মঙ্গলবার, ২৯শে এপ্রিল ২০২৫, ১৬ই বৈশাখ ১৪৩২

Shomoy News

Sopno


আমিত্ব যখন সর্বনাশা


প্রকাশিত:
৩ আগস্ট ২০২৩ ১৬:৩৫

আপডেট:
২৯ এপ্রিল ২০২৫ ১৫:১০

ছবি সংগৃহিত

বড় উন্মত্ত প্রভুত্ব-পিয়াসীর অত্যাচার! এই পৃথিবী যেখানে আমিত্ববোধ, দুর্বিনীত শক্তি, সংবৃত্তির প্রতি নিষ্ঠুর উপেক্ষা, মানুষের হীন অভীপ্সা অতীত ঐতিহ্যের দিকে লক্ষ্যহীন মানুষ চলেছে সভ্যতার মুখোশ পরে তারই অন্ধ স্তাবক সেজে, দলে দলে।

প্রাচুর্যের মধ্যে অভাব উৎপাদনের এই তো পথ; অসংখ্য প্রাচুর্যের পাশেই রিক্তের অসহায় কলরোল, যারা সম্পূর্ণ আশঙ্কাশূন্য দুর্বল, যারা লাভ-লোকসান খতিয়ে দেখতে শেখেনি তাদেরই বিনিময়ে প্রতিষ্ঠা পেল তারাই, যারা আজীবনই ফাঁকি আর প্রবঞ্চনার ওপর দিয়ে চলে এসেছে। তাদেরই জয়গান, তাদেরই বন্দনা দিকে দিকে, সারা পৃথিবীজুড়ে।

এই আত্মপ্রচারের ইতিহাস খুঁজলে আমরা পাব, যারা আমাদেরই বাহন করে উঠে গেল মিথ্যা গৌরবের অভ্রভেদী শৃঙ্গে, তারা যে কতখানি অবজ্ঞার চোখে আমাদের এই দুর্বলতাকে তাদের প্রভুত্বের কথা বারবার মনে করিয়ে দেয়, পাছে আমরা ভুলে যাই!

অন্তরের অনুভূতি, আত্মার আকাঙ্ক্ষা তারা মানতে চায় না অপমান করে, তীব্র আঘাত করে এত‌ই বেপরোয়া নিষ্ঠুর! এর থেকে পরিত্রাণ নেই পথের সন্ধান অস্পষ্ট গাঢ় অস্পষ্ট ধূসর।

মিথ্যা এই অধিকারের ধারা তীব্র সমালোচনা করেছেন যারা, তারা কেউ কেউ বলেছেন ‘বিষকুম্ভ পায়োমুখ’ লোক দেখানো যত রকমের অনুষ্ঠান সম্ভব, সবই সেই প্রতিষ্ঠাকে চাকচিক্যে ঘিরে রেখেছে তার মধ্যভাগ সর্পিল হিংস্রতায় পরিপূর্ণ।

আধিক্য বৃদ্ধি (Plethora growth)-এর মতো ওই প্রতিষ্ঠার বিকাশ অবশ্যম্ভাবী। উক্ত সমালোচনা অস্বীকার করার শক্তি কারও নেই এমন আত্মবিশ্বাস তার নেই, যার জোরে সে প্রতিবাদ করতে পারে, ‘না, না, আমার পথ সত্য, আমার প্রতিষ্ঠাই সত্যিকারের প্রতিষ্ঠা।’

এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী কে? একমাত্র দায়ী আমরা, আমরাই আমাদের অনৈক্যে, দুর্বলতায় তার সুযোগ করে দিয়েছি। আমরাই নিজেদের নিশ্চেষ্টতায় অক্টোপাসের নির্ঘুম বন্ধনে জড়িয়ে পড়েছি। আমাদের সহজ বিকাশ, সংপ্রবৃত্তির প্রেরণাকে হত্যা করেছি আমরাই।

আত্মদোষ স্খলনের অজুহাত পাব কোথায়? অপক্ষপাতের দৃষ্টিতে নিজেদের অতীত খতিয়ে দেখলে লাভ-লোকসানের ফিরিস্তি সম্যক বুঝতে পারব। আর বুঝতে পারব, আমাদের দুঃখকষ্ট, ক্ষুৎপিপাসা, দৈন্য আর অপরিপুষ্টির মূল কোথায়? আমাদের নিপীড়নের উৎপত্তি কোন বিভীষিকার ভয়াল গহ্বরে।

কিন্তু কেন? আমাদের ভুল কোথায়, কোথায় আমাদের গতিভঙ্গ ঘটছে, যার প্রতিফলন এই মর্মান্তিক ছন্দহীনতা? বেদান্তবিদরা বলবেন, সবকিছুর মূলে রয়েছে ‘অবিদ্যা’, ‘অজ্ঞানতা’। ‘অবিদ্যা’র অর্থ ব্যাপক। যে বিশেষ জ্ঞানশূন্যতা বর্তমান অবস্থার জন্য সম্পূর্ণ দায়ী, তা বোঝাতে হলে আমাদের বলতে হয়, ‘বস্তুতান্ত্রিকতা’ (materialism) মানুষ জীবনের যে সংজ্ঞা করেছে, যে জীবন সে আমরণ বইবে।

স্বাতন্ত্র্যবাদ এসে বর্তমান সভ্যতায় সেঁধিয়েছে। স্বাতন্ত্র্যবাদ ব্যক্তিত্বে সীমাবদ্ধ ‘আমিত্ব’, যা দ্বারা তার অভাব-অভিযোগ, আশা-আকাঙ্ক্ষা, প্রবৃত্তি সবকিছু বোঝায়। আত্মরক্ষা মানে সেই ‘আমিত্ব’কে জিইয়ে রাখা, তার গায়ে কোনো আঁচড় না লাগিয়ে। ‘আমিত্ব’র সংঘর্ষ, বিরোধিতা, প্রতিযোগিতা, ডিঙিয়ে যাওয়া, অপরকে নিশ্চিহ্ন করা, বাধা-বিপত্তির অন্যায় সৃষ্টি এই ছয় 'ঋতু' আমাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক আবহাওয়ার বৈশিষ্ট্য। আত্মরক্ষার বর্তমান অর্থ (কদর্থ) হচ্ছে ‘প্রত্যেকেই নিজের জন্য’ সব দরদ মানুষের নিজেরই প্রতি। ‘প্রত্যেকে আমরা পরের তরে’ এই আদর্শ আজ একঘরে, বাতিল। এককথায়, কী সাম্রাজ্যবাদ, কী জাতীয়তাবাদ, কী স্বাতন্ত্র্যবাদ সকলকেই ‘আমিত্ব’ বাদকে ঘিরে রেখেছে।

অনুরূপ, চলার পথে সাহচর্য, সমবেদনা, এমনকি সহনশীলতার বিন্দুমাত্রও নিদর্শন খুঁজে পাওয়া যাবে না এখানেই জীবনের নিষ্ঠুর পরিহাস, আত্মার বন্দিত্ব। ‘পুরুষসিংহ লক্ষ্মীপতি’-র আদর্শ ক্ষয়ে গিয়ে বর্তমানে ‘বীরভোগ্যা বসুন্ধরা’ র আধিপত্য সব জায়গায়। আর সেই আধিপত্য বিস্তারের গোড়ায় রয়েছে নিঃস্বের মর্মপীড়া, দুর্বলের বিলাপ, আর্তের পুঞ্জিভূত দীর্ঘশ্বাস।

আমরা অস্বীকার করি না ‘The old order changeth, yielding place to new.’ এর কোনো সার্থকতা নেই। কিন্তু স্বার্থপরতার দৌরাত্ম্যে এই তত্ত্বের নিরর্থকতাই আমাদের মনে জাগে। স্বার্থপরতাই প্রকৃতির ব্যবস্থা, তথা প্রবৃত্তির মাল-মসলা। তাই ধ্বংসের অট্টহাসি, ভস্মস্তূপে মিলিত জয়োল্লাস আকাশ-বাতাস সক্রিয়তা ভুলে আশঙ্কায় আকুল, স্তব্ধ-নিথর।

খাও-দাও, ফুর্তি করো ক্ষণস্থায়ী স্বপ্নের আলস্যের প্রতিধ্বনি…ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা বলে কোনো আকর্ষণ তাদের নেই। কর্মের বিকৃত ধারা তাদের স্বল্প আয়ুষ্কালের বন্ধন, আত্মস্ফুরণে বিফল-হতোদ্যম হয়ে, তার সুষ্ঠু পরিকল্পনায় বিশ্বাস হারিয়ে আজ একেই করেছে তারা সম্বল।

ভুলের দুর্নিবার প্রতিক্রিয়ায় স্থিতির ভিত সরে যাচ্ছে, এই অনিবার্যই ছিল। চিরদিন ভুল দিয়ে একটা ফাঁক ভরিয়ে রাখা যায় না। সভ্যতা, সংস্কৃতিকে নিজেদের দোষ-ত্রুটি দিয়ে কয়দিন বাঁচিয়ে রাখা যায়? দিনদিন জীর্ণতর হয়ে তার বিনাশশীলতা প্রকাশ পাবেই। এর কারণ, বস্তুতান্ত্রিকতার আওতায়, যা কিছু ধরা-ছোঁয়া যায়, দেখা যায়, উপভোগ করা যায়, তাকেই ‘বাস্তব’ বলে চিনেছি।

ব্যক্তিত্ব সম্বন্ধে, আত্মা সম্বন্ধে আমরা সম্পূর্ণ অজ্ঞ, বিচারশক্তি শূন্য; এই দুইয়ের সত্যিকারের অর্থ আমাদের কাছে দুর্জ্ঞেয়। তবুও আমাদের অস্তিত্ব, উদ্দেশ্য, পরিণতি বা চলার শেষ সীমা জানতে, শিখতে এবং অনুভব করতে হবে তাদেরই উপদেশ থেকে, যারা 'সত্যজীবন'-এর অর্থ যুগে যুগে প্রচার করেছেন, দুঃখ-ক্লেশ পীড়িত এই পৃথিবীতে অমৃতের, ভূমার সন্ধান দিয়েছেন ‘শৃন্বন্তু বিশ্বে অমৃতস্য পুত্রা’। মানুষ শুধু প্রবৃত্তি-বিশেষের অনুগত নয়, তার মাঝে অবর্ণনীয় সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে। তাকে জাগাতে হবে, তার বিকাশ একান্ত প্রয়োজন; নয়তো দুঃসহ ব্যথা আর পীড়ন জীবনকে প্রতিনিয়ত বিদ্ধ করতে থাকবে।

কিন্তু পথ কোথায়? বন্দিত্বের পরিত্রাণ কোনদিকে? এর জবাব মাত্র একটি এবং যুগাবতারগণ সেই নির্দেশ দিয়েছেন। আত্মাই হলো সত্যিকারের মানুষ বিভিন্ন বিরোধী শক্তির সংহতি-সুপ্ত সম্ভাবনার বিচিত্র উল্লেখ, ভূমার প্রাচুর্য আত্মার মধ্যে নিত্য ক্রিয়াশীল, শুধু এরই অপেক্ষা করে মানুষ সব আশাপথ চেয়ে আছে। কিন্তু তা সহজলভ্য নয়, দুর্গম ও পরীক্ষা সাপেক্ষ, আভ্যন্তরিক গুণাবলীর প্রকৃত গতিক্ষেপের ওপর ন্যস্ত। তার অবয়ব দৈনিক কার্যক্রমের সামান্য বহিঃপ্রকাশ, মানুষের পরিচয়লিপির এক অধ্যায়। আর তার সহায়ক হচ্ছে তার দেহ, মন, প্রবৃত্তিনিচয় যার ভেতর দিয়ে নিজেকে সে বাইরে তুলে ধরে।

চরিত্র, অর্থাৎ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে আত্মার ক্রমিক বিবর্তন, আত্মবুদ্ধির পথ এবং পশুত্বের (animality) ওপর পূর্ণ আধিপত্য বিস্তার। নীতিজ্ঞান, ভালোমন্দ বিচারবোধ, জ্ঞানবৃক্ষের ফল খাওয়া থেকে এদের উৎপত্তি। অভিজ্ঞতা নিংড়ে আত্মা নিয়েছে তার রস, পেয়েছে পুষ্টি।

প্রয়োজনের অসংখ্য দাবি তাদের পরিপূর্ণতার জন্য কঠিন চলা তখনই শেষ হবে, যখন মানুষ নিজেকে অমৃতের ন্যায্য অংশীদার বলে চিনতে পারবে, যখন তার অন্তরের শোভাসম্পদ পাবে পূর্ণ মুক্তি, যখন সে হৃদয়ঙ্গম করবে ‘সোহম্’ তত্ত্ব।

এমন একটি নিয়ম আছে, যা আমাদের সত্যানুসন্ধিৎসার প্রতি সজাগ করে তোলে, আমাদের বলে দেয় কঠিন পরীক্ষার সময় কেউ সরে থাকতে পারে না, নিশ্চেষ্ট হয়ে বসে থাকার কোনো উপায় নেই। আর সেই নিয়মের মূল বন্ধ হচ্ছে প্রেম ও সহজ অনুভূতি, তার পরিণতি নিবৃত্তি, তথা অন্তরের শান্তি। এই নিয়মের ধারানুযায়ী কী ভালো কী মন্দ আমরা জানতে পারি যা আকর্ষণ-বিকর্ষণ সমতুল্য।

প্রত্যেক কর্মে এবং তার প্রতিক্রিয়ায় ঐক্য আছে, তার ফলভোগ করতেই হবে, নিষ্কৃতি পাওয়ার সুযোগ নেই। আমরা যে রকম বীজ বুনব, অনুরূপ ফল আমাদের পেতেই হবে, ভিন্ন কিছু আশা করা অলীক কল্পনা, বাতুলতা। নিয়মের ব্যতিক্রম নেই। কিন্তু বারবার এই জায়গাতেই করে বসি ভুল, ওই নিয়ম করি অমান্য।

কাজেই দোষ কার, তা আমাদেরই চলার মাঝে দেখতে পাই ‘ History doesn't repeat itself, but it often rhymes’। তাই বলছি অহমিকার মিথ্যা অভিনয় আর কত করব? গতিছন্দের বেসুরো, সঙ্গতিহীন গমক-মীড়-গিটকিরি টেনে জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলা আর কেন?

সুশান্ত পাল ।। উপ-কমিশনার, বাংলাদেশ কাস্টমস


সম্পর্কিত বিষয়:


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:




রিসোর্সফুল পল্টন সিটি (১১ তলা) ৫১-৫১/এ, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০।
মোবাইল: ০১৭১১-৯৫০৫৬২, ০১৯১২-১৬৩৮২২
ইমেইল : [email protected]; [email protected]
সম্পাদক : লিটন চৌধুরী

রংধনু মিডিয়া লিমিটেড এর একটি প্রতিষ্ঠান।

Developed with by
Top