41266

08/24/2025 দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে আসা তৃষ্ণা রানী এখন ‘গোলমেশিন’!

দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে আসা তৃষ্ণা রানী এখন ‘গোলমেশিন’!

স্পোর্টস ডেস্ক

২৩ আগস্ট ২০২৫ ১৫:৫৩

দিনমজুর বাবার ঘামে ভেজা গা, মায়ের না খেয়ে থাকা দিন—এমন কষ্টের গল্প নিয়েই বড় হয়েছেন পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার ভাসাইনগর গ্রামের মেয়ে তৃষ্ণা রানী। অভাব-অনটনের সংসার, অন্যের জমিতে ছোট্ট একটি ঘর। কিন্তু সেই সীমাবদ্ধতা কখনও আটকে রাখতে পারেনি তাকে। ছোটবেলা থেকেই তার স্বপ্ন ছিল ফুটবল মাঠে ছুটে চলা, গোল করা এবং দেশকে জয় এনে দেওয়া।

শুরুটা ছিল কঠিন। খেলার সামগ্রী কেনার মতো সামর্থ্যও ছিল না, অনেক সময় খালি পেটে অনুশীলন করেছেন তৃষ্ণা। তবুও থেমে যাননি। কারণ তার পাশে ছিলেন একাডেমি পরিচালক মোফাজ্জল হোসেন বিপুল, যিনি এই মেয়েকে নিজের স্বপ্নের মতো লালন করেছেন। আজ সেই তৃষ্ণা রানী বাংলাদেশের নারী ফুটবলের অন্যতম উজ্জ্বল নাম। সাফ অনূর্ধ্ব-২০ নারী চ্যাম্পিয়নশিপে ভুটানের বিপক্ষে জোড়া গোল ও লাওসের বিপক্ষে দুর্দান্ত হ্যাটট্রিক করে তিনি আলোচনায় এসেছেন।

গোলের পর গোল করে তৃষ্ণা হয়ে উঠেছেন দেশের ক্রীড়ামোদীদের চোখে ‘গোলমেশিন’। ২০২২ সালে সাফ অনূর্ধ্ব-১৫ টুর্নামেন্টে প্রথম বাংলাদেশ জাতীয় দলে সুযোগ পান তিনি। এরপর ২০২৩ সালে সাফ অনূর্ধ্ব-১৭ চ্যাম্পিয়নশিপে রানারআপ হয়েছেন। ওই প্রতিযোগিতায় ভুটানের বিপক্ষে করেন ২টি গোল। এএফসি অনূর্ধ্ব-১৭ টুর্নামেন্টে তুর্কমেনিস্তানের বিপক্ষে এক গোল। ২০২৪ সালে সাফ অনূর্ধ্ব-১৯ চ্যাম্পিয়নশিপেও ভুটানের বিপক্ষে এক গোল করেন তৃষ্ণা।

২০২৪ সালে সাফ অনূর্ধ্ব-২০ চ্যাম্পিয়নশিপে নেপালের বিপক্ষে শেষ মিনিটে গোল করে দলকে ফাইনালে তোলার পর তৃষ্ণা চ্যাম্পিয়ন তকমাও পেয়েছেন। ওই টুর্নামেন্টে ভুটানের বিপক্ষে দুটি ও শ্রীলঙ্কার বিপক্ষেও একটি গোল করেন পঞ্চগড়ের এই মেয়ে। এএফসি অনূর্ধ্ব-২০ কোয়ালিফায়ারে পূর্ব তিমুরের বিপক্ষে দুর্দান্ত হ্যাটট্রিক ও দক্ষিণ কোরিয়ার বিপক্ষেও রয়েছে একটি গোল।

তৃষ্ণার জীবনের প্রতিটি সাফল্যের পেছনে লুকিয়ে আছে ত্যাগের গল্প। সেই স্মৃতি হাতড়ে তিনি বলেন, ‘যতদূর এসেছি, এর পেছনে একাডেমির পরিচালক মোফাজ্জল হোসেন বিপুলের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। আমাদের ঘরটি আগে বসবাসের উপযোগী ছিল না। পরবর্তীতে জেলা প্রশাসক সেটি সংস্কার করে দেন। তবে জমিটি আমাদের নিজস্ব নয়। এ অবস্থায় সরকারের প্রতি অনুরোধ— যেন আমাদের জন্য একটি জমি কিনে সেখানে বসবাসযোগ্য ঘর করে দেওয়া হয়।’

তার মা সুনিলা রাণীও একই আর্জি জানিয়েছেন, ‘দিনমজুরের কাজ করে সংসার চলে। কিছুই নাই আমাদের। সরকারের কাছে চাই, অন্তত তৃষ্ণার জন্য জমিসহ একটি ঘরের ব্যবস্থা হোক।’ বাবা উমেস বর্মনের কণ্ঠে গর্বের সঙ্গে দুঃখও মিশে আছে, ‘আমি ইটভাটায় কাজ করি। খুব কষ্টে সংসার চালাই। অন্যের জমিতে থাকি আমরা। আমার মেয়ে দেশের হয়ে খেলছে বিদেশে। সরকারের কাছে আমার দাবি—আমাদের একটু জমি দিয়ে একটি ঘরের ব্যবস্থা করে দিলে মেয়েকে নিয়ে থাকতে পারব।’

দুর্দশার মাঝেই তৃষ্ণা অনুশীলন ও প্রস্তুতি নিয়েছেন ‍বলে উল্লেখ করেন তার বাবা, ‘অভাব-অনটনের কারণে আগে সে মাঠে যেতে পারত না, অনেক কষ্টে হাটে যেত। আমি তাকে খরচ দিতে পারিনি। অনেক সময় না খেয়েও প্র্যাকটিস করেছে। বিপুল (বোদা ফুটবল একাডেমির পরিচালক) ভাইয়ের সহযোগিতায় আজ এই পর্যায়ে এসেছে। আমার মেয়ে দেশের জন্য নাম করছে, এজন্য সকলের কাছে দোয়া চাই। সরকারের কাছে অনুরোধ– আমাদের দিকটা যেন দেখে।’

গ্রামের মানুষ এখন তৃষ্ণাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে। যে মেয়েকে একসময় খেলতে দিতে চাইত না পরিবার, বিয়ের কথাই ভাবত– সেই মেয়েই আজ জাতীয় দলের ভরসা। খেলা থাকলে গ্রামজুড়ে উৎসবের আমেজ ছড়িয়ে পড়ে। সেই প্রসঙ্গ টেনে তার চাচা সুরেশ চন্দ্র বর্মন বলেন, ‘আমরা এখন গর্ব করি। যখন জানি সে খেলছে, তখন কাজ বাদ দিয়ে টিভি বা মোবাইলে খেলা দেখি।’

বোদা ফুটবল একাডেমির পরিচালক মোফাজ্জল হোসেন বিপুল জানান, ‘আমরা ২০১৮ সাল থেকে মেয়েদের নিয়ে কাজ শুরু করি। তখন অনেক প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়তে হয়েছে। অনেক অভিভাবক মেয়েদের খেলতে দিতে চাইতেন না, বিয়ের অজুহাত দিতেন। তবুও আমরা এগিয়ে গেছি। এখন আমাদের একাডেমি থেকে প্রায় ৬ জন খেলোয়াড় বাংলাদেশ জাতীয় দলের বিভিন্ন বয়সভিত্তিক দলে খেলছে। এর মধ্যে তৃষ্ণা রানী অন্যতম। তৃষ্ণা নিজস্ব ঘরবাড়ি ছাড়াই এতদূর এসেছে।হ্যাটট্রিক করে দেশকে জয় এনে দিয়েছে সে। এটি আমাদের সবার জন্য গর্বের।’

সব কষ্ট পেছনে ফেলে এখন তৃষ্ণা রানীর একটাই স্বপ্ন– বাংলাদেশের হয়ে আরও গোল করা, আরও জয় এনে দেওয়া। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের নাম উজ্জ্বল করা। তৃষ্ণা প্রমাণ করেছেন স্বপ্নের কাছে দারিদ্র্যতা বাধা হতে পারে না! এবার ছুটতে চান আরও স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে।

এসএন/রুপা

সম্পাদক: মো. জেহাদ হোসেন চৌধুরী
যোগাযোগ: রিসোর্সফুল পল্টন সিটি (১১ তলা) ৫১-৫১/এ, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০।
মোবাইল: ০১৭১১-৯৫০৫৬২, ০১৯১২-১৬৩৮২২
ইমেইল: [email protected], [email protected]