১৯৭৯ সালের সালের ১ মার্চ ‘সিনিয়র সার্ভিস পুল’ গঠন করে পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি)। একটি পরীক্ষার মাধ্যমে মেধার ভিত্তিতে এই পুলে উপসচিব থেকে সচিব পদে নিয়োগ দেওয়া হয়।
তাত্ত্বিকভাবে মেধাভিত্তিক সিভিল সার্ভিস গঠনে এসএসপি সহায়ক এরকম যুক্তিতে অনেককেই এসএসপি নিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে দেখা যায়। অনেকে বলে থাকেন, এতে এই পুলের মাধ্যমে নিয়োগ হলে সিভিল সার্ভিসে বৈষম্য দূর হবে ও মেধাভিত্তিক সিভিল সার্ভিস নিশ্চিত হবে। কিন্তু বাস্তবতা কি তাই? বাস্তবে দেখা যায়, এসএসপির ধারণা একই সাথে তাত্ত্বিকভাবেই ত্রুটিপূর্ণ এবং ব্যবহারিকভাবে অত্যন্ত অকার্যকর। সে কারণে পুরো ব্যবস্থাটি পর্যালোচনা করার জন্য ১৯৮৭ সালে তৎকালীন উপ প্রধানমন্ত্রী ডা. এম এ মতিনকে আহ্বায়ক করে সিনিয়র সার্ভিস পুলের গঠন কাঠামো পর্যালোচনা করার জন্য একটি মন্ত্রিপরিষদ উপ-কমিটি (মতিন কমিটি) গঠন করা হয়। এই কমিটি প্রায় দুই বছর ধরে পর্যালোচনা শেষে সব ক্যাডারের ঐকমত্যের ভিত্তিতে ১৯৮৯ সালে এসএসপি বাতিলের সুপারিশ করে।
প্রশ্ন হলো, ১৯৭৯ সালে গঠনের ১০ বছরেও কেন এই সুপারিশ বাস্তবায়ন না করে বাতিল করতে হলো? কেন মতিন কমিটি এটি বাতিলের সুপারিশ করল এবং কেনইবা সব ক্যাডার এসএসপি বাতিলের সুপারিশে সম্মত হলো?
এই বিষয়ে আলোকপাত করতে গিয়ে মতিন কমিটি তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন, “১ মার্চ ১৯৭৯ তারিখে পুল গঠিত হলেও বর্তমানে (১৯৮৯) পুলভুক্ত ৩৬০ জন উপসচিবের মধ্যে ৩৩৩ জনই পরীক্ষা ব্যতিরেকেই উপসচিব পদে পুলে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। পুলে প্রবেশ পদে নিয়োগের শর্ত বার বার শিথিল করে বিনা পরীক্ষায় অতীতে উপসচিব নিয়োগ করায় প্রথমবারের মতো পরীক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে উপসচিব পদে নিয়োগে অনেক বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। তাছাড়া নিয়মিত পরীক্ষা না হওয়ায় এখন অধস্তন কর্মকর্তা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সংগে একই পদের জন্য পরীক্ষায় অবতীর্ণ হওয়ার সুযোগ পেলে প্রশাসনিক জটিলতা সৃষ্টি হবে।”
প্রশাসনিক জটিলতার বাইরেও এসএসপি বাস্তবায়নের বাঁধা হিসেবে বিভিন্ন ক্যাডারের কর্মের ধরন ভিন্ন হওয়ায় তাদের মূল্যায়নে স্ট্যান্ডার্ড পরীক্ষা প্রণয়নে নৈর্ব্যক্তিক মানদণ্ডের অভাব, পুলভুক্তির পরে পদমর্যাদা ও জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণ সংক্রান্ত জটিলতা ইত্যাদি বিষয়কেও তুলে আনা হয়। মতিন কমিটি তাদের প্রতিবেদনে এসএসপি বাতিল হলে কী উপায়ে উপসচিব পদে নিয়োগ প্রদান করা হবে তারও একটি রূপরেখাও প্রণয়ন করেন। সেখানে কমিটি প্রতিটি ক্যাডারের জনশক্তি, কাজের প্রকৃতি, উচ্চতর বেতন স্কেল ও নিজস্ব ক্যাডারে উচ্চতর পদে পদোন্নতির সুযোগ ইত্যাদি বিষয়ে বিবেচনায় এনে উপসচিব ও যুগ্মসচিব পদে বিভিন্ন ক্যাডারের কোটা প্রবর্তনের বিষয় সুপারিশ করেন যাতে সব ক্যাডার ঐকমত্য পোষণ করেন। আলোচনায় বলা হয়, তদানীন্তন পাকিস্তানে কেন্দ্রীয় সচিবালয়ে অন্তত দুই তৃতীয়াংশ পদ সিএসপি (বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের সমতুল) এর জন্য সংরক্ষিত ছিল। এছাড়া, কেন্দ্রীয় সচিবালয় সার্ভিস বা সচিবালয় ক্যাডার যা ১৯৯২ সালে বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের সাথে একীভূত হয় তাদের জন্যেও পাকিস্তান আমলে সংরক্ষিত কোটার মতোই উপসচিব পদে ১৪ শতাংশ কোটা রাখার প্রস্তাব করা হয়। এতে করে, বিসিএস প্রশাসন ও সচিবালয় ক্যাডার মিলে মোট কোটা হয় ৮০ শতাংশ। এই কোটা মূলত প্রশাসন ক্যাডারের জনবল ও পদোন্নতিতে যাতে বৈষম্যের শিকার না হয় সেই বিবেচনায় রাখা হয়। একই সাথে, অনুরূপ কোটা অন্যান্য ক্যাডারের প্রতিও সুবিচার করবে বলেই অন্য ক্যাডার কর্মকর্তারা একমত হন।
মূলত এসব জটিলতার কারণেই সিনিয়র সার্ভিস পুল বাতিল করা হয় যেসব জটিলতার বাস্তবতা এখনো সমভাবে বিদ্যমান। উপরন্তু, বিসিএস পরীক্ষায় খুব অল্প কিছু ব্যতিক্রম বাদে প্রায় সবাই পররাষ্ট্র, প্রশাসন ও পুলিশ ক্যাডার প্রথম চয়েস দেন। চয়েস দেওয়ার পর যারা মেধায় এগিয়ে থাকেন তারাই মূলত প্রশাসন ক্যাডার পান। ২০১৮ সালে বিসিএস পরীক্ষায় কোটা বাতিলের পর এই মেধাভিত্তিক নিয়োগ প্রায় শতভাগ নিশ্চিত হয়। ফলে, বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডার থেকে উপসচিব নিয়োগ প্রায় শতভাগ মেধাভিত্তিক।
কেন তাত্ত্বিকভাবে এসএসপি ত্রুটিপূর্ণ?
এসএসপির ধারণা কিছু মূলনীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত। সব সার্ভিসের মেধাবী অফিসার নিয়ে গঠিত এসএসপি হবে একটি এলিট ক্যাডার যারা তাদের মূল ক্যাডার সত্তার বাইরে গিয়ে নীতি নির্ধারণে কাজ করবে। এর ফলে আন্তঃক্যাডার গতিশীলতা বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু এই ধারণা ও তত্ত্বের কিছু গুরুত্বপূর্ণ সীমাবদ্ধতা রয়েছে।
যেমন ১। আমলাতন্ত্রের ওয়েবারিয়ান মডেলের দুইটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য আমলাদের নির্ধারিত ক্যারিয়ার পথ এবং বিশেষায়িত দক্ষতার ব্যবহার। এসএসপি কাঠামো এই দুটি মূলনীতির সাথে সাংঘর্ষিক যেখানে সম্পূর্ণ ভিন্ন ক্যারিয়ার পথের একজন কর্মকর্তাকে যেমন শিক্ষা, কৃষি বা স্বাস্থ্য ক্যাডারের কাউকে পলিসিমেকিং-এ নিয়ে আসা হচ্ছে যার মাধ্যমে একদিকে প্রশাসন ক্যাডার যাদের মূল ক্যারিয়ার পথ উপসচিব তাদের কর্ম অভিজ্ঞতা থেকে অর্জিত জ্ঞান ও প্রশিক্ষণ অপচয় হচ্ছে এবং অপরদিকে অন্যান্য ক্যাডার কর্মকর্তাদের নিজস্ব ক্যারিয়ার পথেও মেধাবী কর্মকর্তারা হাঁটতে পারছে না। ফলে, ক্যাডার কর্মকর্তাদের বিশেষায়িত দক্ষতা অব্যবহৃত থেকে যাচ্ছে। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের মাঠ প্রশাসনে সব পলিসি সমন্বয়ের কাজ করতে হয় এবং তারা আইন ও প্রশাসনের প্রশিক্ষণ পান। ফলে, পলিসি প্রণয়নের জন্য প্রয়োজনীয় যে অভিজ্ঞতা সেটি অন্য সব ক্যাডারের চেয়ে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের বেশি। একারণেই, পাকিস্তান, ভারত ও শ্রীলঙ্কায় প্রশাসন ক্যাডারের অনুরূপ সার্ভিস/ক্যাডার থেকেই উপসচিব পদে পদায়ন করা হয়। এসএসপি কাঠামোতে এই বিশেষায়িত জ্ঞানকে উপেক্ষা করা হচ্ছে যা ওয়েবারিয়ান আমলাতন্ত্রের মূল বৈশিষ্ট্যের সাথে সাংঘর্ষিক।
২। এসএসপির মাধ্যমে যে এলিট ক্যাডার সৃষ্টি হবে তাদের মধ্যে বিশেষায়িত দক্ষতার অনেক কর্মকর্তা থাকবে যাদের মধ্যে সাধারণ প্রশাসনিক দক্ষতার অভাব থাকার সম্ভাবনা আছে। জেনারেলিস্ট ও স্পেশালিস্টদের এই পার্থক্যের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েই সারা পৃথিবীতেই নীতি প্রণয়নের নানা পদে স্পেশালিস্টদের চেয়ে জেনারেলিস্টদের প্রাধান্য দেওয়া হয়। জেনারেলিস্টরা তাদের কর্ম অভিজ্ঞতার কারণেই পলিসির রাজনৈতিক, সামাজিক ও আইনি দিক, অন্যান্য পলিসির সাথে সংযোগ, পলিসির বাস্তবায়নযোগ্যতা ইত্যাদি বিষয়ে স্পেশালিস্টদের চেয়ে সাধারণত এগিয়ে থাকেন। এসএসপি কাঠামোর মাধ্যমে স্পেশালিস্টদের পলিসি তৈরির ক্ষেত্রে প্রাধান্য দেওয়ার সুযোগ তৈরি করছে যা অদক্ষ ও অনভিজ্ঞ আমলাতন্ত্র তৈরি করতে পারে। যারা জেনারেলিস্ট যেমন বাংলাদেশে বিসিএস প্রশাসন ক্যাডার তারা পলিসি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন দুটো কাজের সাথেই জড়িয়ে থাকে। মাঠের অভিজ্ঞতার কারণে পলিসি আইডিয়া, প্রস্তাব বিশ্লেষণ ও সমন্বয় করা তাদের জন্য সহজ হয়। প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা সরকারের নির্বাহী বিভাগের খুঁটি উপজেলা নির্বাহী অফিসার, জেলা প্রশাসক ও বিভাগীয় কমিশনার হিসেবে মাঠ প্রশাসনে সরকারের সব কাজের ফোকাল পয়েন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সেটি করতে গিয়ে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের মধ্যে সব পলিসি নিয়ে একটি ৩৬০ ডিগ্রি অন্তর্দৃষ্টি তৈরি হয় যা পলিসি সমস্যা চিহ্নিতকরণ, সীমাবদ্ধতা সম্বন্ধে ধারণা লাভ ও বাস্তবায়ন চ্যালেঞ্জ খুঁজে বের করতে প্রয়োজন।
৩। ওয়েস্টমিনিস্টার পদ্ধতির সংসদীয় গণতন্ত্রে স্থায়ী প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীর যে রূপরেখা তার সাথেও এসএসপি সাংঘর্ষিক।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট ও আদর্শ আমলাতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় এসএসপি একটি পরীক্ষিত ব্যর্থ মডেল। নানা ক্যাডারের কর্মের ধরন, প্রশিক্ষণ ও ব্যস্ততা ভিন্ন হওয়ায় তাদেরকে এক পাত্রে নিয়ে এসে এলিট ক্যাডার সৃষ্টির প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়াই অস্বাভাবিক। তাত্ত্বিকভাবেও এটি অসংলগ্ন একটি ব্যবস্থা। যেসব লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করার জন্য এই পদ্ধতি প্রণয়ন করা হয়েছিল যেমন পলিসিমেকিং পদে মেরিটোক্রেসি নিশ্চিত করা এবং ক্যাডার গতিশীলতা বাড়ানো সেসব লক্ষ্যমাত্রা অন্য পদ্ধতি যেমন পার্শ্ব নিয়োগের সুযোগ, বিসিএস পরীক্ষায় কোটা বিলোপ করা ইত্যাদি ব্যবহার করে নিশ্চিত করা সম্ভব।
মুহাম্মদ মুছাব্বেরুল ইসলাম : অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, মুন্সীগঞ্জ