রবিবার, ৪ঠা মে ২০২৫, ২০শে বৈশাখ ১৪৩২

Shomoy News

Sopno


স্ক্যাবিসের বিস্তার বাড়ছে দেশে, শুধুই কি সচেতনতার অভাব?


প্রকাশিত:
৩ মে ২০২৫ ১১:৩৩

আপডেট:
৪ মে ২০২৫ ০২:১৭

ছবি সংগৃহীত

কয়েকদিন ধরে বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বাংলাদেশে বিভিন্ন স্থানে স্ক্যাবিস (Scabies) ছড়ানোর বিষয়টি নিয়ে আলোচনা এবং সচেতনতা বৃদ্ধির কার্যক্রম চলছে। স্ক্যাবিস (Scabies) বা খোসপাঁচড়া একটি অত্যন্ত সংক্রামক চর্মরোগ, যা Sarcoptes scabiei নামক পরজীবী প্রাণী (mite) দ্বারা সংক্রমিত হয়। এটি ত্বকের সংস্পর্শে দ্রুত ছড়ায় এবং চুলকানি, ফুসকুড়ি ও ত্বকের ক্ষত সৃষ্টি করে।

বাংলাদেশে স্ক্যাবিসের বিস্তার দিন দিন বাড়ছে, বিশেষ করে বস্তি, শরণার্থী শিবির, গ্রামীণ এলাকা এবং ঘনবসতিপূর্ণ পরিবেশে। দারিদ্র্য, স্বাস্থ্য সচেতনতার অভাব এবং অপর্যাপ্ত চিকিৎসা সুবিধা এই রোগের প্রাদুর্ভাব বাড়িয়ে তুলছে।

স্ক্যাবিস কী?

স্ক্যাবিস বা খোসপাঁচড়া একটি অত্যন্ত সংক্রামক চর্মরোগ, যা Sarcoptes scabiei নামক এক প্রকার মাইক্রোস্কোপিক পরজীবী প্রাণী (mite) দ্বারা সৃষ্টি হয়। এই পরজীবী মানব ত্বকের ওপরের স্তরে (Stratum corneum) বাসা বেঁধে ডিম পেড়ে বংশবিস্তার করে, ফলে তীব্র চুলকানি, লাল ফুসকুড়ি এবং ছোট ছোট ফোসকার সৃষ্টি হয়। রোগটি সাধারণত হাতের আঙুলের ফাঁক, কব্জি, কোমর, নিতম্ব এবং জননাঙ্গের চারপাশে বেশি দেখা যায়। রাতে এই চুলকানি তীব্র আকার ধারণ করে, যা রোগীর স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে ব্যাহত করে।

স্ক্যাবিস কীভাবে ছড়ায়?

এই রোগ প্রধানত দুইভাবে সংক্রমিত হয়—প্রথমত, সরাসরি দীর্ঘস্থায়ী ত্বকের সংস্পর্শের মাধ্যমে (১৫-২০ মিনিটের বেশি), যেমন একই বিছানায় ঘুমানো বা ঘনিষ্ঠ শারীরিক সম্পর্ক। দ্বিতীয়ত, পরোক্ষভাবে আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যবহৃত বস্তুর মাধ্যমে, বিশেষ করে তোয়ালে, কাপড়চোপড় বা বিছানার চাদর ব্যবহার করলে।

ঘনবসতিপূর্ণ পরিবেশ যেমন বস্তি, শরণার্থী শিবির, হোস্টেল বা শিশুদের আবাসিক প্রতিষ্ঠানে স্ক্যাবিস দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। সাধারণত সংস্পর্শের ৪-৬ সপ্তাহ পর লক্ষণগুলো প্রকাশ পায়, তবে যারা পূর্বে আক্রান্ত হয়েছে তাদের ক্ষেত্রে ১-৪ দিনের মধ্যেই লক্ষণ দেখা দিতে পারে।

বৈশ্বিক প্রাদুর্ভাব ও বোঝা

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০২২ সালের তথ্য অনুযায়ী, স্ক্যাবিস একটি বৈশ্বিক স্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, যেখানে প্রতি বছর প্রায় ২০০ মিলিয়ন মানুষ আক্রান্ত হয়। উষ্ণমণ্ডলীয় ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এই রোগের প্রকোপ সবচেয়ে বেশি, বিশেষ করে প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জে ২০-৩০ শতাংশ জনসংখ্যা, ল্যাটিন আমেরিকার কিছু অঞ্চলে ১০-২০ শতাংশ শিশু এবং আফ্রিকার উপ-সাহারা অঞ্চলে ৫-১০ শতাংশ সাধারণ জনগোষ্ঠী স্ক্যাবিসে আক্রান্ত হয়।

দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ ও প্রতিবেশী দেশ ভারতে এই রোগের ব্যাপক প্রাদুর্ভাব দেখা যায়, যেখানে ভারতে বছরে প্রায় ২৫ মিলিয়ন এবং বাংলাদেশে প্রায় ৫ মিলিয়ন মানুষ আক্রান্ত হয়। গ্রামীণ এলাকায় (৮-১২ শতাংশ) শহরাঞ্চলের (৫-৮ শতাংশ) তুলনায় সংক্রমণের হার বেশি।

স্ক্যাবিসের কারণে সৃষ্ট স্বাস্থ্য সমস্যা ও কাজ করার সক্ষমতা হারানোর ফলে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে বছরে প্রায় ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ক্ষতি হয়, যা উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টিকারী। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই রোগটিকে ‘গ্রীষ্মমণ্ডলীয় উপেক্ষিত রোগ (Tropical Neglected Diseases)’-এর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে, যা এর জনস্বাস্থ্য গুরুত্বকে আরও তুলে ধরে।

বাংলাদেশে স্ক্যাবিসের বিস্তার ও কারণ

বাংলাদেশে এই রোগটি আগে দেখা গেলেও মাঝে অনেক কমে গিয়েছিল। এই রোগটির বর্তমান বিস্তার হয়েছে প্রধানত টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে। ২০২৩ সালের মে মাসে, কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরে পরিচালিত একটি সমীক্ষায় দেখা যায় যে, প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ স্ক্যাবিসে আক্রান্ত, কিছু শিবিরে এই হার ৭০ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছেছে।

২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীর মধ্যে স্ক্যাবিস প্রতিরোধে আইভারমেকটিন ও পারমেথ্রিন ভিত্তিক ওষুধ বিতরণ করে। ঢাকার মাদ্রাসাগুলোয় পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা যায়, প্রায় ৩৪ শতাংশ শিশু স্ক্যাবিসে আক্রান্ত, যেখানে পুরুষ শিশুদের মধ্যে এই হার ৩৯.৪ শতাংশ এবং মহিলা শিশুদের মধ্যে ২৮.৪ শতাংশ।

বাংলাদেশে স্ক্যাবিসের ব্যাপক বিস্তারের পেছনে প্রধানত দারিদ্র্য, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ এবং জনসচেতনতার অভাবকে দায়ী করা যায়। দেশের বস্তি এলাকা, গ্রামীণ অঞ্চল এবং রোহিঙ্গা শিবিরগুলোয় এই রোগের প্রাদুর্ভাব সবচেয়ে বেশি, যেখানে ঘনবসতি, স্যানিটেশন ব্যবস্থার অভাব এবং স্বাস্থ্য সেবার অপ্রতুলতা বিদ্যমান।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ৫০ লাখ মানুষ স্ক্যাবিসে আক্রান্ত হয়, যার মধ্যে শিশুরা বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ। বন্যা পরবর্তী সময়ে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস, পরিষ্কার পানির অভাব, সাধারণ সাবানের অপ্রাপ্যতা এবং স্ক্যাবিস সম্পর্কে সঠিক জ্ঞানের অভাব এই রোগের বিস্তারকে ত্বরান্বিত করে। এছাড়া, অনেক ক্ষেত্রে আক্রান্ত ব্যক্তিরা প্রাথমিক অবস্থায় চিকিৎসা নেয় না বলে পরিবারের অন্য সদস্যরাও দ্রুত সংক্রমিত হয়, যা রোগ নিয়ন্ত্রণকে আরও জটিল করে তোলে।

স্ক্যাবিসের প্রভাব

স্ক্যাবিস শুধুমাত্র একটি চর্মরোগই নয়, এটি ব্যক্তিগত, সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে। শারীরিকভাবে এটি তীব্র চুলকানি ও ত্বকের ক্ষত সৃষ্টি করে, যা পরবর্তীতে ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রমণ (যেমন impetigo) এবং এমনকি glomerulonephritis-এর মতো জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে।

সামাজিকভাবে স্ক্যাবিস আক্রান্ত ব্যক্তিরা প্রায়ই বৈষম্য ও বিচ্ছিন্নতার শিকার হন, বিশেষ করে স্কুলগামী শিশুদের ক্ষেত্রে যা তাদের শিক্ষাগ্রহণে বিঘ্ন ঘটায়। অর্থনৈতিক দিক থেকে বিবেচনা করলে, এই রোগ চিকিৎসা খরচ, কাজের দিন হারানো এবং উৎপাদনশীলতা হ্রাসের মাধ্যমে দরিদ্র পরিবারগুলোর ওপর অতিরিক্ত অর্থনৈতিক চাপ (financial burden) সৃষ্টি করে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে যেখানে স্বাস্থ্যব্যবস্থা ইতিমধ্যেই চাপের মধ্যে রয়েছে, সেখানে স্ক্যাবিসের ব্যাপক প্রাদুর্ভাব স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে, যা জাতীয় পর্যায়ে একটি গুরুতর জনস্বাস্থ্য চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে।

প্রতিরোধ ও চিকিৎসা

স্ক্যাবিসের প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি সমন্বিত পদক্ষেপ প্রয়োজন, যার মধ্যে ব্যক্তিগত সচেতনতা, চিকিৎসা ও পরিবেশগত ব্যবস্থাপনা অন্তর্ভুক্ত। চিকিৎসার ক্ষেত্রে পারমেথ্রিন ক্রিম (Permethrin cream) বা আইভারমেক্টিন (Ivermectin) ট্যাবলেট সবচেয়ে কার্যকরী হিসেবে বিবেচিত হয়, যা চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী সঠিক মাত্রায় ব্যবহার করতে হবে।

একইসাথে আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসা সকল সদস্যকেও চিকিৎসা নেওয়া আবশ্যক। প্রতিরোধের ক্ষেত্রে নিয়মিত সাবান দিয়ে গোসল করা, আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যবহৃত কাপড়, তোয়ালে ও বিছানার চাদর অন্তত ৬০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার গরম পানি দিয়ে ধোয়া এবং ৭২ ঘণ্টার জন্য আলাদা করে রাখা প্রয়োজন।

জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য কমিউনিটি ভিত্তিক স্বাস্থ্য শিক্ষা কার্যক্রম, স্কুল-কলেজে সচেতনতামূলক সেশন এবং মিডিয়ার মাধ্যমে স্ক্যাবিসের লক্ষণ ও প্রতিকার সম্পর্কে তথ্য প্রচার করা যেতে পারে। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে সহজলভ্য চিকিৎসা সুবিধা নিশ্চিত করা এবং বস্তি ও দুর্গম এলাকায় মোবাইল মেডিকেল ক্যাম্পের মাধ্যমে চিকিৎসা সেবা পৌঁছে দেওয়া এই রোগের বিস্তার রোধে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।

সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ

বাংলাদেশে স্ক্যাবিস মোকাবিলায় সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে নানা ধরনের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোয় বিনামূল্যে স্ক্যাবিসের চিকিৎসা সেবা প্রদান করা হচ্ছে, বিশেষ করে প্রত্যন্ত এলাকায়। এছাড়াও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর নিয়মিতভাবে স্ক্যাবিস প্রতিরোধে সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন পরিচালনা করে থাকে।

বেসরকারি পর্যায়ে, ব্র্যাক, ডরপসহ বিভিন্ন এনজিও গ্রামীণ ও শহরের বস্তি এলাকায় স্ক্রিনিং প্রোগ্রাম চালু করেছে এবং আক্রান্তদের বিনামূল্যে ওষুধ বিতরণ করছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সহায়তায় কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ব্যাপক স্ক্যাবিস নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম চলমান রয়েছে, যেখানে mass drug administration (MDA) প্রোগ্রামের মাধ্যমে হাজার হাজার মানুষকে চিকিৎসা সেবা প্রদান করা হয়েছে। এসব উদ্যোগের পাশাপাশি স্ক্যাবিস নিয়ন্ত্রণে আরও ব্যাপক গবেষণা, পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ এবং সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব জোরদার করা প্রয়োজন।

স্ক্যাবিস বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ জনস্বাস্থ্য সমস্যা, যা দারিদ্র্য, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ ও সচেতনতার অভাবে বাড়ছে। এই রোগ নিয়ন্ত্রণে ব্যক্তিগত সচেতনতা, সরকারি উদ্যোগ এবং সামাজিক সম্পৃক্ততা অপরিহার্য। সময়মতো চিকিৎসা ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে স্ক্যাবিসের বিস্তার রোধ করা সম্ভব।

ড. কবিরুল বাশার ।। অধ্যাপক, প্রাণীবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]


সম্পর্কিত বিষয়:


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:




রিসোর্সফুল পল্টন সিটি (১১ তলা) ৫১-৫১/এ, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০।
মোবাইল: ০১৭১১-৯৫০৫৬২, ০১৯১২-১৬৩৮২২
ইমেইল : [email protected]; [email protected]
সম্পাদক : লিটন চৌধুরী

রংধনু মিডিয়া লিমিটেড এর একটি প্রতিষ্ঠান।

Developed with by
Top