ভোটের আগে শর্তের লড়াই
প্রকাশিত:
১৪ আগস্ট ২০২৫ ১৩:২৪
আপডেট:
১৪ আগস্ট ২০২৫ ১৭:৫৮

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশে রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন করে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ঘোষণার পর ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের প্রস্তুতি এগোতে থাকলেও, তাতে একমত নয় বিএনপির দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক শরিক জামায়াতে ইসলামী ও নতুন উদীয়মান দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)।
তারা বলছে, নির্বাচনের আগে সংস্কারের জন্য ঘোষিত ‘জুলাই সনদ’ বাস্তবায়ন করতে হবে, না হলে তারা আন্দোলনে যাবে এবং প্রয়োজনে ভোট বর্জনের মতো সিদ্ধান্তও নিতে পারে।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বিএনপি এক ধরনের চাপে পড়েছে। কারণ একদিকে, দলটি ইতোমধ্যে নির্বাচনের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে এবং সরকারের সঙ্গে লন্ডনে এক ধরনের সমঝোতায় পৌঁছেছে; অন্যদিকে, জামায়াত ও এনসিপি এখন সেই সমঝোতার বিরোধিতা করছে এবং সরকারের পাশাপাশি বিএনপির দিকেও আঙুল তুলছে। এতে করে নির্বাচন সামনে রেখে রাজনৈতিক অঙ্গনে বিভক্তি বাড়ছে, এবং প্রশ্ন উঠছে—এই ভোট আদৌ অংশগ্রহণমূলক হবে কি না।
লন্ডনে গত ১৩ জুন ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মধ্যকার বৈঠকের পর যৌথ বিবৃতিতে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের সিদ্ধান্ত জানানো হয়। সেই বৈঠক থেকেই জামায়াত ও এনসিপির মধ্যে অসন্তোষ তৈরি হয়। তারা মনে করছে, ওই বৈঠকের মাধ্যমে সরকার এককভাবে বিএনপির সঙ্গে সমঝোতায় পৌঁছেছে এবং বাকি দলগুলোকে পাশ কাটিয়ে দিয়েছে। এরপর থেকে তারা নির্বাচনের আগে সংস্কারের দাবিতে সরব হয়ে উঠেছে।
জামায়াত ও এনসিপি বলছে, নির্বাচন আয়োজনের আগে ‘জুলাই সনদ’ বাস্তবায়ন করতে হবে। এই সনদে সংবিধান সংস্কার, রাজনৈতিক দলগুলোর সমান সুযোগ, এবং নির্বাচনী পদ্ধতিতে পরিবর্তনের প্রস্তাব রয়েছে। বিশেষ করে জামায়াত বলছে, জাতীয় ও আঞ্চলিক নির্বাচনে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতি চালু করতে হবে, যাতে সব দলের জন্য আসন পাওয়ার সুযোগ থাকে। এই দাবির সঙ্গে ইসলামপন্থী আরও কয়েকটি দল একমত। তারা বলছে, বর্তমান ব্যবস্থা বড় দলগুলোর পক্ষে এবং ছোট দলগুলোর অংশগ্রহণ সীমিত করে।
অন্যদিকে, বিএনপির অবস্থান হচ্ছে, নির্বাচন আগে হোক—সংবিধান বা অন্যান্য সংস্কার নির্বাচিত সংসদ করবে। তারা ভোট পেছানোর বা ‘জুলাই সনদ’ এখনই বাস্তবায়নের পক্ষে নয়। মূলত, ক্ষমতা থেকে আওয়ামী লীগকে সরিয়ে নির্বাচনে যেতে চায় বিএনপি। ফলে, জামায়াত ও এনসিপির সঙ্গে এই বিষয়ে মতপার্থক্য তৈরি হয়েছে।
জামায়াত ও এনসিপি নেতারা মনে করেন, সরকার ও বিএনপি এক হয়ে একটি ‘সাজানো নির্বাচন’ করতে চাইছে। তারা দাবি করছে, লন্ডন বৈঠকের পর প্রশাসনের আচরণে পরিবর্তন এসেছে, এবং নির্বাচনী মাঠে বিএনপির প্রতি পক্ষপাত দেখা যাচ্ছে। এসব অভিযোগ তুলে তারা এখন বলছে, নির্বাচনের আগে এই অবস্থার পরিবর্তন না হলে তারা রাজপথে কর্মসূচি দেবে এবং প্রয়োজনে নির্বাচন বর্জন করবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, জামায়াত ও এনসিপি যদি নির্বাচনে না আসে, তবে ভোটে অংশগ্রহণের চিত্র দুর্বল হবে। একমাত্র বিএনপি অংশ নিলেও নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। আওয়ামী লীগ আগে থেকেই নিষ্ক্রিয় অবস্থানে থাকায়, বিএনপি অনেকটা একক প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে নির্বাচনে যাচ্ছে। তবে জামায়াত ও এনসিপির অনুপস্থিতি ভোটকে বিতর্কিত করতে পারে এবং বিএনপিও রাজনৈতিকভাবে বেকায়দায় পড়তে পারে।
বিএনপি অবশ্য জামায়াত ও এনসিপির অবস্থানকে বড় করে দেখছে না। দলটির শীর্ষ নেতারা বলছেন, এইসব বক্তব্য মাঠের রাজনীতির অংশ এবং শেষ পর্যন্ত সব দলই নির্বাচনে আসবে। তবে বাস্তবতা হলো, ভোট যতই এগিয়ে আসছে, ততই মাঠে উত্তেজনা বাড়ছে এবং জামায়াত-এনসিপি সরাসরি সংঘাতের পথে যেতে পারে।
এদিকে নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, তারা শিগগির রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করবে। তবে তাদের এখতিয়ার শুধু নির্বাচনী তফসিল, পরিবেশ ও ভোটের নিয়ম-কানুন নিয়ে। সংবিধান সংস্কার বা ‘জুলাই সনদ’ বাস্তবায়নের মতো রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে আলোচনার সুযোগ তাদের নেই।
সরকারও আপাতত আলোচনার পথে যেতে চায় না। অন্তর্বর্তী সরকারের এক উপদেষ্টা জানিয়েছেন, নির্বাচন এখন কমিশনের অধীনে, তাই রাজনৈতিক দাবিদাওয়া তারা নয়, কমিশন বিবেচনা করবে। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সরকার ও বিএনপির একক সিদ্ধান্তে ভোটের সময় নির্ধারণ, এবং অন্যদের উপেক্ষা করার কারণে সন্দেহ ও সংকট বাড়ছে।
জামায়াত ও এনসিপি এখন বলছে, তারা নির্বাচন ঠেকাতে চায় না, বরং তারা চায় একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। এজন্য প্রয়োজন নির্বাচনপূর্ব সংস্কার। কিন্তু যদি এসব শর্ত মানা না হয়, তাহলে তারা আন্দোলনে নামবে এবং প্রয়োজনে ভোট বর্জন করবে। তারা মনে করে, এই মুহূর্তে নির্বাচনকে প্রাধান্য দেওয়া রাজনৈতিকভাবে ভুল সিদ্ধান্ত, কারণ জনগণের প্রত্যাশা এখন সুশাসন ও রাজনৈতিক সংস্কার।
সম্পর্কিত বিষয়:
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: