সোমবার, ২৮শে এপ্রিল ২০২৫, ১৫ই বৈশাখ ১৪৩২

Shomoy News

Sopno


কর ছাড় ও অর্থ পাচার : মুনিম সিন্ডিকেটের কেলেঙ্কারি উন্মোচনে দুদক


প্রকাশিত:
২৮ এপ্রিল ২০২৫ ১২:০৪

আপডেট:
২৮ এপ্রিল ২০২৫ ২২:১০

ছবি সংগৃহীত

সাবেক চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিমের ছবিসহ দুদকের লোগো যেতে পারেবিভাগ-অরএস আলম ও বেক্সিমকোসহ দেশের বড় শিল্পগোষ্ঠীকে হাজার হাজার কোটি টাকার নিয়ম বহির্ভূত কর মওকুফ কিংবা অর্থ পাচারে সহযোগিতা এবং অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম ও সাবেক প্রথম সচিব (শুল্ক ও ভ্যাট প্রশাসন) ঈদতাজুল ইসলামসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

অনুসন্ধান পর্যায়ে এস আলম, বেক্সিমকো, সামিটসহ বড় কোম্পানিগুলোর সুবিধা পাওয়ার তথ্য, তাদের কর ফাঁকি ও পাচারসহ সংশ্লিষ্ট নথিপত্র তলব করেছে দুদকের অনুসন্ধান টিম। সম্প্রতি এনবিআর বরাবর পাঠানো অনুসন্ধান টিম প্রধান মো. সাইদুজ্জামানের সই করা চিঠির সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

চিঠিতে বলা হয়েছে, সাবেক এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম ও সাবেক প্রথম সচিব ঈদতাজুল ইসলামের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জনের একটি অভিযোগ দুদকের কমিশনে অনুসন্ধানাধীন রয়েছে। অনুসন্ধানের স্বার্থে দেশের কয়েকটি গ্রুপ ও শিল্পগোষ্ঠীর তথ্য চাওয়া হয়েছে। এসব গ্রুপ ও শিল্পগোষ্ঠীকে শত থেকে হাজার কোটি টাকার আয়, ভ্যাট, কাস্টমস ডিউটি ফাঁকিতে সহায়তা; অবৈধভাবে রাজস্ব মওকুফ ও অর্থপাচারে সহযোগিতা করার অভিযোগ রয়েছে।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে দুদকের মহাপরিচালক আক্তার হোসেন বলেন, যে কোনো অনুসন্ধান কমিশনের আইন ও বিধি অনুসারে পরিচালিত হয়ে থাকে। অনুসন্ধান টিম বিধি অনুসরণ করে অনুসন্ধানের স্বার্থে সংশ্লিষ্ট নথিপত্র তলব করতে পারে। এক্ষেত্রে টিম অনুসন্ধানে স্বার্থে তাই করেছে। টিমের প্রতিবেদনের আলোকে কমিশন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেবে।

অন্যদিকে এনবিআর সাবেক চেয়ারম্যান রহমাতুল মুনিমের ব্যক্তিগত নম্বরে যোগাযোগ করেও কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

যে-সব নথিপত্র তলব করা হয়েছে

দুদকের তলব করা নথিপত্রের মধ্যে রয়েছে—এস আলম গ্রুপের তিন হাজার কোটি টাকার রাজস্ব মওকুফ, করফাঁকি ও টাকা পাচার সংক্রান্ত তথ্য ও নথি দুদকে দিতে বলা হয়েছে।

সুকুক বন্ডে বেক্সিমকো গ্রুপের দুই হাজার ৫০০ কোটি টাকার ভ্যাট মওকুফ, করফাঁকি ও টাকা পাচার সংক্রান্ত তথ্য, নথি ও নোটশিট।

সামিট গ্রুপ, এস আলম গ্রুপ, বেক্সিমকো গ্রুপসহ বড় কয়েকটি গ্রুপের করফাঁকি, রাজস্ব মওকুফ ও টাকা পাচার সংক্রান্ত যাবতীয় প্রতিবেদন।

এছাড়া এসব গ্রুপ ও শিল্পগোষ্ঠীর রাজস্ব মওকুফ, করফাঁকি ও টাকা পাচার সংক্রান্ত বিষয়ে এনবিআরে কোনো তদন্ত হয়ে থাকলে সে সংক্রান্ত যাবতীয় প্রতিবেদন ও তথ্য দিতে দুদকে সরবরাহের অনুরোধ করা হয়েছে।

এনবিআর সাবেক চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম ও সাবেক প্রথম সচিব (শুল্ক ও ভ্যাট প্রশাসন) ঈদতাজুল ইসলামের বিরুদ্ধে বদলি বাণিজ্য ও হয়রানি করে কোটি কোটি টাকা অবৈধ আয় করার অভিযোগ রয়েছে।

অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, চট্টগ্রাম-ভিত্তিক বিতর্কিত শিল্পগোষ্ঠী–এস আলম গ্রুপের মালিকানাধীন ‘এসএস পাওয়ার-আই লিমিটেডকে’ আয়কর ছাড়ের সুবিধা দেওয়া হয়েছিল। যা জুলাইয়ের পট পরিবর্তনের পর ২০২৪ সালের ১৭ ডিসেম্বর বাতিল করা হয়। ২০১৯ সালের মার্চ থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের (আয়কর) এক প্রজ্ঞাপনে এসএস পাওয়ার-আই লিমিটেডকে প্রদত্ত ঋণ থেকে উদ্ভূত ফি’র ওপর করছাড়ের সুবিধা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ওই সময়ে কোম্পানিকে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার বেশি কর মওকুফ করে এনবিআর।

আবার আবু হেনা রহমাতুল মুনিম সাবেক জ্বালানি সচিব থাকাকালে কোনো যাচাই-বাছাই ছাড়া বাংলাদেশ গ্যাসফিল্ড কোম্পানি লিমিটেডের (বিজিএফসিএল) ৯শ কোটি টাকার প্রকল্পের কার্যাদেশ একটি ভুয়া ও নামসর্বস্ব কোম্পানিকে দেওয়া হয়েছিল। নোয়া (নোটিফিকেশন অব অ্যাওয়ার্ড) ইস্যুর পরপরই পেট্রোবাংলার এক বৈঠকে ফাঁস হয়ে যায় পুরো জাল-জালিয়াতি। কোম্পানিটিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জ্বালানি খাতের একটি বড় বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখিয়ে দরপত্রে অংশ নেওয়ার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছিলেন মুনিম সিন্ডিকেট। পরে তদন্তে দেখা গেছে, এই নামে কোনো কোম্পানিই নেই যুক্তরাষ্ট্রে। টেকনোস্টিম এনার্জি নামে ওই কোম্পানিটির মালিকানার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন খোদ সাবেক জ্বালানি সচিব রহমাতুল মুনিমের চাচা, যিনি এক সময় তিতাস গ্যাস কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজার ও পরবর্তী সময়ে পেট্রোবাংলার পরিচালক ছিলেন। শুধু তাই নয়, জাল-জালিয়াতির ভয়াবহ এ তথ্য ফাঁস হয়ে যাওয়ার পর দ্বিতীয় দফায় ফের রহমাতুল মুনিমের চাপে ওই কোম্পানির দেওয়া বিডবন্ডটিও আত্মসাৎ করে নেয় সিন্ডিকেট। পরে ওই টাকা ভাগবাটোয়ারা করে নেন তারা সবাই।

অন্যদিকে বড়পুকুরিয়ার কয়লাতে পানির আর্দ্রতা (ময়েশ্চার) অর্থাৎ পানির পরিমাণ পুনর্নির্ধারণ না করে কৌশলে ৭৫১ কোটি টাকা লুট করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। একাধিক বিশেষজ্ঞ কমিটি, বিদেশি কোম্পানি ও সরকারি বিশেষজ্ঞ প্রতিষ্ঠান কয়লাতে পানির মাত্রা নির্ধারণ করে দেয়। কিন্তু জ্বালানি খাতের শক্তিশালী সিন্ডিকেট তা আমলে না নিয়ে ঠিকাদারকে পুরো বিল পরিশোধ করে। এতে গত ১৯ বছরে কয়লার সঙ্গে পানি বিক্রি করে ৭৫১ কোটি টাকা অতিরিক্ত নিয়ে গেছে বড়পুকুরিয়ার বিদেশি ঠিকাদার এক্সএমসি-সিএমসি। জানা সত্ত্বেও সরকার পানি মেশানো কয়লা কিনে বিপুল অঙ্কের টাকা গচ্চা দিয়েছে। এ নিয়ে একাধিকবার ফাইল পাঠানো হলেও তৎকালীন জ্বালানি সচিব আবু হেনা রহমাতুল মুনিমের হস্তক্ষেপে তা কার্যকর করেনি। লুটেরারা এতটাই ক্ষমতাধর ছিল খোদ বিদেশি বিশেষজ্ঞ কোম্পানির ফিজিবিলিটি স্টাডি রিপোর্টও গুরুত্ব দেয়নি। সাবেক জ্বালানি সচিব আবু হেনা রহমাতুল মুনিম, বড় পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানির তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক কামরুজ্জামান খান ও বড় পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানির ঠিকাদার এক্সএমসি-সিএমসির গঠিত সিন্ডিকেট এই লুটপাটের সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ উঠেছে। নেপথ্যে থেকে তাদের সহায়তা করেছেন শেখ হাসিনার এক উপদেষ্টা ও সাবেক বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু।

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর এনবিআরের কর্মকর্তা–কর্মচারীরা চেয়ারম্যান মুনিম ও ঈদতাজুলের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১৪ আগস্ট সরকার মুনিমের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করে। ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিমের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের মেয়াদ তৃতীয়বারের মতো আরও দুই বছর বাড়ায় সরকার। যার মধ্য দিয়ে এনবিআরের ইতিহাসে টানা ছয় বছর চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন মুনিম। দীর্ঘসময় চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালনের সময় ক্ষমতাচ্যুত হাসিনা সরকারের অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নে বড় কোম্পানি ও শিল্পগোষ্ঠীকে হাজার হাজার কোটি টাকার অনৈতিক কর সুবিধা ও করফাঁকিতে সহযোগিতা করার অভিযোগ উঠতে থাকে মুনিম সিন্ডিকেটে বিরুদ্ধে।


সম্পর্কিত বিষয়:


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:




রিসোর্সফুল পল্টন সিটি (১১ তলা) ৫১-৫১/এ, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০।
মোবাইল: ০১৭১১-৯৫০৫৬২, ০১৯১২-১৬৩৮২২
ইমেইল : [email protected]; [email protected]
সম্পাদক : লিটন চৌধুরী

রংধনু মিডিয়া লিমিটেড এর একটি প্রতিষ্ঠান।

Developed with by
Top