সোমবার, ১৬ই জুন ২০২৫, ১লা আষাঢ় ১৪৩২

Shomoy News

Sopno


ব্যাংকিং খাত ও পুঁজিবাজারে নবজাগরণ


প্রকাশিত:
১৫ জুন ২০২৫ ১৫:৫৮

আপডেট:
১৬ জুন ২০২৫ ০০:২৭

ছবি সংগৃহীত

এক সময় যে দেশের অর্থনীতির চালচিত্র হতাশার মেঘে ঢাকা ছিল, এখন সেই আকাশে উঁকি দিচ্ছে আশার সূর্য। দীর্ঘ সময়ের চ্যালেঞ্জ, বৈশ্বিক মন্দার ধাক্কা ও অভ্যন্তরীণ দুর্বলতাকে পাশ কাটিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। বিশেষ করে ব্যাংক খাত ও পুঁজিবাজারে যে রকম সংস্কারের হাওয়া লেগেছে, তাতে আগামীর অর্থনৈতিক ভিত্তি আরও মজবুত হবে বলেই ধারণা করছেন অর্থনীতিবিদেরা।

ব্যাংকিং খাতে নীতির হাওয়া বদল: ভরসার বার্তা

সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক একটি গুরুত্বপূর্ণ সার্কুলার জারি করেছে, যেখানে সুপরিচালিত ব্যাংকগুলো—যাদের শ্রেণিকৃত ঋণ ৫ শতাংশের নিচে—তাদের উচ্চতর লভ্যাংশ প্রদানের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এই নীতিগত পরিবর্তনের ফলে গ্রাহকদের মধ্যে ব্যাংকের প্রতি আস্থা বাড়বে, বাড়বে আমানতের প্রবাহও। যারা দীর্ঘদিন ধরে ব্যাংকিং খাতের শৃঙ্খলার ঘাটতিতে হতাশ ছিলেন, তাদের জন্য এটি স্বস্তির সংবাদ।

সাম্প্রতিককালে যেসব ব্যাংক অর্থনৈতিক দিক থেকে ভালো করছে, তারা এখন ৩০-৫০ শতাংশ পর্যন্ত ডিভিডেন্ড দিতে পারবে, যা আগে সীমাবদ্ধ ছিল সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ নীতি মূলত 'গুড গভার্নেন্স' প্রতিষ্ঠার চেষ্টা, যেখানে ভালো পারফর্ম করা ব্যাংকগুলো পুরস্কৃত হচ্ছে।

ঋণ ও সুদের নীতি: পুরনো সূত্রে নতুন সংশয়

ক্লাসিক্যাল অর্থনীতির সূত্রমতে, উচ্চ সুদের হার চাহিদা কমিয়ে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে। তবে বাস্তবতা বলছে, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল অর্থনীতিতে এই সূত্র খুব একটা কার্যকর নয়। ২০২৩ সালে দেশের রেপো রেট দাঁড়ায় ১০ শতাংশের ওপরে, যা তিন-চার দশকে দেখা যায়নি। বিনিয়োগ খরচ বেড়ে যাওয়ায় ব্যবসায়ীরা নতুন প্রকল্পে হাত দিতে সাহস পাননি। বিনিয়োগের ধীরগতি সরাসরি প্রভাব ফেলেছে উৎপাদন, কর্মসংস্থান ও প্রবৃদ্ধির ওপর।

তবে সাম্প্রতিক মাসগুলোয় কিছুটা স্বস্তির ইঙ্গিত মিলছে। ট্রেজারি বন্ডের সুদ কমছে। বাজার বিশেষজ্ঞদের মতে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ভবিষ্যতে মুদ্রানীতি কিছুটা নমনীয় করতে পারে, যাতে করে ব্যবসায়িক কার্যক্রমে গতি ফেরে।

রেমিট্যান্স ও রপ্তানি: প্রবাহ বাড়ছে, আশাও বাড়ছে

বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশিরা দেশের অর্থনীতিতে প্রাণসঞ্চার করে চলেছেন। রেমিট্যান্স প্রবাহ মাসিক ২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে এখন পৌঁছেছে আড়াই বিলিয়নে। এর পেছনে হুন্ডি রোধ, ব্যাংকিং চ্যানেলের উন্নয়ন ও সরকার প্রদত্ত প্রণোদনার ভূমিকা উল্লেখযোগ্য।

একইভাবে, রপ্তানি আয়ে দেখা যাচ্ছে চাঙ্গাভাব। ইউরোপ ও আমেরিকার বাজারে তৈরি পোশাকের পাশাপাশি চামড়া, ওষুধ, কৃষিপণ্যও ভালো করছে। কিছু নির্দিষ্ট বাজারে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ৩০-৬০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। এই দুই খাত অর্থনীতির ভিত্তিমূল, যা সামগ্রিকভাবে রিজার্ভ পুনর্গঠনে সহায়ক।

শেয়ারবাজারে বাস্তব বিনিয়োগের উত্থান

এক সময়ের জুয়া নির্ভর শেয়ারবাজার এখন ধীরে ধীরে ফিরে পাচ্ছে মূলধারার বিনিয়োগকারীদের। দৈনিক গড় লেনদেন যেখানে ১১০০ কোটি টাকায় পৌঁছেছিল, সেখানে এখন ৪০০-৫৫০ কোটির মধ্যে সীমাবদ্ধ। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো—বর্তমান লেনদেনের ৯০ শতাংশই প্রকৃত বিনিয়োগকারীদের দ্বারা পরিচালিত।

সরকার ইতিমধ্যে প্রণোদনা প্যাকেজ, নতুন আইপিও নীতিমালা ও বিদেশি কোম্পানিকে তালিকাভুক্ত করার বিষয়ে ইতিবাচক বার্তা দিয়েছে। তবে কিছু মৌলিক সমস্যা থেকে যাচ্ছে—মার্জিন লোন ব্যবস্থার অসতর্ক ব্যবহারে অনেক ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী নিঃস্ব হয়েছেন। এ ব্যবস্থা পুরোপুরি বন্ধ না করে রেশিও সীমিত করে নিয়ন্ত্রণে আনা প্রয়োজন।

বিদেশি কোম্পানির তালিকাভুক্তি ও প্রাইভেটাইজেশনের আহ্বান

গ্রামীণফোন, বার্জার পেইন্টস, রবি, মেরিকোর মতো বহুজাতিক কোম্পানিগুলো এক সময় প্রণোদনার মাধ্যমে তালিকাভুক্ত হয়েছে। কিন্তু এখন কর্পোরেট ইনকাম ট্যাক্সে ছাড় না থাকায় মেট লাইফ, নেসলে, স্ট্যান্ডার্ড চ্যাটার্ডের মতো প্রতিষ্ঠানরা বাজারে আসতে আগ্রহী নয়। অথচ এরা ভারতের মুম্বাই কিংবা পাকিস্তানের করাচিতে স্টক মার্কেটে তালিকাভুক্ত।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশেও যদি করছাড় কিংবা ফিসকাল প্রণোদনা দেওয়া হয়, তাহলে এ ধরনের গ্লোবাল ব্র্যান্ডগুলো অন্তত ১০ শতাংশ শেয়ার অফলোড করতে আগ্রহী হবে।

একইভাবে, সরকার নিজস্ব মালিকানাধীন ইউনিলিভার বাংলাদেশ, ইস্টার্ন কেবলস, ওসমানি গ্লাসের মতো কোম্পানিগুলোর শেয়ার বাজারে ছাড়া শুরু করতে পারে। এতে সরকার রেভিনিউ ঘাটতি মেটাতে বিকল্প উৎস পাবে এবং বাজারে ভালো কোম্পানির সরবরাহ বাড়বে।

উপসংহার: পথটা কঠিন হলেও সম্ভাবনার আকাশ উন্মুক্ত

বাংলাদেশের অর্থনীতি একটি সংকট থেকে পুনরুদ্ধারের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। চ্যালেঞ্জ রয়েছে, সন্দেহ নেই—কিন্তু সম্ভাবনার দিগন্তও প্রসারিত হচ্ছে। রেমিট্যান্স, রপ্তানি, ব্যাংকিং ও বিনিয়োগ—এই চার খাতে যদি সুশাসন, স্থিতিশীল নীতি ও টেকসই সংস্কার অব্যাহত থাকে, তাহলে অর্থনীতির চাকা শুধুই ঘুরবে না বরং তীব্র গতিতে সামনে এগিয়ে যাবে।

একটি কথা স্মরণযোগ্য—অর্থনীতিতে পুনরুদ্ধার কোনো ম্যাজিক নয়, এটি একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। আর সেই প্রক্রিয়ার গতি এখন শুরু হয়েছে।

মো. সাইফুল ইসলাম মাসুম ।। গবেষক ব্যাংকার ও কলামিস্ট


সম্পর্কিত বিষয়:


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:




রিসোর্সফুল পল্টন সিটি (১১ তলা) ৫১-৫১/এ, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০।
মোবাইল: ০১৭১১-৯৫০৫৬২, ০১৯১২-১৬৩৮২২
ইমেইল : [email protected]; [email protected]
সম্পাদক : লিটন চৌধুরী

রংধনু মিডিয়া লিমিটেড এর একটি প্রতিষ্ঠান।

Developed with by
Top