কোভিড ও ডেঙ্গু রোগী বাড়ছে, আপনি নিরাপদ তো?
প্রকাশিত:
২১ জুন ২০২৫ ১১:০৩
আপডেট:
২১ জুন ২০২৫ ১৩:৫১

কোভিড ও ডেঙ্গুর প্রকোপ একইসাথে বাড়ছে। মৃত্যুও বাড়ছে। প্রতিদিনই বাড়ছে। দেশে বেশ কিছু কোভিড রোগী শনাক্ত হয়েছে। আতঙ্ক ছড়াচ্ছে করোনার নতুন ভেরিয়েন্ট। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের এপ্রিল মাসে দেশে কোভিড আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ২৩ জন। মে মাসে সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৬ জনে। আর জুন মাসের প্রথম আট দিনে আক্রান্ত হয়েছেন ৩৬ জন এবং একজন মৃত্যুবরণ করেছেন।
সরকার আবার সবাইকে মাস্ক পরার অনুরোধ করছে। সাম্প্রতিক এই কোভিড করোনার একটি উপধরন। এ সম্পর্কিত সতর্কতা ও নির্দেশিকাগুলো জানা জরুরি। কোভিড–১৯–এর এই নতুন উপধরন অমিক্রন এক্সবিবি (Omicron XBB) দ্রুত বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ছে।
ভারতসহ পার্শ্ববর্তী কয়েকটি দেশে করোনাভাইরাসের নতুন ধরনের সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় এবং অন্যান্য দেশে ভাইরাসের এই ধরনটি ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কায় নতুন সতর্কতা জারি করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ভারত এবং ভাইরাস ছড়ানো অন্যান্য দেশে ভ্রমণ থেকে বিরত থাকার পাশাপাশি ঝুঁকি মোকাবিলায় সব স্থল ও বিমানবন্দরে হেলথ স্ক্রিনিং ও নজরদারি বাড়াতে বলা হয়েছে।
বলা হচ্ছে, এই রূপটি পূর্ববর্তী রূপগুলোর তুলনায় বেশি সংক্রামক। অনেক ক্ষেত্রে এটি সাধারণ লক্ষণ বা উপসর্গ প্রকাশ করে না, কিন্তু ছড়িয়ে পড়তে থাকে। অমিক্রন এক্সবিবি হলো একটি রিকম্বিন্যান্ট সাবভেরিয়েন্ট, যা দুটি অমিক্রন স্ট্রেনের সংমিশ্রণে গঠিত। উপধরনটি সম্পর্কে যা জানা যাচ্ছে—পূর্ববর্তী রূপগুলোর তুলনায় দ্রুত ছড়াতে পারে। কখনো কখনো প্রচলিত পরীক্ষায় ধরা পড়ে না, মানে ফলস নেগেটিভ টেস্ট আসে।
করোনার সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ডেঙ্গু রোগী। দেশের ৫৮টি জেলায় ডেঙ্গু দেখা দিয়েছে। ২০২৫ সালের জুনে প্রতিদিন ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা আগের দিনের চেয়ে বাড়ছে। চলতি বছরের মার্চ থেকে মে মাস পর্যন্ত প্রতি মাসে ডেঙ্গু বেড়েছে তার আগের মাসের চেয়ে দ্বিগুণ হারে। চলতি জুন মাসের প্রথম ১৫ দিন যত রোগী মশাবাহিত এ রোগে আক্রান্ত হয়েছেন, তা আগের মাসের আক্রান্তের প্রায় সমান। কয়েকদিন ধরে বৃষ্টি হচ্ছে। আর ব্যাপক গরমও পড়েছে। এই রকম পরিস্থিতিতে ডেঙ্গু বাড়ার আশঙ্কা থাকে।
ঘন ঘন বৃষ্টি এবং বাতাসের আর্দ্রতার আধিক্য ডেঙ্গু পরিস্থিতিকে নাজুক করে তুলছে। এবার লক্ষণীয় দিকটি হলো, রাজধানীর চেয়ে দেশের অন্যত্র ডেঙ্গু বিস্তারের পরিমাণ অনেক বেশি। রাজধানীতে মশা নিধনে কিছুটা হলেও একটা ব্যবস্থা আছে; কিন্তু ঢাকার বাইরে তাও নেই। আর এসবই এবারের ডেঙ্গু পরিস্থিতিকে শঙ্কাজনক করে তুলেছে বলে মনে করেন জনস্বাস্থ্যবিদরা।
বছরব্যাপী সারা দেশে এখন থেকে এডিস মশা নির্মূলে পরিবেশগত ব্যবস্থাপনা, জৈবিক ব্যবস্থাপনা, রাসায়নিক নিয়ন্ত্রণ এবং যান্ত্রিক পদ্ধতির সমন্বিত ক্রাশ পরিকল্পনা নিতে হবে। ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিতে এখনই বর্ষার পূর্বেই জোর পদক্ষেপ নিতে হবে।
দেখা যাচ্ছে, কোনো কোনো রোগীর ডেঙ্গু আর কোভিড একসঙ্গেই হয়েছে। তখন চিকিৎসাব্যবস্থা কী হবে, তা নিয়ে তৈরি হচ্ছে দ্বিধাদ্বন্দ্ব। কেউ ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর সেখানে গিয়ে কোভিড–১৯ রোগীর সংস্পর্শে এসে এ রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন।
ডেঙ্গু ও কোভিড দুটোই ভাইরাসজনিত রোগ। তাই দুটোতেই জ্বর হলো প্রথম ও প্রধান উপসর্গ। মাথাব্যথা, শরীরব্যথা, ক্লান্তি, অবসাদও থাকতে পারে। তবে ডেঙ্গুতে মাথাব্যথা, চোখের পেছনে ব্যথা, গায়ে ব্যথা তীব্র হয়। এ জন্য একে আগে ব্রেক বোন ফিভার বলা হতো। মানে যে জ্বরে শরীরে হাড় ভেঙে যাওয়ার মতো অনুভূতি হয়। ডেঙ্গু হলে জ্বরও তীব্র মাত্রার হয়, ১০৩ থেকে ১০৪ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড পর্যন্ত তাপমাত্রা উঠে যেতে পারে। ডেঙ্গু জ্বরের দুই-তিন দিনের মাথায় শরীরের ত্বকে বিশেষ ধরনের ফুসকুড়ি হতে দেখা যায়, যা সাধারণত কোভিডে আক্রান্ত হলে হয় না।
উল্টো দিকে কোভিড বারবার তার চরিত্র বদলাচ্ছে। বর্তমানে যে ধরনটি ছড়িয়ে পড়ছে তাতে অনেক রোগীর কাশি বা জ্বরের মতো সাধারণ লক্ষণ দেখা যায় না। পরিবর্তে গিঁটে ব্যথা, মাথাব্যথা, গলাব্যথা, পিঠে ব্যথা, ক্লান্তি, ক্ষুধা হ্রাস, হালকা থেকে মাঝারি শ্বাসকষ্ট, নিউমোনিয়া দেখা যায়।
অনেক ক্ষেত্রেই নাকের সোয়াব পরীক্ষা করে এই উপধরনের ভাইরাস পাওয়া যায় না। তবে বুকের এক্স-রে বা সিটি স্ক্যানের মতো ইমেজিং পরীক্ষায় ফুসফুসের সংক্রমণ শনাক্ত হয়। তাহলে নতুন এই রূপ কি আরও বিপজ্জনক? উত্তর হলো—বর্তমান তথ্য-উপাত্ত বলছে, যদিও অমিক্রন এক্সবিবি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে, তবু এটি উচ্চ মৃত্যুহারের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। তবে বয়স্ক ব্যক্তি, দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তি, অথবা দীর্ঘমেয়াদি রোগ আছে (যেমন ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ) এমন ব্যক্তিরা গুরুতর জটিলতার মুখোমুখি হতে পারেন।
ডেঙ্গুর জটিলতা লক্ষণীয় হয় পাঁচ দিনের মাথায়। তখন নাক, দাঁত বা অন্য কোথাও থেকে রক্তক্ষরণ হতে পারে। রক্তনালির ভেতর থেকে রক্তরস বেরিয়ে এসে (প্লাজমা লিকেজ) পেটে, বুকে পানি জমতে পারে। জটিলতা বেশি হলে রোগী শকে চলে যেতে পারে, অর্থাৎ হৃৎস্পন্দন, রক্তচাপ দুর্বল হয়ে যেতে পারে।
যেহেতু এখন দুটো রোগের ব্যাপক সংক্রমণজনিত ক্রান্তিকাল চলছে, তাই জ্বর হলে অবহেলা করার কোনো সুযোগ নেই। পরিবারে ছোট–বড় যে কারও জ্বর হলে সতর্ক হতে হবে। মনে রাখবেন ডেঙ্গু জ্বরের জটিলতা শিশুদের বেশি হয়, এমনকি মৃত্যুহারও শিশুদের বেশি। আবার কোভিডে বয়স্ক, যাদের ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, কিডনি রোগ ইত্যাদি আছে তারা বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। অন্তঃসত্ত্বা নারীদের জন্য দুটি রোগই ঝুঁকিপূর্ণ। তাই পরিবারে কেউই ঝুঁকিমুক্ত নয়।
তাই জ্বর হলে নিজেকে পরিবারের অন্য সদস্যদের থেকে আলাদা করে নেবেন। দুটি সংক্রমণই আপনার কাছ থেকে অন্যদের কাছে যেতে পারে, একটা মশার কামড়ের মাধ্যমে, অন্যটা শ্বাসপ্রশ্বাসের মাধ্যমে। তাই আলো-বাতাসপূর্ণ একটি আলাদা কক্ষে বিশ্রাম নিন। প্রচুর পানি, তরল ও পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করুন। তারপর যত দ্রুত সম্ভব টেলিফোনে, অনলাইনে বা হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
চিকিৎসকের পরামর্শে ডেঙ্গু নির্ণয়ের জন্য এনএসওয়ান অ্যান্টিজেন (দেরি হলে অ্যান্টিবডি) আর কোভিড নির্ণয়ের জন্য আরটি–পিসিআর পরীক্ষা করে ফেলুন। এর বাইরে রক্তের কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট (সিবিসি) দুই ক্ষেত্রেই দরকার হবে। পরবর্তী সময়ে দুটি আলাদা রোগের জন্য আলাদা কিছু পরীক্ষা করার প্রয়োজন হতে পারে।
নিজে নিজে এর-ওর কথায় বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখে ওষুধ শুরু করে দেবেন না। এতে হিতে বিপরীত হতে পারে। কারণ, রোগ শনাক্ত না করে ওষুধ খাওয়া বিপজ্জনক। চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। ডেঙ্গু হলে সাধারণত জ্বর কমাতে কেবল প্যারাসিটামল দেওয়া হয়, আর কিছু নয়। মৃদু কোভিডের ক্ষেত্রেও তেমন কোনো ওষুধ লাগে না।
ডেঙ্গু ও কোভিড একসঙ্গেও হচ্ছে অনেক জায়গায়। দুটি রোগের চিকিৎসা একসঙ্গেই চলতে পারে। এতে বেশি সতর্কতা দরকার হয়। কারণ, কোভিডে রক্ত জমাট না বাঁধার জন্য রক্ত তরলীকরণের ওষুধ দেওয়া হয়, ওদিকে ডেঙ্গুতে রক্তক্ষরণ একটি বড় সমস্যা। তবে গবেষণা বলছে, সঙ্গে ডেঙ্গু থাকলেও সতর্কতার সঙ্গে রক্ত তরলীকরণ হেপারিন (Heparin) জাতীয় ওষুধ দিতে বাধা নেই। তবে এসব চিকিৎসা অবশ্যই হাসপাতালে ভর্তি হয়ে নিতে হবে।
ডেঙ্গু ও কোভিড দুটোই প্রতিরোধযোগ্য রোগ। এই সময় যখন চারদিকে এ ধরনের রোগীর আক্রান্ত হওয়ার হার ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে, হাসপাতালগুলো পরিপূর্ণ, তখন নিজের পরিবারের সুরক্ষায় সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করুন।
ডেঙ্গু প্রতিরোধ করা যায় এডিস মশা নির্মূলের মাধ্যমে। নিজের বাসা–বাড়ি, আশপাশ পরিচ্ছন্ন রাখুন। টবের নিচে, বারান্দায়, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্রের নিচে, পরিত্যক্ত টায়ারে বা গ্যারেজে যেন পানি না জমে থাকে। নিয়মিত মশার ওষুধ ছিটান এসব জায়গায়। এডিস মশার ডিম এক বছর পর্যন্ত পরিবেশে টিকে থাকতে পারে, তারপর বৃষ্টি এলে লার্ভা তৈরি করে।
তাই পরিচ্ছন্নতা ও মশা নিধন অভিযান কেবল বর্ষায় নয়, সারা বছর ধরে চালাতে হবে। দিনের বেলা শিশুদের মশারি টানিয়ে ঘুম পাড়াবেন। ফুলহাতা জামাকাপড় পরাবেন। রিপেলেন্ট ক্রিম লাগাতে পারেন। পাড়া–মহল্লার সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করুন, তবে মশামুক্ত হতে পারবেন।
কোভিড প্রতিরোধ ডেঙ্গুর চেয়েও সহজ আর সস্তা। একটি মাস্ক আর একটি যেকোনো মূল্যের সাবানই আপনাকে সুরক্ষা দিতে পারে। জনাকীর্ণ স্থান এড়িয়ে চলুন। নাক–মুখ উভয়ই ঢেকে সঠিকভাবে মাস্ক পরুন। ঘন ঘন হাত ধুতে হবে। স্যানিটাইজার ব্যবহার করুন। কমপক্ষে দেড় মিটার শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখুন।
কোনো লক্ষণ দেখা দিলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। নেওয়া না থাকলে কোভিড ভ্যাকসিন এবং বুস্টার ডোজ গ্রহণ করুন। ইন্টারনেটে অনেক অতিরঞ্জিত বা বিভ্রান্তিকর বার্তা ছড়িয়ে পড়ছে। সঠিক তথ্যের জন্য বিশ্বস্ত উৎসের ওপর নির্ভর করুন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র, স্বাস্থ্যসেবা অধিদপ্তর ও আইসিডিডিআরবির দেওয়া তথ্য নির্ভরযোগ্য।
মোট কথা, ভাইরাস ও ভাইরাসের বিস্তার সম্পর্কে ধারণ থাকলেই কিন্তু ভাইরাস প্রতিরোধ করা অনেকটাই সম্ভব হয়ে যাবে। জনগণের প্রত্যক্ষ সংযোগ ছাড়া ডেঙ্গু, কোভিড বা বিভিন্ন রোগ ও মহামারি—কোনোকিছুর বিরুদ্ধেই প্রতিরোধ গড়া সম্ভব হবে না। সমন্বিত কার্যক্রম পরিচালনা আবশ্যক। তবে আতঙ্ক নয়, সতর্ক ও সচেতনতাই ডেঙ্গু/কোভিড প্রতিরোধ করতে পারে।
ড. মো. আনোয়ার খসরু পারভেজ ।। গবেষক ও অধ্যাপক, মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]
সম্পর্কিত বিষয়:
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: