনো প্রকার যাচাই-বাছাই ছাড়াই ঋণ প্রস্তাবের পর দিনই ঋণ দিয়ে দেন। এভাবে প্রায় ৪০টি প্রতিষ্ঠানকে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা ঋণ দিয়েছেন, যার বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কোনো মর্টগেজ ছিল না। কাগুজে প্রতিষ্ঠানকে মর্টগেজ ছাড়াই শত শত কোটি টাকা ঋণ দিয়ে ইন্টারন্যাশনাল লিজিংকে পথে বসিয়েছেন রাশেদুল।

এছাড়া পি কে হালদারের খালাতো ভাই অমিতাভ অধিকারী এবং সাবেক সহকর্মী উজ্জ্বল কুমার নন্দী ইন্টারন্যাশনাল লিজিং থেকে অর্থ হাতিয়ে নিতে বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন। উজ্জ্বল কুমার নন্দী পিপলস লিজিংয়ের চেয়ারম্যান হিসেবে এবং অমিতাভ অধিকারী পিপলস লিজিং পরিচালক হিসেবে ২০১৫ সাল থেকে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন। তারা বেনামি প্রতিষ্ঠান দিয়ে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং থেকে টাকা বের করে সে টাকা দিয়ে পিপলস লিজিংয়ের চেয়ারম্যান ও পরিচালক হন। পরবর্তী সময় একই কায়দায় পিপলস লিজিং থেকে টাকা বের করে প্রতিষ্ঠানটিকে পথে বসিয়েছেন।

আরজেএসসিকে চিঠি :

দুদকের তদন্ত টিমের প্রধান তদন্তকারী কর্মকর্তা উপপরিচালক মো. গুলশান আনোয়ার প্রধান ইতিমধ্যে রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানির (আরজেএসসি) কাছে পি কে হালদারের লুটপাটসংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য চেয়ে চিঠি দিয়েছেন। তাদের কাছে আনান কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ লি., দ্রিনান অ্যাপারেলস লি., লিপরো ইন্টারন্যাশনাল লি., নিউট্রিক্যাল লিমিটেড ও ওকায়ামা লিমিটেডের দাখিল করা আবেদনের কপি এবং এর সঙ্গে সংযুক্ত অডিট প্রতিবেদন, বার্ষিক প্রতিবেদন, ফাইন্যান্সিয়াল স্টেটমেন্ট ও ইনকাম স্টেটমেন্টসহ প্রথম নিবন্ধন থেকে শুরু করে সর্বশেষ নিবন্ধন পর্যন্ত যাবতীয় রেকর্ডপত্র চাওয়া হয়েছে। এসব নথিপত্র পর্যালোচনা করে কমিশন এই জালিয়াতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আরো যারা আছে, তাদের আইনের আওতায় আনবে।


সম্পর্কিত বিষয়:


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:




রিসোর্সফুল পল্টন সিটি (১১ তলা) ৫১-৫১/এ, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০।
মোবাইল: ০১৭১১-৯৫০৫৬২, ০১৯১২-১৬৩৮২২
ইমেইল : [email protected]; [email protected]
সম্পাদক : লিটন চৌধুরী

রংধনু মিডিয়া লিমিটেড এর একটি প্রতিষ্ঠান।

Developed with by
Top