রবিবার, ২৯শে জুন ২০২৫, ১৫ই আষাঢ় ১৪৩২

Shomoy News

Sopno


বাংলাদেশের বিমানবন্দর প্রকল্পে অনিয়ম, যুক্ত আমিরাতের রাষ্ট্রদূত


প্রকাশিত:
২৯ জুন ২০২৫ ১৪:১৫

আপডেট:
২৯ জুন ২০২৫ ২১:১২

ছবি সংগৃহীত

বাংলাদেশের বিমানবন্দরে যাত্রী তথ্য ব্যবস্থাপনা প্রকল্পে সংযুক্ত আরব আমিরাতভিত্তিক এক কোম্পানির সঙ্গে করা চুক্তিতে বিপুল আর্থিক অনিয়মের তথ্য উঠে এসেছে। শুধু তা-ই নয়, স্পর্শকাতর এই প্রকল্পে সরাসরি জড়িত রয়েছেন বাংলাদেশে নিযুক্ত সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাষ্ট্রদূত আবদুল্লাহ আলী আলহমুদি।

যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম মিডল ইস্ট আই শুক্রবার প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানায়, আলহমুদি ৩৪ শতাংশ মালিকানা নিয়ে ‘আইডেন্টিমা’ নামের দুবাইভিত্তিক একটি কোম্পানির অংশীদার। আর এই প্রতিষ্ঠানটিই বাংলাদেশের বিমানবন্দরে নতুন প্যাসেঞ্জার ইনফরমেশন সিস্টেম বাস্তবায়নের বড় অংশের দায়িত্ব পেয়েছে সাব-কন্ট্রাক্ট হিসেবে।

নথি অনুযায়ী, আলহমুদি যখন সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন, তখনই এই প্রতিষ্ঠানটির নিবন্ধন এবং কার্যক্রম শুরু হয়। রাষ্ট্রদূত থাকা অবস্থায় এ ধরনের বাণিজ্যিক অংশীদারিত্ব আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক প্রটোকলের পরিপন্থী।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই চুক্তির ফলে বাংলাদেশের সরকারকে আন্তর্জাতিক বাজারের তুলনায় অনেক বেশি মাসুল দিতে হবে। এতে যাত্রীদের ওপরও অতিরিক্ত ব্যয় চাপিয়ে দেওয়া হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-এর নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান এই চুক্তিটি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি এর পূর্ণাঙ্গ তদন্তের দাবি জানিয়েছেন।

ড. ইফতেখারুজ্জামান এটিকে ‘স্বার্থের সংঘাত এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের একটি স্পষ্ট উদাহরণ’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। তিনি মিডল ইস্ট আইকে বলেন, ‘একজন সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে, একজন রাষ্ট্রদূত সরকারের নির্দিষ্ট অনুমোদন ছাড়া কোনো ব্যবসায়িক কার্যক্রমে জড়িত হতে পারেন না। প্রথম প্রশ্ন হলো, এই ধরনের অনুমোদন নেওয়া হয়েছিল কিনা। এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, তিনি যে মূলধন বিনিয়োগ করেছেন, তার উৎস কী?’

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক আরও বলেন, ‘একজন কর্মরত সরকারি কর্মকর্তার সরকারের সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক থাকতে পারে না। এটি কেবল নৈতিকতা নয়, কূটনৈতিক শিষ্টাচারেরও লঙ্ঘন।’

এ বিষয়ে মিডল ইস্ট আই রাষ্ট্রদূত আলহমুদি, ঢাকায় আরব আমিরাতের দূতাবাস, আমিরাতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ সরকার এবং জড়িত কোম্পানিগুলোর সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করলেও প্রতিবেদন প্রকাশের সময় পর্যন্ত কোনো পক্ষই মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।

চুক্তির বিষয়ে অবগত বাংলাদেশের কর্মকর্তারাও মুখ খুলতে চাননি, কারণ তাদের আশঙ্কা, এ বিষয়ে কথা বললে দুই দেশের সম্পর্কে প্রভাব পড়তে পারে।

মিডল ইস্ট আই-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের সরকার একটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষর করে। বাংলাদেশের বিমানবন্দরগুলোতে অ্যাডভান্স পেসেঞ্জার ইনফরমেশন (এপিআই) এবং পেসেঞ্জার নেম রেকর্ড (পিএনআর) ব্যবস্থা স্থাপনের জন্য এ চুক্তি হয়। এই কাজের জন্য আমিরাতের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সংস্থা এমিরেটস টেকনোলজি সলিউশনসকে (Etek) নিয়োগ করা হয়। এই সংস্থার প্রধান কার্যালয় ফুজাইরাহতে অবস্থিত।

কিন্তু Etek এই কাজটির একটি বড় অংশ আইডেন্টিমা (Identima) নামের একটি দুবাই-ভিত্তিক কোম্পানিকে সাব-কন্ট্রাক্ট হিসেবে দেয়। আইডেন্টিমা কোম্পানিটি ২০২১ সালে রাষ্ট্রদূত আলহমুদি নিজে নিবন্ধন করেন। নথিপত্র অনুযায়ী, আলহমুদি এই কোম্পানিতে ৩৪ শতাংশ শেয়ারের মালিক এবং এর ম্যানেজার হিসেবেও তালিকাভুক্ত। বাকি ৬৬ শতাংশ শেয়ারের মালিকানায় রয়েছেন দুই বাংলাদেশি নাগরিক মুনতাসির বিল্লাহ শাহরিয়ার এবং সাজেদ আহমেদ সামির।

শাহরিয়ার সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ বলে মিডল ইস্ট আই-এর প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তার বৈঠকের ছবিও সংগ্রহ করেছে মিডল ইস্ট আই।

এ ছাড়া Etek বা Identima, কোনো প্রতিষ্ঠানেরই বিমানবন্দর তথ্য ব্যবস্থা স্থাপন বা পরিচালনার কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই।

আইডেন্টিমা এরপর সুইজারল্যান্ডের একটি কোম্পানি সিটা (SITA)-এর সঙ্গে চুক্তি করে। এই কোম্পানি এই খাতের বিশ্বসেরা বিশেষজ্ঞদের মধ্যে অন্যতম এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিমানবন্দরগুলোতেও তাদের প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়।

নথি অনুযায়ী, এই চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশকে যাত্রীপ্রতি জন্য প্রায় ৬ দশমিক ৫০ চার্জ করা হচ্ছিল। অবশ্য পরবর্তীতে তা ৪ ডলারে কমিয়ে আনা হয়। কিন্তু ইন্টারন্যাশনাল সিভিল অ্যাভিয়েশন অর্গানাইজেশন (আইসিএও) এই ধরনের সেবার জন্য যাত্রীপ্রতি ৩ দশমিক ৫০ ডলার চার্জের সুপারিশ করে। সিটা সংযুক্ত আরব আমিরাতেই একই সেবার জন্য যাত্রীপ্রতি ১ দশমিক ৫০ ডলার চার্জ নেয়।

এই উচ্চ মূল্য নিয়ে সিএএবি-এর (বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ—বেবিচক) একজন কর্মকর্তা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। কারণ এর ফলে অতিরিক্ত বোঝা বাংলাদেশি প্রবাসী শ্রমিকসহ সাধারণ যাত্রীদের ওপর চাপানো হতে পারে।

এদিকে আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে কূটনীতিকদের আচরণ নিয়ন্ত্রণে প্রণীত ভিয়েনা কনভেনশন, কূটনীতিকদের যে দেশে তারা কর্মরত, সেখানে বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড থেকে লাভবান হওয়া কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করে। আলহমুদি ২০২২ সালের ২১ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশে রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ পান, আর এর তিন মাস পরেই বিমানবন্দরের প্রকল্পটি নিয়ে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়।

২০২১ সালের অক্টোবরে Etek এবং Identima-এর মধ্যে স্বাক্ষরিত একটি সমঝোতা স্মারকে উল্লেখ করা হয়েছে, কোনো পক্ষই স্বার্থের সংঘাত সৃষ্টি করবে না। এই নথিতে সাক্ষী হিসেবে আলহমুদির স্বাক্ষর রয়েছে।

ভিয়েনা কনভেনশন অনুসারে, রাষ্ট্রদূতের নিজ দায়িত্বপালনকারী দেশে বাণিজ্যিক কার্যক্রম থেকে লাভবান হওয়া নিষিদ্ধ। অথচ আলহমুদি এই প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন স্বাক্ষরিত নথিতে তার নাম ও স্বাক্ষরসহ।

এই অবস্থায় বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) চলতি বছরের শুরুতে প্রকল্পের ধীরগতির কথা জানায় এবং বিভিন্ন প্রস্তাব মূল্যায়নের জন্য একটি পর্যালোচনা কমিটি গঠন করে।

২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত চুক্তির মেয়াদ বাড়ানোর অনুরোধ করা হয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাতের পক্ষ থেকে। কিন্তু রাষ্ট্রদূতের ব্যবসায়িক সম্পৃক্ততার বিষয়টি প্রকাশ্যে আসায় গোটা প্রকল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে।


সম্পর্কিত বিষয়:


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:




রিসোর্সফুল পল্টন সিটি (১১ তলা) ৫১-৫১/এ, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০।
মোবাইল: ০১৭১১-৯৫০৫৬২, ০১৯১২-১৬৩৮২২
ইমেইল : [email protected]; [email protected]
সম্পাদক : লিটন চৌধুরী

রংধনু মিডিয়া লিমিটেড এর একটি প্রতিষ্ঠান।

Developed with by
Top