সাংবাদিকতার তত্ত্ব কথায় ‘হোয়াইট কলার জব’ (A white-collar job) বলে একটি আলোচনা আছে। তাতে বিভিন্ন তাত্ত্বিক, পেশাদার সাংবাদিক ও গবেষক বারবার স্পষ্ট করে বলেছেন, সাংবাদিকতা কোনো অবস্থাতেই ‘হোয়াইট কলার জব’ নয়।
মানে সকালে ঘুম থেকে উঠে আয়রন করা পরিপাটি শার্ট পরে অফিসে যাওয়া, শীততাপ নিয়ন্ত্রিত আরাম কেদারায় কাজ করা একজন প্রতিবেদকের নিত্যদিনের দায়িত্ব নয়। বরং এর বিপরীতে দুর্যোগ, দুর্বিপাক, যুদ্ধ, দাঙ্গা, সংঘাতসহ প্রতিকূল পরিস্থিতিতে প্রতিনিয়ত তথ্য, ভিডিও এবং ছবি সংগ্রহ করাই একজন পেশাদার সাংবাদিকের কাজ।
যে কাজে পদে পদে থাকতে পারে মৃত্যু ঝুঁকি। কিন্তু তারপরও পেশাগত দায়িত্বের অংশ হিসেবে, মানুষকে তথ্য জানানোর নেশা থেকে, মানবাধিকার সমুন্নত রাখার ব্রত থেকে সংবাদকর্মীরা প্রতিদিন মৃত্যু ভয়কে তুচ্ছ করে বিপদসংকুল এলাকায় কাজ করে যাচ্ছেন।
বুলেট-বন্দুক-বোমার আঘাতে প্রাণও হারাচ্ছেন অকাতরে। পেশাগত দায়িত্ব পালনে প্রাণ বিসর্জনের এই মহতী মৃত্যুযাত্রায় নতুন ইতিহাস রচনা করেছেন গাজার সাংবাদিকরা।
সাংবাদিকদের নিরাপত্তা ও স্বার্থ নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক সংগঠন কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্ট (Committee to Protect Journalists)-এর তথ্য অনুযায়ী, পৃথিবীর ইতিহাসে এর আগে এত সাংবাদিক কোনো সংঘাতে প্রাণ হারাননি। বর্বর ইসরায়েলের নিষ্ঠুর আক্রমণের খবর মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে এখনো পর্যন্ত এই সংঘাতে প্রাণ হারিয়েছেন ১৭৫ জন সংবাদকর্মী, যাদের মধ্যে ১৬৭ জন ফিলিস্তিনি, ৬ জন লেবানিজ ও ২ জন ইসরায়েলি।
মৃত্যুর এই পরিসংখ্যান বিশ্বের যেকোনো সংঘাতে সর্বোচ্চ। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর শুরু হওয়া এই যুদ্ধে আহত হয়েছেন আরও ৯১ জন সাংবাদিক। সংঘাতের ভেতরে এখনো ২ জন সাংবাদিক নিখোঁজ রয়েছেন। ৮৩ জন সাংবাদিককে আটক করেছে ইসরায়েলি সেনারা।
এছাড়া বর্বর এই হত্যাযজ্ঞের সংবাদ কাভার করতে গিয়ে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন অনেকেই। তারা গুরুতর মানসিক ট্রমায় ভুগছেন।
অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক পর্যবেক্ষণ সংস্থা ওয়াটসন ইন্সটিটিউট জানাচ্ছে, গাজা যুদ্ধে প্রতি সপ্তাহে গড়ে ১৩ জন প্রতিবেদন ও সংবাদকর্মী নিহত হয়েছেন। যা দুইটি বিশ্বযুদ্ধ, ভিয়েতনাম যুদ্ধ, যুগোস্লাভিয়ায় গৃহযুদ্ধ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আফগান যুদ্ধের সম্বিলিত সাংবাদিক ও সংবাদকর্মী হতাহতের চেয়েও বেশি।
আন্তর্জাতিক রীতি অনুযায়ী, সাধারণত যুদ্ধ ও সংঘাত কবলিত এলাকায় সংবাদকর্মীরা বিশেষ নিরাপত্তা পেয়ে থাকেন। সংবাদমাধ্যম ও সংবাদকর্মীদের সংঘাতের বাইরে রাখতে সব পক্ষই চেষ্টা করে থাকেন। কিন্তু গাজায় কর্মরত সাংবাদিকদের সুরক্ষা তো দূরের কথা, রীতিমতো লক্ষ্য করে হত্যা করেছে ইসরায়েলি সেনারা। এমনকি সর্বাত্মক যুদ্ধের আগেও এমন বর্বরতা চালিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী।
২০২২ সালের ১১ মে আল-জাজিরার প্রতিবেদক শিরিন আবু আকলেহ (Shireen Abu Akleh)কে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করেছিল আইডিএফ সেনারা। জেনিন শরণার্থী শিবিরে একটি অভিযানের সংবাদ সংগ্রহের সময় শিরিনের এই হত্যাকাণ্ড চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল ইসরায়েলি বাহিনীর বর্বরতা।
৫১ বছর বয়সী এই নারী সাংবাদিককে মাথায় গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। যে যুদ্ধের অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু ছিল না, এটা ছিল সুনির্দিষ্ট হত্যাকাণ্ড বা ‘টার্গেটেড কিলিং’। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর নতুন করে যুদ্ধ শুরুর পর এই সংবাদকর্মীদের ওপর সুনির্দিষ্ট হত্যাকাণ্ড এখন নির্বিচার হত্যাকাণ্ডে রূপ নিয়েছে। যার সব শেষ উদাহরণ সাংবাদিকদের তাঁবুতে বোমা হামলা।
আইডিএফ’এর নির্বিচার হত্যাযজ্ঞে খুব সম্ভবত গাজার কোনো ভবন এখন আর অক্ষত নেই। আধুনিক সভ্যতায় ইসরায়েলি বর্বরতায় একটি উপত্যকা রীতিমতো আদিম যুগের ‘তাঁবুর শহর’-এ পরিণত হয়েছে। তাই বর্তমানে এই মৃত্যু উপত্যকায় দায়িত্ব পালনরত সাংবাদিকরাও রাত পার করছেন তাঁবুতে। কিন্তু সেই তাঁবুও রক্ষা পেল না। ৭ এপ্রিল ২০২৫ খান ইউনিসের নাসের হাসপাতালের সামনে আক্রান্ত হয় সাংবাদিকদের তাঁবু।
স্থানীয় গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, রাত ২টার সময় ইচ্ছাকৃত এই হামলায় সাংবাদিক হেলমি আল-ফাকাওয়ি ও ইউসেফ আল-খাজিনদার নামের এক ব্যক্তি নিহত হন।
আল-কুদস নেটওয়ার্কের ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, ইসরায়েলি হামলায় দাউদাউ করে জ্বলছে সাংবাদিকদের তাঁবু। যাতে জীবন্ত দগ্ধ হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন সাংবাদিক হেলমি আল-ফাকাওয়ি। ফিলিস্তিনের সংবাদ সংস্থা ওয়াফা এর তথ্য অনুযায়ী, এই হামলায় আহত হয়েছেন আর ৬ জন সাংবাদিক। যাদের অবস্থা গুরুতর। সাংবাদিক আহমেদ মনসুর শরীরে পোড়া ক্ষত নিয়ে মৃত্যুর সাথে যুদ্ধ করছেন।
ইচ্ছাকৃত লক্ষ্যবস্তু সংবাদকর্মীরা
আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী যুদ্ধ বা সংঘাত কবলিত এলাকায় সাংবাদিকদের লক্ষ্য করে আক্রমণ চালানো যায় না। এটা গুরুতর অপরাধ। কিন্তু এই ঘৃণ্য অপরাধই ইসরায়েলিরা করে আসছে গাজা ভূ-খণ্ডে।
রিপোর্টার্স উইআউট বর্ডার (আরএসএফ) এক তথ্যচিত্রে দেখিয়েছে, ২০২৪ সাল পর্যন্ত আইডিএফ সেনারা ৩৫টি ঘটনায় ইচ্ছাকৃতভাবে সাংবাদিকদের হামলা চালিয়েছে। যাতে অনেক সাংবাদিক ও সংবাদকর্মী হতাহত হয়েছেন।
যুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ে কাজ করা গবেষণা প্রতিষ্ঠান কস্টস অব ওয়ার (Costs of War)-এর সাংবাদিক অ্যান্টনি লোভেনস্টাইন (Antony Loewenstein) বলছেন, ইসরায়েল ইচ্ছাকৃতভাবে সাংবাদিকদের হত্যা করছে।
চলতি সংঘাতে গাজা উপত্যকায় হত্যাকাণ্ডের শিকার সাংবাদিক ও সংবাদকর্মীর সংখ্যা ১০০ বছরের সব সংঘাত ও যুদ্ধের সমন্বিত সংখ্যার চেয়েও বেশি। তিনি আরও জানিয়েছেন, এটা যুদ্ধাপরাধ। ইসরায়েলিরা ফিলিস্তিনি ছাড়া ফিলিস্তিন চায়। তাই তারা প্রক্রিয়াগতভাবে এই শহরকে ধ্বংস করছে, নির্বিচার মানুষ হত্যা করছে।
তারপরও সংবাদকর্মীদের তাদের কাজ থেকে বিরত রাখতে পারেনি। দিন-রাত মৃত্যু ঝুঁকি নিয়ে তারা বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরছেন এক বর্বর হত্যাযজ্ঞের খবর। বোমা বৃষ্টির মধ্যে আহত হয়ে, অঙ্গ হারিয়ে, আগুনে পুড়ে এই সংবাদকর্মীরা মানবতায় দায় বহন করে চলছেন।
অতল শ্রদ্ধা নিবেদিত প্রাণপ্রিয় সাংবাদিক ও সংবাদকর্মীদের প্রতি, যারা ‘হোয়াইট কলার জব’ এর হাতছানি পাশ কাটিয়ে মৃত্যু ঝুঁকির এই মহতী পেশাকে বেছে নিয়েছেন। বিশ্ববাসীকে জানাচ্ছেন ইতিহাসের ঘৃণ্য এক হত্যাযজ্ঞের খবর।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের মানদণ্ডে গাজা উপত্যকায় দায়িত্বরত সংবাদকর্মীদের ওপর ‘ইচ্ছাকৃত আক্রমণ’ এর জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য পশ্চিমা দেশগুলোর ইসরায়েলের ওপর চাপ প্রয়োগ করার কথা ছিল। কিন্তু হায়, সে আরেক আক্ষেপের উপাখ্যান। সে আলোচনা আজ নয়।
রাহাত মিনহাজ ।। সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]