বৈশ্বিক পরিসরে দেশের ভাবমূর্তি যেভাবে উজ্জ্বল হচ্ছে
প্রকাশিত:
২৮ এপ্রিল ২০২৫ ১০:২৭
আপডেট:
২৮ এপ্রিল ২০২৫ ২২:১০

মহান পোপ ফ্রান্সিসের শেষকৃত্যানুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা। তার প্রতিনিধিত্ব আমাদের ভাবমূর্তিকে উজ্জ্বল করেছে—একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় নেতার মহাপ্রয়াণকে ঘিরে যেমন তার জন্য সারা বিশ্বের সব ধর্মের মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন, একইরকমভাবে বিশ্বনেতাদের সমাবেশ মহান পোপের ‘মানবতাবাদী’ উচ্চারণের প্রতিও গভীর শ্রদ্ধার যেন বহিঃপ্রকাশ।
পোপ ফ্রান্সিসকে কেবল ক্যাথলিক খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের একজন ধর্মগুরুর মর্যাদায় না দেখে বিশ্ব মানবতার প্রেক্ষিতে তাকে ‘মানবতার প্রতিচ্ছবি’ হিসেবেই বিবেচনা করা হয়। নির্দিষ্ট ধর্মীয় বলয়ের মধ্যে আবদ্ধ না থেকে তিনি সবসময় সবার মঙ্গল চাইতেন। মানবের শান্তি, সমৃদ্ধি এবং মুক্তি কামনা করতেন।
গাজাবাসীর দুঃখ দুর্দশা তাকে যেমন কাতর করতো, রাশিয়া-ইউক্রেনের মধ্যে দীর্ঘ তিন বছরাধিককালের যুদ্ধও তার মনকে ভীষণরকম আলোড়িত করেছিল। আর সেজন্য তিনি এধরনের যুদ্ধের অবসান চেয়েছিলেন।
২০১৭ সালের ৩০ নভেম্বর পোপ ফ্রান্সিসের বাংলাদেশ সফরটিও ছিল উল্লেখযোগ্য। সেসময় তিনদিনের সফরে তিনি বিভিন্ন গির্জা পরিদর্শন করেছিলেন, রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এক উন্মুক্ত প্রার্থনাতেও সবার জন্য ঈশ্বরের আশীর্বাদ কামনা করেছিলেন।
বাংলাদেশে বসবাসরত মিয়ানমারের রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের মানুষের একটি প্রতিনিধিদলের সাথেও সাক্ষাৎকালে তিনি তাদের ‘ঈশ্বরের মুখমণ্ডল’ বলে উল্লেখ করেছেন। তার জীবদ্দশায় সত্যিকারের মানবতার বাণীই তিনি প্রচার করে গেছেন। তার অন্তিম যাত্রায় বাংলাদেশ সরকারের শীর্ষ মহলের যোগদানের মধ্য দিয়ে কেবল তার প্রতিই সম্মান জানানো হয়নি, আমরা নিজেরাও সম্মানিত হয়েছি।
২০২৪ সালের আগস্ট মাসে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর বর্তমান সরকারের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হয় আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে এই পরিবর্তনের পক্ষে জনমত সৃষ্টি করা। এরপরের মাসেই জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সভায় যোগদানের মধ্য দিয়ে বিভিন্ন রাষ্ট্রনেতাদের সাথে সাক্ষাৎ এক্ষেত্রে বিরল সুযোগ সৃষ্টি করে।
এই পথ ধরে ২০২৪ সালের নভেম্বর মাসে জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত কপ-২৯ সম্মেলনে যোগদানের মধ্য দিয়ে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিষয়ে বাংলাদেশের উদ্যোগগুলো তুলে ধরা হয়। পরের মাসে মিশরে ডি-৮ সম্মেলনে যোগদান উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ককে নতুন করে ঝালাই করার এক প্রচেষ্টা হিসেবে দেখা যেতে পারে।
২০২৫ সালের শুরুর মাসে সুইজারল্যান্ডের দাভোসে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের বৈঠকে যোগদান বাংলাদেশের জন্য এক বিশেষ উপলক্ষ, যেখানে সারা বিশ্ব থেকে অনেক রাষ্ট্রনায়ক, ব্যবসায়ী এবং নীতিনির্ধারকদের সামনে বাংলাদেশের ব্যবসা এবং বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশের উপস্থিতির বিষয়টি জানান দেওয়া হয়।
এরপর থাইল্যান্ডে অনুষ্ঠিত বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলন, চীনে দ্বিপাক্ষিক সফর এবং সবশেষে মহান পোপের শেষকৃত্যানুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার আগে কাতারে অনুষ্ঠিত দু’দিনব্যাপী ‘আর্থনা শীর্ষ সম্মেলনে’ যোগ দেওয়ার পর আগামী মাসে জাপানের নিক্কেই ফোরামে যোগ দেওয়ার কথা রয়েছে সরকারের প্রধান উপদেষ্টার।
অনেক সম্ভাবনার দেশ বাংলাদেশ। দুর্ভিক্ষ-দরিদ্র দেশের অপবাদ ঘুচিয়ে বাংলাদেশ সময়ের পরিক্রমায় অনেকটাই ঘুরে দাঁড়িয়েছে। বৈশ্বিক পরিবর্তনের আবহে একটি রাষ্ট্র যখন উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে নিজেদের জীবনমানের উন্নতি ঘটাতে চায়, এই অবস্থায় নিজের স্বকীয়তা ধরে রেখে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে যোগাযোগের অপরিসীম গুরুত্ব রয়েছে।
‘কানেক্টিভিটি’ বা পারস্পরিক যোগাযোগ যত বেশি বাড়বে, একটি রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তত বেশি আবেদন সৃষ্টি করতে পারবে। এই লক্ষ্যে সবার আগে এটাও নির্ধারণ করা প্রয়োজন যে আমাদের কাঙ্ক্ষিত উন্নতি করতে হলে সম্ভাবনার কোন ক্ষেত্রগুলো কত বেশি মাত্রায় সহজলভ্য রয়েছে।
২০২৪ সালের আগস্ট মাসে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে এই বিষয়টি বেশ পরিস্ফুটিত হয়ে উঠছে। জাতি হিসেবে আমরা সবসময়ই রাজনৈতিকভাবে বহুধাবিভক্ত। রাজনৈতিক সরকারগুলোর সময় দেশের কাঙ্ক্ষিত অর্থনৈতিক উন্নয়ন না হওয়ার পেছনে এটা একটা বড় কারণ।
আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে প্রতিবেশী ভারত বা পাকিস্তান নির্ভরতা আমাদের রাজনীতির গণ্ডি ছাপিয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়নকে কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারেনি, অথচ আগেই বলেছি অনেক সম্ভাবনার দেশ আমাদের এই বাংলাদেশ। এরপরও বিগত দশকগুলোয় আগের তুলনায় দেশে অনেক বৈদেশিক বিনিয়োগ বেড়েছে, নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির ফলে দারিদ্র্যের হার নিচে নেমেছে।
সবকিছুর পেছনে সবচেয়ে বড় সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করেছে আমাদের মানুষের মধ্যে পরিবর্তনের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি। এর ফলে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় এটা অনেক বেশি দৃশ্যমান হয়েছে যে বাংলাদেশকে ঘিরে অনেক দেশের অন্যরকম আগ্রহ তৈরি হয়েছে। এদেশের ভৌগোলিক অবস্থান, সহজলভ্য কাঁচামাল ও শ্রমশক্তি এবং সর্বোপরি বঙ্গোপসাগরের সাথে দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া হয়ে বৈশ্বিক যোগাযোগের সক্ষমতা—এসবকিছুই এখন অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধনে মরিয়া দেশগুলোর জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
একতরফাভাবে যেন কেউ আমাদের ব্যবহার করে নিজেদের স্বার্থ পূরণ করতে না পারে বরং দরকষাকষির মধ্য দিয়ে নিজেদের জাতীয় স্বার্থকে সমুন্নত রাখা সম্ভব এই বিবেচনায় বর্তমান সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় সুযোগটি হচ্ছে এর একটা অরাজনৈতিক চরিত্র রয়েছে, যার মধ্য দিয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধনের প্রয়াসে নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করার সুযোগ রয়েছে।
এ লক্ষ্যে সরকারের প্রথম এবং প্রধান দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে যতবেশি সম্ভব বৈদেশিক বিনিয়োগের সুযোগ অন্বেষণ করা। দায়িত্ব গ্রহণের পর সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রথম দৃষ্টিভঙ্গি ছিল বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ সম্পর্কে একটি ইতিবাচক ভাবমূর্তি সৃষ্টি করা।
উপরোক্ত বিষয়ের আলোকে এটাই মনে করা যেতে পারে যে, কেবল নিজস্ব সম্ভাবনার মধ্যে আবদ্ধ না থেকে একে কীভাবে কাজে লাগানো যায়, সেই সুযোগ উন্মোচন করাও জরুরি। স্বাধীনতার ৫০ বছরাধিককাল অতিক্রম করার পরও একটি জাতি হিসেবে আমাদের যতটুকু উন্নতি করার সুযোগ ছিল, এর সঠিক ব্যবহারে আমরা কতটুকু মনযোগী হতে পেরেছি, এটা আজ গভীর এক উপলব্ধির বিষয়।
একই সাথে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আমরা কতটা অন্যদের জন্য ব্যবহার হয়েছি এবং নিজেদের সক্ষমতা দিয়ে নিজেদের জন্য কতটা ভালো সুযোগ সৃষ্টি করা যায়, সেটাও ভাবার বিষয়। সেই সাথে এটাও কথা থেকে যায় যে এই অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ের পর যে রাজনৈতিক সরকার দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেবে তাদের আরও দায়িত্বশীলতার প্রয়োজন রয়েছে।
সেলক্ষ্যে এক সরকারের ভালো দিকগুলো যেন অন্য সরকার এসে পরিত্যাগ করে কেবল ক্ষুদ্র রাজনৈতিক উদ্দেশ্যগুলোই মুখ্য করে না ফেলে, এটা ভেবে দেখা ভীষণ জরুরি।
ড. ফরিদুল আলম ।। অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
সম্পর্কিত বিষয়:
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: