ইরান কেন ইসলামের ইতিহাসে অমর হয়ে আছে?
প্রকাশিত:
১৫ জুন ২০২৫ ১৬:৩০
আপডেট:
১৬ জুন ২০২৫ ০২:৩৫

ইরানের প্রাচীন নাম পারস্য। এটি শুধু ভৌগোলিক অবস্থান নয়, বরং ইসলামি ইতিহাস, জ্ঞান, সাহিত্যে অপরিসীম অবদানের জন্য বিশ্ব মুসলিম সমাজে একটি গুরুত্বপূর্ণ ও সম্মানিত নাম। রাসুলুল্লাহ (স.)-এর যুগ থেকেই ইরানের সঙ্গে ইসলামের একটি নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, যা কালের পরিক্রমায় আরও গভীর ও বিস্তৃত হয়েছে।
এই প্রতিবেদনে আমরা ইরানকে বিখ্যাত করে তোলা কয়েকটি দিক বিশ্লেষণ করছি।
১. পারস্য বিজয় ও ইসলাম প্রচার
ইসলামের সূচনালগ্নে পারস্য (বর্তমান ইরান) ছিল একটি বিশাল সাম্রাজ্য। হজরত ওমর ইবন খাত্তাব (রা.) এর খেলাফতের সময় পারস্যের বিভিন্ন অঞ্চল মুসলিম বাহিনীর মাধ্যমে বিজিত হয়। এটি ছিল একটি ঐতিহাসিক ঘটনা, কারণ পারস্য তখনকার পৃথিবীর অন্যতম ক্ষমতাধর সাম্রাজ্য ছিল।
পারস্য বিজয়ের পর ইসলামের বাণী দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং বহু ইরানি স্বেচ্ছায় ইসলাম গ্রহণ করেন। ইসলাম গ্রহণকারী এই ইরানিরা শুধু ধর্ম মেনে থেমে থাকেননি, বরং তাঁরা জ্ঞান, সাহিত্য, ফিকহ ও হাদিস শাস্ত্রে অসামান্য অবদান রাখতে শুরু করেন।
২. ইরানের প্রথম দীপ্তিমান তারকা সাহাবি সালমান ফারসি (রা.)
ইরান ইসলামের ইতিহাসে প্রথম পরিচিতি পায় সাহাবি সালমান আল-ফারসি (রা.)-এর মাধ্যমে। তিনি ছিলেন একজন পারস্য নাগরিক, যিনি সত্য ধর্মের সন্ধানে বহু পথ ঘুরে ইসলামের সান্নিধ্যে আসেন এবং রাসুলুল্লাহ (স.)-এর হাতে ইসলাম গ্রহণ করেন।
হিজরতের পর মদিনায় তাঁর সঙ্গে রাসুলুল্লাহ (স.)-এর সাক্ষাৎ হয় এবং তিনি ইসলামের মহান সেনানায়ক হয়ে ওঠেন। খন্দকের যুদ্ধে তাঁর দেওয়া পরামর্শ ছিল ইসলামের ইতিহাসে চির স্মরণীয়—তিনি কনফেডারেট বাহিনীর বিরুদ্ধে পরিখা খননের কৌশল দেন, যা সফল হয় এবং মুসলিমদের বিজয় নিশ্চিত হয়।
৩. হাদিস ও ফিকহশাস্ত্রের বহু ইমাম ছিলেন ইরানি বংশোদ্ভূত
ইরানি মুসলমানদের অন্যতম বড় অবদান হাদিস ও ইসলামি জ্ঞানশাস্ত্রে। অনেকেই ভাবেন, আরব মুসলমানরাই কেবল হাদিস বা ইসলামি জ্ঞানের মূল প্রচারক, কিন্তু বাস্তবতা হলো—ইমাম বুখারি, ইমাম মুসলিম, ইমাম নসাঈ, ইমাম তিরমিজি, ইমাম গাজজালি, ইমাম হিব্বান—এসব খ্যাতনামা মুহাদ্দিসদের অধিকাংশই ছিলেন পারস্য অঞ্চলের। উদাহরণস্বরূপ ইমাম বোখারি (রহ.) ছিলেন বর্তমান উজবেকিস্তানের অন্তর্গত বুখারা নগরের অধিবাসী, যা ঐতিহাসিক পারস্য অঞ্চলের অংশ। ইমাম মুসলিম (রহ.) ছিলেন নিশাপুরের, যা বর্তমানে ইরানের অন্তর্ভুক্ত। ইমাম গায্জালি (রহ.) ছিলেন ইসলামী দার্শনিকতার জগতে কিংবদন্তি, যিনি ইরানের তুস শহরে জন্মগ্রহণ করেন।
৪. ইরান আহলে বাইত প্রেমের কেন্দ্র
ইরানে আহলে বাইতের প্রতি প্রেম ও শ্রদ্ধা চর্চা অত্যন্ত সুগভীর। ইসলামের ইতিহাসে আহলে বাইতের সদস্যদের অনেকেই পারস্য অঞ্চলে সফর করেছেন, কেউ কেউ শহীদ হয়েছেন কিংবা সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করেছেন। ইরানের বহু শহরে আহলে বাইতের বংশধরদের কবর, মাজার ও স্মৃতিস্তম্ভ রয়েছে, যা ইরানিদের হৃদয়ে গভীর ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার প্রতীক।
৫. ইসলামি স্থাপত্য ও ক্যালিগ্রাফির অনন্য ধারা
ইরান ইসলামি স্থাপত্য ও ক্যালিগ্রাফির ক্ষেত্রে বিশ্ববিখ্যাত। বিশেষ করে ইসফাহান, শিরাজ, ইয়াজদ, কাশান, মাশহাদ ও তেহরানে রয়েছে এমন সব মসজিদ, মাদ্রাসা ও সমাধি, যা শুধু মুসলিমদের নয়, সারা বিশ্বের পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্র। বিশেষ উল্লেখযোগ্য মসজিদ হলো- শাহ মসজিদ (ইসফাহান): ইসলামী স্থাপত্যের এক অপূর্ব নিদর্শন, পিঙ্ক মসজিদ (শিরাজ): রঙিন কাঁচের আলো-ছায়ার খেলায় বিমোহিত করে দর্শকদের, ইমাম রেজা কমপ্লেক্স (মাশহাদ): শিয়া মুসলমানদের অন্যতম বড় ধর্মীয় কেন্দ্র
৬. ইসলামি সাহিত্য, দর্শন ও কবিতার কেন্দ্র
ইরান একদিকে যেমন হাদিস ও ফিকহের ভূমি, তেমনি তাসাউফ, ইসলামি দর্শন ও কবিতারও প্রাণকেন্দ্র। ফারসি ভাষায় রচিত বহু সুফি কবিতা আজও বিশ্বজুড়ে সমাদৃত। রুমি, হাফেজ, সাদি, ওমর খৈয়াম—এঁরা সবাই ছিলেন মুসলমান কবি ও দার্শনিক, যাঁরা ইসলামের প্রেম, আত্মশুদ্ধি ও ঈমানের গভীর বাণী ছড়িয়ে দিয়েছেন কবিতায় কবিতায়।
৭. ইসলামি বিপ্লব ও রাজনৈতিক জাগরণ
১৯৭৯ সালে আয়াতুল্লাহ খোমেনির নেতৃত্বে ইরানে ঘটে ইসলামি বিপ্লব, যার মাধ্যমে শাহ শাসনের অবসান ঘটে এবং ইসলামি প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। এই বিপ্লব ছিল আধুনিক সময়ের অন্যতম বড় ধর্মীয় রাজনৈতিক জাগরণ। এতে করে ইরান শুধু ধর্মীয় দিক দিয়ে নয়, রাজনৈতিকভাবেও ইসলামি বিশ্বে একটি শক্ত অবস্থান তৈরি করে।
ইরান শুধু এক দেশের নাম নয়—ইতিহাস, জ্ঞান, সাহিত্য, আলেম, সুফিবাদ, স্থাপত্য ও ইসলামি সংস্কৃতির এক বিশাল ভাণ্ডার। সাহাবিদের পদচারণা, হাদিসশাস্ত্রের উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা এবং আহলে বাইতের স্মৃতিময় স্থানসমূহ—সব মিলিয়ে ইরান আজও ইসলামের ইতিহাসে এক অনন্য পরিচিতি বহন করে।
সম্পর্কিত বিষয়:
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: