স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় বড় ধরনের পরিবর্তনের প্রস্তাব দিয়েছে সংস্কার কমিশন। তাদের সুপারিশ অনুযায়ী, ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, জেলা পরিষদ, পৌরসভা এবং সিটি কর্পোরেশন পর্যায়ে চেয়ারম্যান ও মেয়র পদে সরাসরি ভোটের ব্যবস্থা বাতিল করা উচিত। পরিবর্তে, শুধুমাত্র সদস্য ও কাউন্সিলর পদে সরাসরি ভোট হবে এবং তাদের মধ্য থেকেই পরবর্তী ধাপে চেয়ারম্যান ও মেয়র নির্বাচিত হবেন।
রোববার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. তোফায়েল আহমেদের নেতৃত্বে প্রতিনিধি দল অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বাসভবন ‘যমুনা’য় গিয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন হস্তান্তর করেন। প্রায় পাঁচশ পৃষ্ঠার ওই প্রতিবেদনে ৫১টি গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ রয়েছে। হস্তান্তরের সময় কমিশনের সব সদস্য উপস্থিত ছিলেন। এরপর রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বিস্তারিত তুলে ধরেন ড. তোফায়েল আহমেদ ও অন্যান্য সদস্যরা।
তোফায়েল আহমেদ বলেন, মূল সংস্কার ছাড়া কোনো নির্বাচনই কার্যকর হবে না-হোক সেটা স্থানীয় সরকার নির্বাচন কিংবা জাতীয় সংসদের। সংসদ না স্থানীয় সরকার নির্বাচন-কোনটি আগে হবে, তা নির্ধারণের ভার রাজনৈতিক দল ও সরকারের ওপর।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে স্থানীয় সরকার বলতে যেসব প্রতিষ্ঠান রয়েছে-তাত্ত্বিকভাবে সরকার বললেও বাস্তবে কোনো কার্যকর প্রশাসনিক কাঠামো নেই। বরং উপনিবেশিক যুগের শাসনপদ্ধতির ধারায় এ ব্যবস্থাগুলো এখনো পরিচালিত হচ্ছে, যা স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক কাঠামোর সঙ্গে সাংঘর্ষিক। কিন্তু এটা হওয়া উচিত রাষ্ট্রের ক্ষুদ্রতম গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান।
কমিশনের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, পাঁচটি স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের জন্য একটি অভিন্ন আইন প্রণয়ন করা উচিত। নির্বাচনে ভোটাররা শুধুমাত্র সদস্য বা কাউন্সিলরদের নির্বাচন করবেন। এরপর তারাই নিজেদের মধ্য থেকে সভাপতি, চেয়ারম্যান ও মেয়র নির্ধারণ করবেন।
এছাড়া চেয়ারম্যান বা মেয়রেরা তাদের সাথে সার্বক্ষণিক কাজ করার জন্য কয়েকজনকে বেছে নেবেন। সার্বক্ষণিক কাজের জন্য নিযুক্ত সদস্য বা কাউন্সিলরদের বেতন আলাদা হবে। আর বাকিরা সার্বক্ষণিক হিসেবে কাজ করবেন না। যারা সার্বক্ষণিক কাজ করবেন না, এ রকম পদে সরকারি বা বেসরকারি চাকরিজীবীরাও নির্বাচন করতে পারবেন।
জাতীয় সংসদের প্রতিরূপ স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোতে সৃষ্টি করার জন্য এই সুপারিশ করা হয়েছে। এজন্য এই পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের আলাদা আলাদা আইনকে এক করে একটি আইন করার সুপারিশ করা হয়েছে।
এছাড়া ইউনিয়ন পরিষদের তিনটি ওয়ার্ড থাকবে, যেখানে শুধু নারীরা নির্বাচন করবেন। বর্তমানের মতো নয়টি ওয়ার্ডকে তিনভাগে ভাগ করে নয়। বর্তমান ব্যবস্থায় নারীরা নির্বাচিত হলেও কোনো কাজ করতে পারেন না। উপজেলা পরিষদের কাঠামো পরিবর্তন এবং জেলা পরিষদে নির্বাচনের ব্যবস্থা চালু করার সুপারিশ করা হয়েছে।
ইউনিয়ন পরিষদে জনসংখ্যার ভিত্তিতে ওয়ার্ড সংখ্যা বাড়িয়ে ৩৯টি পর্যন্ত করার সুপারিশ করা হয়েছে। তবে সর্বনিম্ন ওয়ার্ড ৯টিই থাকবে।
তোফায়েল আহমেদ বলেন, নির্বাচন মানে অস্থিরতা, অশান্তি, বিশৃঙ্খলা, হতাহত। এজন্য আলাদা আলাদা নির্বাচন না করে একসাথে যাতে সব স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের নির্বাচন করা যায়, সেই সুপারিশ করা হয়েছে। মাত্র ৪০ দিনের একটি শিডিউলে ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলা, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনের নির্বাচন করা সম্ভব।
তিনি বলেন, বর্তমানে এসব প্রতিষ্ঠানের নির্বাচনে ২২৫ দিন লাগে। খরচ হয় ২ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। একটি শিডিউলে খরচ নেমে আসবে ৭০০ কোটি টাকায়। আর এসব নির্বাচন অনুষ্ঠানে ১৯ লাখ জনবল নিয়োগ করতে হয়। একটি শিডিউলে করলে মাত্র ৯ লাখ জনবল নিয়োগ করে করা যাবে। ফলে এই সুপারিশ বাস্তবায়নের বিবেচনার দাবি রাখে।