‘আমি কোলাটেরাল ড্যামেজ’: বাংলাদেশে দুর্নীতির মামলা নিয়ে টিউলিপ সিদ্দিক
প্রকাশিত:
১১ আগস্ট ২০২৫ ১৬:৪৮
আপডেট:
১১ আগস্ট ২০২৫ ২১:০৬

‘কোনো প্রত্যর্পণ চুক্তি নেই, বিষয়টি আমি নিজে খতিয়ে দেখেছি’, কথাগুলো বলছিলেন যুক্তরাজ্যের হ্যাম্পস্টেড অ্যান্ড হাইগেটের এমপি এবং গণঅভ্যুত্থানে বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বোনের মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিক। এ বছরের জানুয়ারিতে পদত্যাগ করার আগপর্যন্ত তিনি ট্রেজারি মিনিস্টারের দায়িত্বে ছিলেন।
লেবার পার্টির নেতা কিয়ার স্টারমারের একনিষ্ঠ সমর্থক, ৪২ বছর বয়সি টিউলিপ এক সপ্তাহ আগেই একজন সাংবাদিকের মাধ্যমে জানতে পারেন, বাংলাদেশে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আনা হয়েছে। ওই সাংবাদিক তার আইনজীবীর সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন।
টিউলিপের বিরুদ্ধে অভিযোগ, ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী হাসিনার ভাগ্নি পরিচয়ে নিজের প্রভাব খাটিয়ে রাজধানী ঢাকার পূর্বাচলে মা, ভাই ও বোনের জন্য প্লট বরাদ্দ নিয়েছেন। এ ঘটনা প্রসঙ্গে সাক্ষাৎকারে টিউলিপ বলেন, 'এটা পুরোপুরি হাস্যকর।'
আজ (১১ আগস্ট) টিউলিপসহ আরও ২০ জনেরও বেশি অভিযুক্তের বিচার শুরু হওয়ার তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে।
সশরীরে বা ভিডিওলিঙ্কের মাধ্যমে আদালতে হাজিরা দেবেন কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে টিউলিপ বলেন, 'আমি হিউগো কিথ কিউসি-র (ব্রিটিশ আইনজীবী) কাছ থেকে পরামর্শ নিচ্ছি। তিনি আমাকে পরবর্তী পদক্ষেপ সম্পর্কে পরামর্শ দিচ্ছেন।
'আমি এখনও কোনো আনুষ্ঠানিক সমন পাইনি। …মানে একটি বাইরের দেশে আমার বিরুদ্ধে লোক দেখানো বিচার শুরু হতে আর মাত্র কয়েকদিন বাকি, অথচ আমি এখনো জানি না আমার বিরুদ্ধে ঠিক কী অভিযোগ আনা হয়েছে। আমার মনে হচ্ছে, আমি যেন কাফকাসুলভ দুঃস্বপ্নে আটকা পড়েছি—যেখানে আমার বিচার শুরু হয়ে গেছে, কিন্তু আমি আসলেই জানি না অভিযোগগুলো কী বা এই বিচার কীসের জন্য।'
বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, প্রয়োজনে টিউলিপের বিচারকার্য তার অনুপস্থিতিতেই চালানো হবে। এই মামলায় তিনি দোষী সাব্যস্ত হলে বাংলাদেশ ও যুক্তরাজ্যের মধ্যে প্রত্যর্পণের বিষয়টি নতুন পরীক্ষার মুখে পড়তে পারে।
গত বছর জুলাইয়ের সাধারণ নির্বাচনে লেবার পার্টির জয়ের পর কয়েক মাস টিউলিপ সেরা সময় কাটাচ্ছিলেন। এমপি হওয়ার আগে তিনি কাউন্সিলর ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী টারমার টিউলিপের বন্ধু। দুজনের নির্বাচনী এলাকাও পাশাপাশি। টিউলিপকে ট্রেজারির অর্থনৈতিক সেক্রেটারি ও সিটি মিনিস্টার হিসেবে নিয়োগ দেন স্টারমার।
সেই সময়ই পাঁচ হাজার মাইল দূরে, ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকার পর, ছাত্র-নেতৃত্বাধীন গণআন্দোলনের মুখে ভেঙে পড়তে শুরু করে তার খালা শেখ হাসিনার সরকার।
আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যুর ঘটনায় তীব্র আন্দোলনের পর হাসিনা ও টিউলিপের মা শেখ রেহানা বাংলাদেশ থেকে ভারতে পালিয়ে যান।
তবে ২০২৫ সালের গ্রীষ্মে টিউলিপ, তার ক্রিস পার্সি ও তাদের দুই সন্তানের জীবন স্বাভাবিকভাবেই চলছিল। টিউলিপ বলেন, 'আমি এখানে আমার খালার পক্ষে সাফাই গাইতে আসিনি। আমি জানি, তার শাসনামলের শেষটা কীভাবে হলো সেটি নিয়ে তদন্ত চলছে। আমি আন্তরিকভাবে আশা করি, বাংলাদেশের মানুষ যে সমাধান চায়, সেটি তারা পাবে।'
তবে পরিস্থিতি পাল্টে যায় গত বছরের শেষের দিকে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হওয়ার পর, টিউলিপের ভাষায় বাংলাদেশের 'নোংরা রাজনীতি'র ফলে, তার জীবন এলোমেলো হয়ে যায়।
বিভিন্ন ওয়েবসাইটে খবর প্রকাশিত হতে থাকে, টিউলিপ রাশিয়ার একটি কোম্পানির সঙ্গে তার খালার করা চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশের রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প থেকে ৫ বিলিয়ন ডলার আত্মসাৎ করেছেন।
এ খবরের সঙ্গে ২০১৩ সালে মস্কোতে খালা ও ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে টিউলিপের একটি হাস্যোজ্জ্বল ছবি অনিয়মের গুঞ্জনে জোর হাওয়া দেয়।
এ প্রসঙ্গে টিউলিপ বলেন, 'আমার খালা রাষ্ট্রীয় সফরে রাশিয়ায় গিয়েছিলেন। আমার বোন ও আমি লন্ডন থেকে সেখানে তার সঙ্গে দেখা করার সিদ্ধান্ত নিই। আমি কোনো ধরনের রাজনৈতিক আলোচনায় যুক্ত ছিলাম না। আমরা দর্শনীয় স্থান ঘুরে দেখি, রেস্তোরাঁয় যাই, কেনাকাটা করি—ভালো সময় কাটাই। সফরের শেষ দিনে সেখানে উপস্থিত সমস্ত রাজনীতিবিদ ও তাদের পরিবারকে চা ও সংবর্ধনার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। তখনই ছবিটি তোলা হয়। পুতিনের সঙ্গে আমার মাত্র দুই মিনিটের জন্য দেখা হয়েছিল।'
এরপর আরেকটি অভিযোগ সামনে আসে—২০০৪ সালে 'আওয়ামী লীগসংশ্লিষ্ট এক ব্যক্তি' টিউলিপকে লন্ডনের কিং'স ক্রস এলাকায় একটি ফ্ল্যাট উপহার দিয়েছিলেন।
এ অভিযোগের জবাবে তিনি বলেন, ওই ফ্ল্যাটের আগের মালিক—তার ধর্মপিতা (গডফাদার)—রাজনীতির সাথে জড়িত নন, তার খালার সাথেও পরিচয় নেই।
তবে টিউলিপের জন্য সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় আরেকটি বিষয়। দুই বছর আগে এক সংবাদপত্রকে তিনি বলেছিলেন, ফ্ল্যাটটি তার বাবা-মা তাকে কিনে দিয়েছিলেন।
টিউলিপ দাবি করেন, কথাটা তিনি ভুলে বলেছিলেন। আর এই ভুলের কারণ ছিল তার বয়োবৃদ্ধ বাবা-মায়ের দুর্বল স্মৃতিশক্তি। তার বাবা-মা প্রায় পঁচিশ বছর আগেই আলাদা হয়ে গিয়েছিলেন।
এরপর নতুন প্রশ্ন ওঠে, ক্রিকলউডে নিজের একটি বাড়ি থাকা সত্ত্বেও তিনি কেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত একজন প্রপার্টি ডেভেলপারের মালিকানাধীন বাড়িতে থাকছেন। লেবার পার্টির মাধ্যমেই ওই ডেভেলপারের সাথে পরিচিত হয়েছিলেন বলে দাবি করেন টিউলিপ।
এ অভিযোগের জবাবে তিনি বলেন, তাকে নিরাপত্তা হুমকি সম্পর্কে সতর্ক করা হয়েছিল। সন্ত্রাসবাদের অভিযোগে আটক এক ব্যক্তি বলেছিল, তার এই পরিণতির জন্য টিউলিপ দায়ী।
সেই বছরই টোরি এমপি ডেভিড অ্যামেসকে তার কর্মস্থলে হত্যা করা হয়েছিল। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে টিউলিপকে তার বাড়ি থেকে সরে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। পরিস্থিতির আকস্মিকতায় তিনি পরিচিত একজনের ওপর নির্ভর করেছিলেন।
টিউলিপ বলেন, তিনি বাড়িটির জন্য পুরো বাজারদর অনুযায়ী ভাড়া দিচ্ছিলেন। কিন্তু তারপরও অভিযোগ আসতে থাকে। একপর্যায়ে টিউলিপ নিজেই বিষয়টি পর্যালোচনার জন্য মন্ত্রীদের আচরণবিধি বিষয়ক স্বাধীন উপদেষ্টা লরি ম্যাগনাসের কাছে পাঠান। 'গভীর' পর্যালোচনার পর উপদেষ্টা তাকে মন্ত্রীদের আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ থেকে মুক্তি দেন।
তবে ম্যাগনাস বলেন, 'এটা দুর্ভাগ্যজনক যে তিনি তার পারিবারিক সম্পর্ক এবং সরকারি পদ থেকে উদ্ভূত সম্ভাব্য সুনামের ঝুঁকি সম্পর্কে আরও সতর্ক ছিলেন না।'
এই মন্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় টিউলিপ বলেন, 'দিনশেষে আমার খালা কে, তা তো আমি বদলাতে পারব না।'
তিনি বলেন, এই ঘটনা যাতে সরকারের মনোযোগ অন্যদিকে সরিয়ে নেওয়ার কারণ না হয়, সেজন্যই স্টারমারের সমর্থন থাকা সত্ত্বেও তিনি পদত্যাগ করেছেন।
টিউলিপ এ বছর ড. ইউনূসের যুক্তরাজ্য সফরের সময় তার সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু ড. ইউনূস সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বলেন, এটি বিচার প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করবে।
টিউলিপ বলেন, 'সত্যিটা হলো, মুহাম্মদ ইউনূস আর আমার খালার মধ্যে এই বিবাদের কোলাটেরাল ড্যামেজ হচ্ছি আমি। ...কোনো সন্দেহ নেই, বাংলাদেশে অনেকে অন্যায় কাজ করেছে এবং তাদের শাস্তি হওয়া উচিত। বিষয়টা হলো, আমি সেই দলের কেউ নই।'
তথ্যসূত্র: দ্যা গার্ডিয়ান
সম্পর্কিত বিষয়:
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: